ডা. এস এ মালেক

  ০৭ জুন, ২০২০

বিশ্লেষণ

এক দফাই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য

দফাওয়ারী আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের প্রচলন, এ দেশের রাজনীতিতে এক সাধারণ ঘটনা। খুব বেশি দিনের কথা নয়, পূর্ববাংলার জনগণ পূর্ব পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে ৫০-এর দশকে যে গণ-আন্দোলন শুরু করেছিল, তাতে ২১ দফার মাধ্যমে দাবি পেশ করা হয়েছিল। ৫৪-এর নির্বাচনে ২১ দফার কারণে মুসলিম লীগ ও তৎকালীন শাসকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিজয় অর্জন করে। কেননা ওই ২১ দফা দাবি ছিল, তখনকার পূর্ববাংলার জনগণের প্রাণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের শাসকরা তখন পূর্ববাংলার জনগণের স্বার্থকে বিকিয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে আসছিলেন। বিনিময়ে ভাগবাটোয়ার এর রাজনীতি করে তারা তখন সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়েও মুসলিম লীগের শাসন পূর্ববাংলায় কায়েম রেখেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রভাব তখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রকোট আকার ধারণ করে। স্বায়ত্তশাসন ও ভাষার প্রশ্নে গোটা দেশ যখন উত্তাল; তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ও তার সরকারের কঠোর সমালোচান করছেন, ঠিক তার পরপর ১৯৫৪-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব দিয়ে ৫৪-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। মোটা দাগে বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ৬ দফার অনেক দাবি ওই ২১ দফা সন্নিবেশিত হয়েছিল। এরপর পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটার পর একটা বিপর্যয় ঘটতে থাকে। ১৯৫৭ সালে মাত্র ১৩ জন সদস্য নিয়ে পাকিস্তানে গণতান্ত্রয়নের জন্য হোসেন মো. সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়, যার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা। তা অনুধাবন করতে পেরে ৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন। ৫৮-৬৮ এই দীর্ঘ ১০ বছর চলে পাকিস্তানে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন। ৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয় এবং ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ওই যুদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার নিরাপত্তাহীনতার কথা বিবেচনায় নিয়ে ও স্বায়ত্তশাসনের মূল দাবিসমূহ সন্নিবেশিত করে লাহোরের মাটিতে দাঁড়িয়ে তার ৬ দফা ঘোষণা করেন। আসলে ওটা ছিল পাকিস্তানভিত্তিক বিরোধী দলের একটা জাতীয় সম্মেলন। সেখানে ৬ দফার উত্থাপনটা ছিল বেশ কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনো তার সিদ্ধান্তে ভুল করেননি। কেননা ইতিপূর্বেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন করার। তাই বিরোধী দলের ওই সম্মেলনে সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানে সব বিরোধী দল যেসব রাজনৈতিক প্রশ্নের অবতারণা করেন, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের দলসমূহ কী বলতে চেয়েছিল, সেদিকে বঙ্গবন্ধু দিকপাত না করে, সুযোগ বুঝে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ও পূর্ববাংলার জনগণের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদানের দাবি নিয়েই তিনি ও ৬ দফা পেশ করেন। তাই ৬ দফার একমাত্র লক্ষ্য স্বায়ত্তশাসন, এরূপ চিন্তা একেবারেই অমূলক। বরং ৬ দফা পেশের মাধ্যমে তিনি শুধু জেনারেল আইয়ুবের সামরিক শাসনকে চ্যালেঞ্জ করেননি, বরং পূর্ববাংলার জনগণের পূর্ণ স্বাধিকার অর্জনের প্রশ্ন তুলে ধরেন। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর বৃহত্তম জনসভায় বেশ কয়েকবার হাতের আঙুলের ইশারায় জনগণকে ইঙ্গিত দেন যে, ৬ দফা নয়, দফা একটাই এর অনেক পূর্বে ৫০-এর দশকে বিশিষ্ট কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মনিসিং ও প্রফেসর মোজাফ্ফর আহম্মদসহ অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীন করার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন। অনেকে হয়তো বলবেন যে, ৭ মার্চের ভাষণেও তো তিনি একদিকে যেমন বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’Ñ ঘোষণা দিয়েছেন। অপরদিকে ৪টা দাবিভিত্তিক আলোচনা চালিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণে পূর্ণ বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। বক্তৃতার শেষ বাক্য। অনেকে হয়তো বলবেন, বঙ্গবন্ধু তো ৭০-এর নির্বাচন করেছিলেন পাকিস্তানের ৬ দফাভিত্তিক একটা সংবিধান প্রণয়ন করতে। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ভুট্ট যদি এক হয়ে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা মেনে নিতেন, তাহলে তো একসময়ে পূর্ব পাকিস্তান আর্থসামাজিক কারণেই হয়তো স্বাধীন হয়ে যেত। ৩০ লাখ মানুষকে রক্ত দিতে হতো না। রক্তপাত হয়তো কিছু হতো, কিন্তু এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করার প্রয়োজন পড়ত না। বঙ্গবন্ধু ভালো করে যানতেন, পাকিস্তানের শাসকরা কখনো তার দাবি ৬ দফা মেনে নেবে না। তাহলে তিনি ৬ দফা দিতে গেতে গেলেন কেন? বোধহয় এ কারণেই যে, ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন করে ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে তিনি প্রমাণ করবেন যে, বাঙালিরাই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে। তা না হলে সংঘাত এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং পাকিস্তানিরা সংঘাত নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, তা দ্রুত পাকিস্তানের সমাধি রচনা করবে। শুধু ৭০-এর নির্বাচনী বিজয়ী নয়, মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করলেন যে, পূর্ববাংলা শাসন করার একমাত্র অধিকার তারই রয়েছে। নির্বাচনী গণরায়ের মাধ্যমে জনগণ তাকে সেই অধিকার প্রদান করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্চ করে পাকিস্তানি শাসকদের শাসনকে অগ্রাহ্য করে তিনিে তো প্রায় ৩ সপ্তাহ স্বাধীনভাবে বাংলাদেশ শাসন করলেন। তখন পাকিস্তানের পক্ষে হয় যুদ্ধ করে কর্তৃত্ব বজায় রাখা, না হয় আত্ম সমর্পণ করে পূর্ববাংলা থেকে চিরবিদায় নেওয়া ছাড়া পাকিস্তানিদের আর কোনো গতন্তর ছিল না। কেননা, নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু বিজয়ী হয়ে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন ৬ দফার প্রশ্নে কোনো আপস নয় ও তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রত্যাশীও নন। ওখানেই আলোচনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। এর পরও পাকিস্তান ভাঙার দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেবেন না বলেই ২৫ মার্চে পাকিস্তান পূর্ববাংলা আক্রমণ করলে, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি স্বাধীনতার ডাক দেন।

সবকিছু বিবেচনায় নিলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ৬ দফায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত পথ বাতলে দেয়। যারা স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক তোলেন এমনকি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে চাননি এরূপ কাল্পনিক ধারণা যাদের বিশেষ করে মুসলিম লীগের কিছু নেতার, যে সুর ধরে স্বীধনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালান তারা শুধু রাজনৈতিক কারণেই তা করে থাকেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শাসকদের পরিকল্পনাভিত্তিক যে রাষ্ট্রটি ভারত বিভাগের কারণে জন্ম নেয়, সেই জন্মলগ্ন থেকেই কলকাতায় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন ওই স্বাধীনতা বাঙালির জন্য নয়। বাঙালিকে আবার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। ওই ধরনের মনমানসিকতা নিয়েই তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। লাহোর প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করে যে ভূখন্ড নিয়ে যেভাবে পাকিস্তানের জন্ম হলো, ওটা ছিল বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত স্বপ্নের বিপরীতে। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন করার পরিকল্পনা নিয়েই তিনি কলকাতা থেকে পূর্ববাংলা ঢুকেছিলেন। যে ৭০-এর নির্বাচনে রায়ের কারণে পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা বেজে উঠল, সেই রায়ের পেছনের প্রকৃত শক্তিই ছিল ৬ দফা। ৬ দফাভিত্তিক নির্বাচনী প্রচারাভিযান ও নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করতে না পারলে তিনি পাকিস্তানের জন্য যে মহাসংকট সৃষ্টি করলেন, তা হয়তো করা সম্ভব হতো না। ৭০-এর নির্বাচনের ব্যালট ছিল ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ব্যবহারিত অস্ত্রের মতো এক রাজনৈতিক অস্ত্র; যা ব্যবহার করে প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশের মুক্তির পথ প্রশস্ত করা হয়।

৬ দফাভিত্তিক ওই বিজয় অর্জিত না হলে ৭১-এ বাঙালির হাতে অস্ত্র উঠত না। যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আইনকানুন পালন না করায় পাকিস্তান ভেঙে গেছে। তাদের বলতে হয়, তাহলে কি গণতন্ত্র রক্ষার প্রয়োজনে পূর্ববাংলার জনগণের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে তথাকথিত সামরিক শাসক কর্তৃক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের গণতন্ত্র রক্ষার প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ সমুচিত ছিল? প্রখর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহান নেতা মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, জাতির পিতা তার রাজনৈতিক জীবনে কোথাও এ ধরনের ভুল করেননি। আর করেননি বলে তিনি বাংলাদেশের স্রষ্ঠা, জাতির পিতা এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। সুতরাং পরিশেষে এই কথা বলেই শেষ করছি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা ছিল আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। এজন্য ৬ দফা অনন্য, ঐতিহাসিক এবং বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close