নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৪ জুলাই, ২০২০

বিশ্লেষণ

জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বৃক্ষরোপণ জরুরি

করোনাযুদ্ধে জয়ী ৭০ বছর বয়সি নিউজিল্যাল্ডের এক বৃদ্ধ মহিলার হাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৫০ ডলারের একটি বিল ধরিয়ে দিলে, মহিলা কান্না শুরু করে দেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলে, কাঁদছেন কেন? এটা তো এক দিনের অক্সিজেন সরবরাহের বিল। অর্থ না থাকলে আপনাকে বিল দিতে হবে না। বয়স্ক মহিলা বললেন, বিলের জন্য কাঁদছি না। কাঁদছি এজন্য কৃত্রিমভাবে এক দিন অক্সিজেন নেওয়ার জন্য আমাকে ৫০ ডলার বিল দিতে হচ্ছে। আর আমার ৭০ বছরের এই জীবনে প্রকৃতি থেকে কত অক্সিজেন গ্রহণ করেছি, সেটার বিল তো পরিশোধ করিনি। প্রকৃতির কাছে একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিনি। একটিবারও প্রকৃতিকে ধন্যবাদ জানাইনি। এতেই বোঝা যায়, প্রকৃতি ও বৃক্ষ মানবজীবনের জন্য কত উপকারী।

পৃথিবীতে সবুজ উদ্ভিদই শুধু নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে। মানুষসহ পৃথিবীর প্রাণিকুল উদ্ভিদের তৈরি খাদ্য খেয়েই জীবনধারণ করে। শুধু খাদ্য নয়; বৃক্ষ আমাদের অক্সিজেন সরবরাহ করে। ওষুধ, বস্ত্র ও বাসস্থান জোগায়। সুশীতল ছায়া দেয়। ঝড়-ঝঞ্ঝা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে। শিল্পের কাঁচামাল ও জ্বালানি সরবরাহ করে। শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা করে। বন্যপ্রাণির খাদ্য ও আশ্রয় জোগায়। সময়মতো বৃষ্টিপাত ঘটাতে সহায়তা করে। পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে। মাটি ক্ষয় ও নদী ভাঙন রোধ করে। উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে।

একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য মোট ভূমির কমপক্ষে ২৫ শতাংশে বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের বনভূমি ও বৃক্ষ সম্পদ সমীক্ষা প্রতিবেদন-২০১৯ শীর্ষক প্রতিবেদন হতে জানা যায়, বাংলাদেশে বনের ভেতর ও বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির সাড়ে ২২ শতাংশ। বনভূমি নিয়ে নতুন সমীক্ষাটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ বনবিভাগ। এটি নিঃসন্দেহে একটি আশাজাগানিয়া সংবাদ। বাংলাদেশের গ্রামের হাটবাজারগুলোতে এখন অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর পাশাপাশি গাছের চারা বেচাকেনা হচ্ছে। এটা প্রমাণ করে যে, বৃক্ষরোপণ দেশে একটি সামাজিক আন্দোলনের পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের উপকূলীয় বনায়নের পাশাপাশি প্রতিটি অবকাঠামো প্রকল্পের মধ্যে বৃক্ষরোপণকে যুক্ত করা হচ্ছে। যেমন রাস্তা, বাঁধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানÑ সবখানে গাছের জন্য জায়গা রাখা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে বনভূমির ওপর নির্ভরশীল রয়েছে কয়েক কোটি মানুষ। এসব মানুষ বনভূমি থেকে বৃক্ষ, মাছ, মধুসহ নানা সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতি বছর বন থেকে আহরিত এই সম্পদের মোট পরিমাণ ২০ হাজার ২৯২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বনের আশপাশের অধিবাসীরা বনভূমি থেকে বছরে গড়ে ৯ হাজার ১৬০ টাকা আয় করেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় হয় সুন্দরবনের পাশের অধিবাসীদের। মূলত খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও বরিশালের প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ সুন্দরবসের ওপর নির্ভরশীল। তারা মাথাপিছু ওই বন থেকে বছরে ২৮ হাজার ৬৩৯ টাকা আয় করেন। সুন্দরবনের আশপাশের অধিবাসীরা সুন্দরবন থেকে যে আয় করেন, তার ৭৮ শতাংশ আসে মাছ থেকে। সেখানকার অধিবাসীরা সুন্দরবন থেকে মাছ ও কাঁকড়ার পাশাপাশি চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করে থাকেন। এ ছাড়া গোলপাতা ও মধু সংগ্রহ করেন তারা। সুন্দরবনের আশপাশের বসতি এলাকায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে গোলপাতাসহ নানা ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে, যা সেখানকার বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বৃদ্ধি করছে ও স্থানীয়দের আয় বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া গ্রামের মানুষ গাছকে সামাজিক বিমা হিসেবে দেখেন। গাছের বিক্রয় মূল্যের জন্য গাছ লাগানোর প্রতি মানুষের উৎসাহ বাড়ছে। বাণিজ্যিকভাবে গ্রামের মানুষ আম, লিচু, কাঁঠাল ও পেয়ারার মতো গাছ বেশি রোপণ করছেন। গত এক যুগে রাজশাহী বিভাগের বেশির ভাগ জেলা, সাতক্ষীরা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ফল বাগানের পরিমাণ দ্রুত বেড়েছে। মাঠ ফসলের চেয়ে লাভজনক হওয়ায় মধুপুর অঞ্চলের লাল মাটিতেও অনেকে গড়ে তুলছেন ফল বাগান।

১৯৬০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যে ৩৬টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে, তার মধ্যে সুপার সাইক্লোন আম্পান সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ও বিস্তীর্ণ এলাকা ধরে তান্ডব চালিয়েছে। সাতক্ষীরা থেকে খুলনা, যশোর হয়ে ফরিদপুর, রাজবাড়ী দিয়ে পাবনা হয়ে এটি রাজশাহী ও নওগাঁয় প্রবেশ করে। ঝড়ের সময় এ এলাকায় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ থেকে ১৫১ কিলোমিটারের মধ্যে এবং জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১২ থেকে ১৫ ফুট। আম্পান যেভাবে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা পেরিয়ে তীব্র গতি নিয়ে উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করেছে, তা একেবারে ব্যতিক্রম। ঝড়ে সুন্দরবনেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সুন্দরবন মায়ের মতো উপকূল অঞ্চলকে বুকে আগলে রেখে ঝড়ের তান্ডব থেকে রক্ষা করেছে বাংলাদেশকে। সুন্দর বন না থাকলে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য নগরের অবস্থা হতো কলকাতার মতো ভয়াবহ। তাই জাতীয় স্বার্থেই সুন্দরবন সুরক্ষায় আমাদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (১৬.৬.২০২০) তার সরকারি বাসবভন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কৃষক লীগ আয়োজিত সারা দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে দলের নেতাকর্মীসহ দেশবাসীকে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় বেশি করে গাছ লাগানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আসুন এই মুজিববর্ষে আমরা সবাই মিলে বৃক্ষরোপণ করে দেশকে রক্ষা করি। পরিবেশকে রক্ষা করি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। আবার আমরা নিজেরাও লাভবান হই।’ ১৯৮৪ সাল থেকে কৃষক লীগ বর্ষাকালে সারা দেশে বৃক্ষরোপণের এই কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে আসছে। অন্তত এক কোটি গাছ তো লাগাতেই হবে এবং এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে তিনটি করে গাছ লাগালে তিন কোটি গাছ লাগানো সম্ভব হবে। বৃক্ষরোপণ এখন আর কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এ কর্মসূচি এখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিবেচ্য বিষয়গুলো হলোÑ ১.বাংলাদেশে রয়েছে দেড় কোটির ওপর গ্রামীণ বসতবাড়ি। বসতবাড়ির আশপাশে বৃক্ষরোপণের জন্য রয়েছে বন্যামুক্ত উপযুক্ত উঁচু জমি। এসব জমিতে আমরা সহজেই ফলদ, বনজ ও ওষুধি গাছ রোপণ করতে পারি। দেশের গ্রামীণ রাস্তার দুপাশে রয়েছে বৃক্ষরোপণের মতো উঁচু জায়গা। এসব জায়গায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও ভূমিহীনদের মাধ্যমে দল গঠন করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ করা যেতে পারে। রাস্তার পাশে উঁচু ডালপালা ছাঁটাই করে রাখা যায়, এমন গাছপালা লাগানো উচিত। দেশের বিভিন্ন নদীর চলাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় রয়েছে বৃক্ষরোপণের জন্য প্রচুর জমি। সম্প্রতি বয়ে যাওয়া সুপার সাইক্লোন আম্পানের পর দেখা গেছে, যে এলাকায় গাছপালা ছিল, সেখানে উপকূলীয় বাঁধ ভেঙেছে কম। মানুষের বাড়িঘরেরও তেমন ক্ষতি হয়নি। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা সহনশীল গাছ, যেমনÑ সুন্দরী, গরান, গেওয়া, গোলপাতা, মান্দার, কড়ই, নারকেল, সুপারি ও তালগাছ লাগানো যায়।

ময়মনসিংহ, যশোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, নাটোর, পাবনা, নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্যিকভিত্তিতে পুকুরে মাছের চাষ করা হচ্ছে। এসব পুকুরপাড়ে মাটি ধরে রাখেÑ এ ধরনের গাছ লাগানো যায়। যেমনÑ নারকেল, সুপারি, আম্রপালি জাতের আম, নিম, পেঁপে, পেয়ারা, কলা, লেবু, জাম্বুরা, ডালিম ইত্যাদি। এ ছাড়া সারা দেশের নগরের বসতবাড়ির ছাদে আমরা পরিকল্পিতভাবে লাগাতে পারি ফুল ও ফলের গাছ এবং গড়ে তুলতে পারি সবজি বাগান। নগরের সড়কদ্বীপেও লাগানো যেতে পারে পরিকল্পিতভাবে ছোট আকৃতির শোভাবর্ধনকারী গাছ। মনে রাখতে হবে, বৃক্ষ থাকলে অক্সিজেন থাকবে আর অক্সিজেন থাকলে পরিবেশ হবে নির্মল ও সুন্দর।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close