আবু ফারুক

  ০৬ জুন, ২০২০

মুক্তমত

মানব পাচার রোধ সময়ের দাবি

সভ্যতার উত্তরোত্তর উৎকর্ষ ও অবাধ বিশ^ায়নের যুগে অবৈধ মানব পাচার মানবিকতার চরম লঙ্ঘন ও ঘৃণ্য অপরাধ হলেও নানা কারণে এটি এখনো অব্যাহত। বিভিন্ন সময় আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনার পর সর্বশেষ লিবিয়ায় ২৬ জনের বর্বর হত্যাকান্ডের পর আবার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। সরকারের উচ্চপর্যায় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা আগে গৃহীত পদক্ষেপের ময়নাতদন্তে ব্যস্ত। একশ্রেণির মুনাফালোভী পাচারকারী চক্রের মিথ্যা প্রলোভন ও পরিস্থিতির চাপেই মূলত অবৈধ পাচারের সূত্রপাত ঘটায়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেই সিংহভাগ পাচার করা হয়। গ্রামের অসহায় ও স্বল্প শিক্ষিত নারী-পুরুষ, জীবিকার অনিবার্য তাগিদে শহরে আসতে আগ্রহীরাই পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েন। পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া সমাজের অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্তা, বিধবা এবং স্বামী পরিত্যক্ত নারী, অনাথ শিশু-কিশোররা এবং যেকোনো উপায়ে উন্নত জীবনের মোহে অন্ধ অনেক তরুণও প্রতারণার সহজ শিকারে পরিণত হয়। ফলে বিস্তৃত হয় অবৈধ পাচারের মতো মানবতাবিরোধী গর্হিত কর্মকান্ড। প্রভাবশালী পাচারকারী চক্র উচ্চ বেতনের চাকরি, লাভজনক ব্যবসাসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে অল্প খরচে সীমান্ত পার করার কথা বলে। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে চক্রের সদস্যরা। মিছে প্রলোভন আর সুখী জীবনের আশায় আগ্রহীরা নিজেদের যৎসামান্য সঞ্চয় কিংবা ধারদেনা করে অর্থ জোগাড় করে তুলে দেয় তাদের হাতে। পরিণতিতে প্রতারণার ফলে হয় সর্বস্বান্ত।

প্রশাসন ও মাঠপর্যায়ে দায়িত্বশীলদের চোখে ধুলো দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে চলছে মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধ। পাচারকারী চক্রের সদস্যরা কেবল এক দেশেই অবস্থান করে না। পাচারের শুরু ও গন্তব্য পর্যন্ত পুরো পথেই তাদের বিচরণ। কোনোভাবে একবার লোকদের দেশের সীমানা পার করিয়ে গা ঢাকা দেয় রঙিন স্বপ্নের বিজ্ঞাপন প্রচার করা পাচারকারীরা। পরবর্তীতে একাধিকবার হাতবদল হয় পাচারের শিকার হওয়া লোকগুলো। অনিয়ম আর অবৈধ উপায়ে বিদেশে গিয়ে প্রতিশ্রুত কাজ বা ব্যবসার সুযোগ পাওয়ার পরিবর্তে করতে হয় ঝুঁকিপূর্ণ সব কাজ। পাসপোর্ট, ভিসা ইত্যাদি কাগজ ছাড়া গিয়ে সেখানকার আইনের হাত থেকে লুকিয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন। পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয় পাচার হওয়া মানুষগুলো। নয়তো ধরা পড়ে জেল খাটতে হয়। লুট হয় ভাগ্য বিড়ম্বনায় অচেনা দেশের প্রতিকূল পরিবেশে পাচার হওয়া বিভিন্ন বয়সের নারীদের জীবন ও সম্ভ্রম। শোচনীয় অবস্থায় ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কাজ করতে হয় বন্দিদশায়। অমানুষিক নির্যাতন ও অত্যাচার করে অনেককেই বাধ্য করা হয় দেহ ব্যবসার মতো ঘৃণ্য কাজেও। তাছাড়াও পাচার হওয়াদের অনেকের অনৈতিক কার্যকলাপের প্রভাবে বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম ও ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।

নারী, শিশুসহ মানব পাচারের মতো জঘন্য এ ব্যাপারটি মানবতার জন্য বিষফোঁড়া। সরকারের একার পক্ষে একে উপড়ে ফেলা একান্তই কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ। মানব পাচারবিরোধী প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী গণমাধ্যম ও সাম্প্রতিক সময়ে বহুল ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নিয়মিত জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। জনগণকে বিশেষ করে অল্প শিক্ষিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অবৈধ উপায়ে বিদেশ যাওয়ার পরিণতি সম্পর্কে পুরোপুরি সতর্ক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমাজের শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি ও সব পর্যায়ের সচেতন মানুষকে কাজে লাগানো যায়।

যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের পথ সুগম করা প্রয়োজন। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করা না গেলে অবৈধ উপায়ে বিদেশযাত্রা ঠেকানো অনেকটা অসম্ভবই। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে বাস্তবায়নযোগ্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। সর্বোপরি যেসব মাধ্যমে মানব পাচারের ঘটনা ঘটে, সেসব পথ বা সীমান্ত চিহ্নিত করে যথাযথ নজরদারির ব্যবস্থা নিলে মানব পাচার বহুলাংশে রোধ করা সম্ভব। সরকারের আন্তরিকতা ও বিভিন্ন মহলের জোর প্রচেষ্টার পরেও অবৈধ পাচার অব্যাহত থাকার অন্যতম কারণ পাচার চক্রের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনার ব্যর্থতা। বিশাল চক্রের স্থানীয় ছোটখাটো প্রতারকদের ধরে তাদের মাধ্যমে নেপথ্যের কুশীলবদের আটক করে কঠোর সাজার সম্মুখীন করতে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই হয়তো মুছবে অবৈধ মানব পাচার নামক আধুনিক সভ্যতার কলঙ্কতিলক। বেঁচে যাবে অনেক নিরীহ প্রাণ ও তাদের পরিবার।

লেখক : সহকারী শিক্ষক

ভাগ্যকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

সদর, বান্দরবান

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close