রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৬ জুলাই, ২০২০

পর্যালোচনা

জাগ্রত হোক মানবিক বোধ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কয়েক দশক ধরে চলে স্নায়ুযুদ্ধ নাৎসি জার্মানি ও অক্ষশক্তির পরাজয়ের পর পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে একপক্ষ পুঁজিবাদী আমেরিকার সঙ্গে, অন্যপক্ষ ঝুঁকে পড়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে। সোভিয়েত পতনের পর থেকে দীর্ঘদিন আমেরিকা বলতে গেলে একক রাজত্ব চালিয়েছে বিশ্বজুড়ে। কিন্তু এখন আবার ফিরে আসছে সেই স্নায়ুযুদ্ধের যুগ। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার শঙ্কা থাকলেও পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। আগেও অনেকবার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ফিরে এসেছে বিশ্ব। অচিরেই বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না বলেই মনে হচ্ছে। জাতীয়তাবাদের আবার পুনরুত্থান ঘটছে পৃথিবীতে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে সামরিক শাসকরা নন, হিটলারের মতোই গণতান্ত্রিক উপায়ে বিপুল জনপ্রিয়তার হাত ধরেই নব্য ফ্যাসিবাদীরা আসছেন ক্ষমতায়। কিন্তু সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের বদলে উগ্র জাতীয়তাবাদের স্লোগান তুলছেন তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প এর জ্বলন্ত উদাহরণ। যে ইউরোপ এক শতাব্দীতে দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, সেই ইউরোপের নানা দেশেও পপুলিস্টদের উত্থান ঘটছে। ব্রিটেনের পপুলিস্টরা তো ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যকে বের করেই ছাড়লেন, কেবল সময়ের অপেক্ষা। গণতন্ত্রের তেমন একটা তোয়াক্কা না করে ক্ষমতায় থাকা রাশিয়ার পুতিন এবং চীনের শি জিনপিংও রয়েছেন। বিপুল পর্যায়ক্রমে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্ব নিয়েছে চীন। সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো না হলেও সামরিক শক্তিতে এবং ভূরাজনৈতিক অবস্থানে এশিয়া ও ইউরোপের মাঝখানে অবস্থান করায় রাশিয়াও দারুণভাবে ফিরে এসেছে।

সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে ভয়াবহ ও জঘন্যতম ঘটনা হচ্ছে সৌদি আরবের নেতৃত্বে মিসর, মরক্কো, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, জর্ডান ও বাহরাইনের একটি জোট কর্তৃক ইয়েমেনে আগ্রাসন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এখানে সহযোগী। ১ কোটি ৩০ লাখ গরিব ইয়েমেনির ওপর এতগুলো রাষ্ট্রশক্তির সম্মিলিত আক্রমণের পাঁচ বছর শেষ হলো। হাজার মানুষ যুদ্ধে হতাহত এবং বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। যুদ্ধের আক্রমণ ছাড়াও অভাবে, দুর্ভিক্ষে, রোগে মরছে হাজার মানুষ। সব মিলিয়ে উভয় পক্ষে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ মারা গেছে। কিন্তু সে যুদ্ধ থামার কোনো প্রচেষ্টা নেই। যুদ্ধরত সব পক্ষ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনছে। একসময় ইসরায়েল সবার সাধারণ শত্রু ছিল, এখন অঘোষিত মিত্র। এখন তারা নিজেরা একে অপরের শত্রু। শক্তিধর তুরস্ক যখন যাকে খুশি আক্রমণ করে। কুর্দি মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার যুদ্ধে তাদের কোনো অনুশোচনা নেই। মিসর ইথিওপিয়া আর সুদানকে নীল নদের পানির হিস্যা দেয় না। ওই পুরো অঞ্চলে সৌদি আরব, ইসরায়েল, তুরস্ক ও ইরান এসব বিরোধ ও প্রাণঘাতী যুদ্ধের সামনের নিয়ন্তা শক্তি, পেছনের কলকাঠি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াই নাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্য তথা পারস্য উপসাগরীয় এলাকা ও সন্নিহিত আফ্রিকা অঞ্চলে এ রকম আত্মঘাতী সংঘর্ষের কারণ খুব সহজ ও সাধারণ। বংশানুক্রমিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখা এবং সে জন্য বিনা দ্বিধায় সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগ এবং এ কাজে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক পশ্চিমা তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক-উদারপন্থি’ রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদ।

বর্তমানে প্রায় গোটা পৃথিবী করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিপর্যস্ত হলেও থামেনি দেশে দেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, জাতি ও গোষ্ঠীগত নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা সম্প্রসারণে আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ। বিশ্বে অনেক রাষ্ট্র করোনা মোকাবিলা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি সমান বা বেশি গুরুত্ব দিয়ে এখনো অস্ত্র ক্রয় করছে। মার্কিন এক টিভি প্রতিবেদনে দেখা গেল, করোনার সর্বগ্রাসী প্রভাবে সর্বত্র উৎপাদন ও কর্মসংস্থান নি¤œমুখী হলেও তাদের অস্ত্র কারখানায় উৎপাদন দ্বিগুণ এবং নতুন নিয়োগ অব্যাহত আছে। বিভিন্ন বিবদমান রাষ্ট্র এ অস্ত্রশস্ত্র প্রতিযোগিতা করেই কিনছে। অন্য একটি সংবাদ ভাষ্যে জানা গেল, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিপর্যায়ে ক্ষুদ্র অস্ত্র ক্রয়ের হিড়িক পড়েছে। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রপর্যায়ে এ অস্ত্র প্রতিযোগিতা দেখে বিস্মিত হয়ে ভাবতে হয়, বিশ্বব্যাপী এ জীবনসংহারী অতিমারি কোনোভাবেই অনেক রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে মানবতাবোধ জাগাতে পারেনি। একইভাবে পারেনি ব্যক্তি, সমাজ ও সম্প্রদায় পর্যায়েও মানবতাবোধ জাগাতে। সার্বিকভাবে মানবজাতির জন্য এটি করোনার চেয়েও অনেক বেশি বিপজ্জনক মনে হচ্ছে। করোনার প্রতিষেধক ভ্যাকসিন একদিন আবিষ্কার হবে। অমানবিক রাজনীতি ও ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে মনুষ্যত্বের বলিদান, যুদ্ধবাজি, অস্ত্র ব্যবসা নিরুৎসাহিত করার তো কোনো টিকা-ভ্যাকসিন কখনো তৈরি হবে না। মধ্যপ্রাচ্য, সন্নিহিত আফ্রিকা অঞ্চল, পারস্য, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া এবং চীনসহ অনেক দেশে জাতিগত ও গোষ্ঠীগত নিপীড়ন, ক্ষমতার রাজনীতির যূপকাষ্ঠে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নির্মম বলিদান এবং অন্য রাষ্ট্রকে আক্রমণ-প্রতি-আক্রমণ, আক্রমণে প্ররোচনা, ধর্মীয় জঙ্গিপনা, ইত্যাদি সমানে চলছে। কম করে হলেও ৪০ বছর ধরে আফগানিস্তান অশান্ত।

একটু পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৮০ সালে সাদ্দাম হোসেনের ইরান আক্রমণ দিয়ে যে প্রথম পারস্য যুদ্ধ শুরু, ১৯৮৮ সালে উভয় পক্ষের প্রায় ৬ লাখ লোকের প্রাণহানি ও অসংখ্য হতাহতের পর যুদ্ধবিরতি হয়। তারপর আবার সাদ্দামের কুয়েত অভিযান (১৯৯০), সাত মাস পর অপমানজনক সমাপ্তি। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের মিথ্যা অজুহাতে ইরাক আক্রমণ এবং সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি (২০০৬, ডিসেম্বর ৩০)। সেই ইরাক এখনো অশান্ত। ২০১০-এ শুরু হলো আরব বসন্ত। তার ধাক্কায় কেঁপে উঠল তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া, ইয়েমেন ও বাহরাইন। বেন আলি, মোবারক ও সালেহ ক্ষমতা হারান। আসাদ আর গাদ্দাফি গণঅভ্যুত্থান দমনে মরিয়া হয়ে আক্রমণ করতে থাকেন। সাদ্দামের পর পশ্চিমা প্ররোচনার দ্বিতীয় বলি হন গাদ্দাফি। তাকে নির্মমভাবে রাস্তায় পিটিয়ে মারা হয়। সেই লিবিয়ায় এখনো সত্যিকার অর্থে কোনো সরকার নেই। ২০১১ থেকে সিরিয়ায় যে গৃহযুদ্ধ শুরু, তা পরিণতিবিহীনভাবে এখন ১০ বছরে পড়ল। এরই মধ্যে সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ নিহত, হতাহত অসংখ্য এবং ৩৫ লাখ বাস্তুচ্যুত। সেই আসাদ এখনো ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে আছেন দেশের অর্ধেক অংশের সম্রাট হয়ে। কিন্তু কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাক, মহামারি-অতিমারি কি আমাদের বিবেককে আর্দ্রতাসিক্ত করবে না? আমরা জীবন যেখানে যেমন এ রকম একধরনের আত্মস্বার্থ মগ্নতায় ডুবে থাকব। পৃথিবীর কোনো অঞ্চলের মানুষ এত দীর্ঘ সময় ধরে স্বজাতি ও স্বধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিল না। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান ও তুরস্ক হয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে হত্যা, সুদীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ, গুম, খুন, নিপীড়ন থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।

পৃথিবীর ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় ধরে পবিত্র কাবাসহ সব মসজিদে জামাত বন্ধ থাকার ইতিহাস নেই। এসব ঘটনা বিবেচনায় রেখে ধর্মের দোহাই দিয়ে বিভাজনে রাজনীতি করা ও অকাতরে মানুষ মারার এ অপরাজনীতির কি কোনো ক্ষমা আছে? বর্তমান পারস্পরিক নির্ভরশীল বিশ্বে কেউ আমরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও রাষ্ট্র বিভাজনে একে অন্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি না। তাই চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষে আমরা বিচলিত। ইয়েমেনে বোমা পড়লে তা আমার গায়ে লাগে। সৌদি আরব অকাতরে বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে অস্ত্র কিনে সে অস্ত্র চালনায় আবার যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে এবং সে অস্ত্র যখন সিরিয়ার বিদ্রোহী কিংবা ইরাকের সুন্নিকে শিয়া নিধনের জন্য বা ইয়েমেনে হুতিবিরোধী যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, তখনই প্রতিবাদ করতে হয়। কারণ হাজার নিরীহ বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যে কর্মচ্যুত হচ্ছে এবং করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে শুধু সে জন্য নয়, কারণ তাতে সারা মানবজাতি বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হচ্ছে। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা অনেকটাই পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের আদর্শকেন্দ্রিক মেরুকরণের ফলে। কিন্তু সে মেরুকরণ ব্যর্থ হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই সমাজতন্ত্র পরাজিত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চীন সমাজতান্ত্রিক সরকার কাঠামোতে থাকলেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পরিণত হয়েছে এক খিচুড়িতন্ত্রে। উত্তর কোরিয়ার পরিস্থিতি আর নতুন করে হয়তো বলারও প্রয়োজন পড়ে না। সামরিক শাসন হোক, গণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ হোক, একনায়কতন্ত্র হোক, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ অথবা ইসলামি বা হিন্দুত্ব উগ্রবাদ হোক, ক্ষমতা ধরে রাখাটাই এখন শাসকদের একমাত্র উদ্দেশ্য।

যার ফলশ্রুতিতে যুদ্ধে জড়িয়ে সে ক্ষমতাকে অকারণ হুমকিতে ফেলার ঝুঁকি আগামী কয়েক দশকে কেউ নেবে বলে অবস্থা বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে না। আপাতত চূড়ান্ত কোনো মেরুকরণ তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত এই দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ চলতেই থাকবে। কিন্তু এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় লাভ হচ্ছে কার, ক্ষতিই বা হচ্ছে কার? ওবামাকে টেক্কা দিয়ে মার্কিন জনগণকে নতুন কিছু দেওয়ার ক্ষমতা রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের ছিল না। ফলে ট্রাম্প বেছে নিয়েছেন, বাইরের শত্রুকে। ওবামা প্রশাসনের স্বাস্থ্যসেবা বিল, বিশ্ব নেতাদের করা জলবায়ু চুক্তি, ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি সব ছুঁড়ে ফেলেছেন ট্রাম্প। এর আগে বুশ যেমন শয়তানের অক্ষশক্তি হিসেবে ইরান, ইরাক, উত্তর কোরিয়াকে বেছে নিয়েছিলেন, সে তুলনামূলক সহজ ধারাকেই আবার ফিরিয়ে আনলেন ট্রাম্প। ফলে মার্কিন জনগণ নিজেদের ঘরে নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ও হবেন, এমনকি ঘরের বাইরেও শত্রুতে পরিণত হচ্ছেন। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদের ঝা-ার তলে এসে তারাই আবার ‘মেইক অ্যামেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন স্লোগানে ট্রাম্পকেই ভোট দিচ্ছেন। প্রায় প্রতিটি দেশেই এখন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে ‘আমরাই সেরা স্লোগান তুলে ক্ষমতায় থাকা সহজ হলে খাওয়া-পরার চাহিদা মোটানোর কষ্টকর পথ কে বেছে নেয়! বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে- যার ধন তার ধন নয়, নেপোয় মারে দই এর অর্থটি জনগণেরও জানা, কিন্তু সঠিক প্রয়োগটি জানেন শুধু পপুলিস্ট নেতারাই তাই করোনা কালের এই দুঃসময়ে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা যুদ্ধবিবাদ নয়, জাগ্রত হোক মানবিক বোধ ।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close