ড. মো. রেজাউল কবির

  ০৬ জুলাই, ২০২০

মতামত

প্রতিবন্ধীদের অধিকার বাস্তবায়িত হোক

শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী আমাদের সমাজে বসবাসরত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা অন্য যেকোনো গোষ্ঠীগত জনসংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আমাদের সমাজে বাস করে। আবার তাদের সমস্যাগুলোর ব্যাপ্তি কিন্তু নানা ধারায়। মজার বিষয় হচ্ছে, কেউ কেউ দেশি-বিদেশি নামধারী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। তারা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে সচেতন। তারা বুঝে তাদের চলার অন্তরায়গুলো কি কি? কি করলে এগুলোর সমাধান করা যায়। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কতটা সহজভাবে তাদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

আমাদের দেশে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন যারা সমাজের অন্য দশজন প্রতিবন্ধী/ব্যক্তির পথ চলার উদহারণ। যেমন : মনসুর আহমেদ চৌধুরীর মতো একজন উচ্চশিক্ষিত এবং আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তির পদচারণা এ দেশে রয়েছে। রয়েছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের স্বনামধন্য আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন মজুমদার। আবার রয়েছে মো. খলিলুর রহমান চুন্নুর মতো সমাজ উন্নয়ন কর্মী। রয়েছে খন্দকার জহুরুল আলমের মত্াে সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব। ছালমা মাহবুবের মতো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিত্ব, যিনি অন্যদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য চিন্তাশীল মহামানুষ। রয়েছে আশরাফুন নাহার মিষ্টির মতো মহিয়ষী নারী। আরো আছেন মো. রফিকুল ইসলামের মতো সমাজে আলো ছড়ানো উজ্জ্বল অনেক নক্ষত্র। আলী হোসেনের মতো প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী উদীয়মান তরুণ প্রদীপ। এরা কিন্তু সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিত্ব। নাম বললে অনেক মানুষের কথা বলা যায়। কিন্তু কতজনের নামই বা লেখা যায়। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পদধূলি রয়েছে এ বাংলায়।

এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নে সরকার সদা সর্বদা ব্যস্ত। যে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ লোক কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের আরো কার্যকরী ভূমিকা প্রয়োজন। এদেশে উপজাতীয় সম্প্রদায়দের জন্য যেমন আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্বাধীনতা সার্বভৌম রক্ষায় আত্মনিয়োগকারী সূর্যসন্তানদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয়। আবার মহিলা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য রয়েছে ভিন্ন মন্ত্রণালয়। এতে করে কাজের পরিধি বুঝে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। কিন্তু এখন সময়ের দাবি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য ভিন্ন মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদফতর প্রয়োজন। তাহলে তাদের বিষয়ে সার্বিক সুচিন্তার ব্যাপ্তি আরো বৃদ্ধি পাবে বলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের বিশ্বাস। সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে যদি একজনকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হতো তাহলে সে সরকারের সহায়ক শক্তি অনেক গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করতে পারত। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ আরো বেশি বৃদ্ধি পেত। একই ভাবে মন্ত্রণালয়ের অধীন যদি একটি প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর থাকতো তা হলে সে অধিদফতর শুধু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে কাজ করত। তখন সত্যিই চোখে পড়ার মতো অনেক কাজ সমাজে দেখা যেত।

যদিও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১০ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর’ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর হিসেবে ঘোষণাসহ নাম ফলক উন্মোচন করেছিলেন। কিন্তু কোন কারণে তা আজো বাস্তবায়িত হলো না তা স্পষ্ট নয়। যদি ২০১৪ সালে ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর’ বাস্তবায়িত হতো তাহলে আজ ২০২০ সালে প্রতিবন্ধীবিষয়ক মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন সহজে হতে পারত। তবে এ পর্যন্ত প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা প্রধানমন্ত্রীর একক প্রচেষ্টায়ই হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু তার হাতকে তো সবাই মিলে শক্তিশালী করতে হবে। তা না হলে তো সব অগ্রগতিই থমকে যবে। কোথায় ২০১০ সালের উদ্যোগ আর ২০১৪ সালের সচিত্র প্রতিবেদন। আর আজ ২০২০ সালেও তার বাস্তবায়ন আমরা করতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রী সবক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়নের কথা চিন্তা করে কাজের নির্দেশনা দিচ্ছেন। এখন কথা হলো ক’জনে আমরা কাজটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছি, সেখানেই রয়েছে নানা প্রশ্ন।

এখনো অনেক কাজ হচ্ছে। যেমন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিবন্ধিতাবিষয়ক কিছু কাজ করছে সমাজসেবা অধিদফতর। কিছু করছে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। আবার কিছু করছে এনডিডি সুরক্ষা ট্রাস্ট। অথচ এই কাজগুলোর করার জন্য যদি ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর’ থাকতো তাহলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যেকোনো তথ্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে হতো না। বিশ্বের অনেক দেশেই প্রতিবন্ধিতার বিষয়টি একটি নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় বা একটি নির্দিষ্ট অধিদফতরে মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে। যেমন ধরেন আমাদের নিকটবর্তী দেশ ভারত সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়নের জন্য একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। তার নাম Ministry of Social Justice & Empowerment, আবার তার অধীনে একটি অধিদফতর রয়েছে তার নাম Department of Empowerment of Persons with Disabilities, আবার দেখেন থাইল্যান্ড; এখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে কর্মরত মন্ত্রণালয়ের নাম Ministry of Social Development and Human Security (MSDHS). আর অধিদফতরের নাম Department of Empowerment of Persons with Disabilities। শ্রীলংকার মন্ত্রণালয়ের নাম Ministry of Social Empowerment, Welfare and Kandyan Heritage, Awa`dZ‡ii bvg National Secretariat for Persons with Disabilities|

বর্ণিত দেশগুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি শক্তিশালী প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর রয়েছে। ফলে তাদের দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়ন কার্যক্রমগুলো অনেক সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। এভাবে প্রতিটি দেশেই একটি শক্তিশালী প্রতিবন্ধীবান্ধব সরকারের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান অন্যান্য ব্যক্তি ও সংগঠনের সাথে ফোকাল পয়েন্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের পক্ষে কাজ করে।

বাংলাদেশেও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ২০১৪ ঘোষিত এবং ফলক উন্মোচককৃত ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর’ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। এতে দেশের শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর যেমন কর্মসংস্থান হবে, পাশাপাশি বেকার প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর বিশাল কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির স্বার্থ সুনিশ্চিতকরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে রয়েছে ‘(ক) প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইন-২০১৩(খ) নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩ (গ) সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা-২০১৯ (ঘ) প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষায় জাতীয় কর্র্মপরিকল্পনা-২০১৯। এসব আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া ১৯৯৯ সালে তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে নিদের্শনা ছিল প্রতিবন্ধীবান্ধব সব কার্যক্রম একটি জায়গা থেকে সুনিশ্চিত করার জন্য জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন। ফলে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের কাজের পরিধি অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালীকরণের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রধানমন্ত্রীর ২০১৪ সালের ঘোষণা অনুযায়ী ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর’ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকারের চলমান পদক্ষেপগুলো যেমন : প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের থেরাপিউটিক সেবা, কাউন্সেলিং সেবা, চাহিদা অনুযায়ী সহায়ক উপকরণ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বিভিন্ন ভাতা, শনাক্তকরণ জরিপ, শিক্ষা কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ-কর্মসংস্থান ও পূর্ণবাসন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতি ও অন্যান্য কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর’ প্রতিষ্ঠা করা দরকার। একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের সফল রাষ্ট্রনায়ক-মানবতার মা-দেশরতœ, জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিবন্ধীবান্ধব প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের চলমান কার্যক্রম যেমন : ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র (সব উপজেলায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হওয়ার প্রস্তাব রয়েছে), অটিজম রিসোর্স সেন্টার, ক্রীড়া কমপ্লেক্স, ক্রীড়াবিদদের অনুশীলন স্থান, ৬২টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়সহ (নতুন প্রস্তাবিত রয়েছে অনেকগুলো) অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিবন্ধীবান্ধব কার্যক্রম সমন্বিতভাবে সম্পন্ন করার জন্য একটি মাদার অর্গানাইজেশন হিসেবে ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর’ বাস্তবায়ন করা দরকার। পরবর্তী সময়ে শুধুমাত্র প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে কাজ করার জন্য একটি ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়ন মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠা করা সমীচীন। ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব যাদের দেওয়া হবে তাদের পাশাপাশি সেখানে একজন যোগ্য এবং সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে রাখা যেতে পারে। তাহলে দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সার্বিক উন্নয়ন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব হবে।

লেখক : সভাপতি, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close