আবু তাহের

  ০৫ জুলাই, ২০২০

মুক্তমত

চামড়াশিল্প রক্ষায় জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন

বিশ্বে একসময় বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ছিল। সেটা ছিল আমাদের সোনালি যুগ। সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে এ শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পের পরই দ্বিতীয় রফতানিকারক খাত হিসেবে চামড়াশিল্প শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিল। কিন্তু ধারাবাহিক একটার পর একটা বিপদ এসে পড়ছে চামড়াশিল্পের ওপর। সময়টার শুরু ছিল বেশ অনেক আগে। কিন্তু মূল আঘাত শুরু হয় ২০১৭ সালে চামড়াশিল্প হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে শিল্পনগরীতে স্থানান্তরের পর থেকে। মূলত এই স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে ক্রেতা হারাতে থাকে উদ্যোক্তারা।

মসৃণ চামড়ার উর্বরভূমি হচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া ধর্মীয় অনুশাসনের কারণেও দেশে সবচেয়ে ভালো উন্নতজাতের গবাদিপশু কোরবানি করা হয়। পবিত্র কুরবানির ঈদে আমাদের দেশে সবচাইতে বেশি চামড়া সংগ্রহ করা হয়। চামড়ার প্রায় ৬০ শতাংশই আসে এই ঈদের পশু জবাই থেকে। দীর্ঘদিন ধরে লোকসানের ঘানি টানছে এ শিল্প। এরপর বর্তমানে করোনার আঘাত রফতানি আয়ের এ খাতকে পুরো বিপর্যস্ত করে ফেলেছে।

গার্মেন্টেসের পর আমাদের অর্থনীতিতে সম্ভাবনাময় সবচেয়ে বড় খাত চামড়াশিল্প। দেশে প্রস্তুতকৃত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রায় ৯৫ ভাগই বিদেশে রফতানি হয়। চামড়া, জুতা ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি আয় ১০০ কোটি ২০ লাখ ডলার। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শুধু জুতার চাহিদা ছয় হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। বাংলাদেশের চামড়াপণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার চীন। এর পর রয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি। কিন্তু চামড়াশিল্প ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

চামড়াশিল্প ধ্বংসের কারণ হিসাবে প্রথমে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করা যায়। সাভারের চামড়া শিল্পপল্লী ঠিক না করে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের নামে যে হয়রানি করা হয়েছে, তার ক্ষতি কোনো দিন পুষিয়ে উঠা সম্ভব নয়। বিসিকের সেই ভুলের খেসারত এখন বাংলাদেশকে দিতে হচ্ছে। রফতানি ঠেকেছে তলানিতে। দীর্ঘসময়ের পালাবদলের ফলে অনেক ক্রেতাই ছুটে গেছেন। ছোট্ট একটা তথ্য বিশ্লেষণ করলে চিত্রটির স্বরূপ ধরা পড়বে। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রক্রিয়াজাত চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০৯ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের (জুলাই থেকে মে) ১১ মাসে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৯ কোটি ৮২ লাখ মার্কিন ডলারের। এই ১১ মাসে রফতানি হয়েছে ৭৩ কোটি ৯৩ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য।

সাভারের ট্যানারিপল্লী প্রসঙ্গ একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সঠিক পরিকল্পনার অভাব ছিল এটি বাস্তবায়নে। যেমন: সাভারে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণকাজ শেষ না করে হাজারীবাগের কারখানাগুলো স্থানান্তর করা হয়েছিল। এছাড়া নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ ও সময়মত গ্যাস সংযোগ দিতে না পারা ছিল ক্ষতির অন্যতম কারণ। তারপর রয়েছে লোডশেডিং, জেনারেটর ব্যবস্থা ভালো না হওয়া। এগুলোর সঙ্গে যোগ হয়েছে সাভারে ট্যানারি পল্লীতে অবকাঠামোগত সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করা। শুরুতেই এই ধাক্কা চামড়াশিল্পকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছে তা আর মেরামত করার সুযোগ নেই। ফলে অনেক ক্রেতা বাংলাদেশের চামড়া শিল্পকারখানা কমপ্লায়েন্স না থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ থেকে চামড়া নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

বিশ্ববাজারে চামড়ার চাহিদা বাড়ছে বলে বলা হয়েছে ব্রিটেনভিত্তিক পোশাক ও বস্ত্র খাতের ওয়েবসাইট ‘জাস্ট স্টাইল ডটকম’-এর একটি প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশগুলোতে গবাদি পশুর উৎপাদন সেভাবে বাড়ছে না। অন্য ফসল চাষের জন্য সেখানে গবাদিপশু উৎপাদনে পর্যাপ্ত জমি পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু পাদুকাশিল্পে চামড়ার চাহিদা বাড়ছে। এ শিল্পে মোট চামড়ার ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে নতুন প্রতিযোগী হয়ে উঠছে মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্যের কভার হিসেবে চামড়াজাত পণ্যের ব্যবহার। মোট চামড়ার ১২ শতাংশ এখন ব্যবহার করছে তারা। অন্যদিকে গ্লাভস, ওয়ালেটস, পারস, পোশাক ইত্যাদি তৈরিতে চামড়ার চাহিদা বাড়ছে। মোট চামড়ার ৩৮ শতাংশ ব্যবহৃত হয় এ খাতে।

কিন্তু এখন দেশি উৎপাদনকারীরা চাইলেও ওইসব পণ্যে বাংলাদেশি চামড়া ব্যবহার করতে পারছে না। ইউরোপের ক্রেতারা বাংলাদেশি চামড়ার ব্যবহার করার ব্যাপারে একেবারেই খড়গহস্ত। তাদের অভিযোগ বাংলাদেশের চামড়াশিল্প কারখানাগুলো উৎপাদন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অত্যন্ত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। বিকল্প হিসেবে তারা চীন এবং ভারত থেকে চামড়া সংগ্রহের পরামর্শ দিচ্ছে বাংলাদেশি পোশাক উৎপাদনকারীদের। বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে যে চামড়া রফতানি হয় তার ৪০ শতাংশই যায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে। ইইউর ২৫টি দেশে এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) কর্মসূচির আওতায় শুল্ক ও কোটামুক্ত উপায়ে চামড়া রফতানির সুযোগ পায় এ দেশের ব্যবসায়ীরা। ইইউ থেকে একবার জানানো হলো তারা আর কোনো চামড়া বা চামড়াজাত পণ্য নেবে না। কারণ হিসেবে বলা হয় বাংলাদেশের ট্যানারি কারখানার বিপর্যয়কর পরিবেশ।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্য ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এদের কারসাজিতে শিল্পটি বিপন্ন হতে চলেছে। তৃণমূল পর্যায়ে বিক্রেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার পেছনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সঙ্গে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে শিল্পমন্ত্রী বলেন, করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে চামড়াশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের লাভের কথা বিবেচনা করে কাঁচা চামড়া ও লবণযুক্ত চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হবে। এতে ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে চামড়া ক্রয় ও সংরক্ষণ করার সক্ষমতা অর্জন করবেন।

কিন্তু বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশন বিগত সময়ে এই দাম নির্ধারণের পক্ষপাতী ছিল না। বিগত বছরগুলোতে তাদের অন্যতম যুক্তি ছিল বিশ্ববাজারে চামড়ার দরপতন। কিন্তু সারা বছরজুড়ে বিশ্ববাজারে দামের তেমন হেরফের না হলেও ভরা মৌসুমে এসে আমাদের দেশে দাম পড়ে যায়। গত পাঁচ বছরে চামড়ার দাম কমেছে অর্ধেক। বিপরীতে চামড়া এবং চামড়াজাত সব পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। তাহলে কাঁচাচামড়ার দাম কমছে কেন, সেই উত্তর মিলছে না কোথাও। দেশজুড়ে চামড়া কেনাবেচায় যে দশ হাত বদল হয়, এটার সংখ্যা কমাতে হবে। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলে আরেকটু সুবিধা পাওয়া যাবে। এ জন্য সরকারকে নজরদারি বাড়াতে হবে।

চামড়া শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আরো কিছু কারণ হলো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা, হাজারীবাগে ২০৫টি কারখানা থাকলেও সাভারে মাত্র ১৫০টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া, প্লট না পাওয়া এই কারখানাগুলোর শ্রমিকদের বেকার হয়ে যাওয়া, অবৈধ পথে চামড়া পাচার, টানা কয়েক বছর ধরে চামড়া রফতানি আয় কমে যাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্যের আধুনিকায়নে সামঞ্জস্যতা না থাকা, গতবারের চামড়া এখনো প্রক্রিয়াজাত করতে না পারা। এসব নানা সমস্যার কোনটির সুরাহা না হওয়া এবং সমস্যাগুলো দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এই শিল্প দিন দিন ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কাঁচামালের সহজলভ্যতার পাশাপাশি মূল্য সংযোজনের হিসেবে কোনো একটি নির্দিষ্ট খাত থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি আয়ের অন্যতম বড় উৎস দেশের চামড়াশিল্প। কিন্তু এ সত্য শুধু কাগজে কলমেই। বাস্তবতা হলো, নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন প্রতি মাসে আমদানি করছে প্রায় ৫০ লাখ বর্গফুট চামড়া। অথচ প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত ২২ কোটি ঘনফুট চামড়ার প্রায় অর্ধেকই ব্যবহৃত হচ্ছে না রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনে। চামড়ার আন্তর্জাতিক ক্রেতাজোট লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ-এল ডব্লিউ জির ছাড়পত্র না থাকাই এর মূল কারণ। এক্ষেত্রে সাভারে নতুন শিল্পনগরী হয়তো পারতো সব সংকট সমাধানে।

এত সংকট থাকলেও সেই চামড়া আবার হাতছাড়া করতে নারাজ ট্যানারি মালিকরা। প্রতি বছর তারা চামড়া কেনার জন্য বাড়তি ঋণ দাবিও করেন। চামড়া ভারতে পাচার ঠেকাতে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের দাবিও তোলেন তারা। এ খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেক বছরই দেওয়া হয়। কিন্তু গত বছরের বেশির ভাগ ঋণই এখনো পরিশোধ হয়নি। আর যারা এ ঋণ এখনো পরিশোধ করেননি যেসব উদ্যোক্তারা নতুন ঋণ পাবেন না। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রিতে একটি চেইন আছে। ট্যানারির মালিকরা দাম কম দিলে অন্যরাও কম দিতে বাধ্য হয়। তবে ট্যানারি মালিকরা বিশ্ববাজারে ভালো দামে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য করলেও আড়তদার, চামড়া সংগ্রহকারীদের সে সুযোগ থাকে না।

বর্তমানে সারা বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের বাজার রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ মাত্র এক বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করছে। মূল্য সংযোজন ও পরিবেশবান্ধব চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পখাত থেকেই আগামী ১০ বছরের মধ্যে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি করা সম্ভব। এ উদ্যোগ দেশে ৪৪ লাখ নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি করবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জোরদার করে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে চামড়া শিল্পের অবদান দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

চামড়াশিল্পকে রক্ষা করতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। চামড়ার দাম নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধ করতে হবে। বলাবাহুল্য, সরকার যদি এক্ষেত্রে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে তবে চামড়াশিল্পের প্রবৃদ্ধি রফতানি আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দুস্থ জনসাধারণ বিশেষত ইয়াতিম ও গরিবদের প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close