অলোক আচার্য

  ০৫ জুন, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

পরিবেশ বিপর্যয়ে হুমকিতে পৃথিবী

পৃথিবীর পরিবেশ ক্রমশই পরিবর্তিত হচ্ছে। অরণ্য উজাড় হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। সবুজ পৃথিবীটাকে মানুষ পাথুরে করে ফেলেছে। পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে দ্রুতগতিতে। বিশে^ কার্বন নির্গমন যেভাবে চলছে তা কমানো না গেলে এখন থেকে আর ৮০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ সাগরের পানির নিচে চলে যেতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে প্রসিডিংস অব দি ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস নামের জার্নালে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত এক নতুন রিপোর্টে। এর ফলে ৮০ লাখ বর্গকিলোমিটার পরিমাণ ভূমি সাগরের পানিতে তলিয়ে যাবে, এরমধ্যে থাকবে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ। এরমধ্যে থাকবে নীলনদ উপত্যকা। বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের অনেক এলাকা তখন এমন হয়ে যাবে যে সেখানে লোকজনের বসবাস খুব দুরূহ হয়ে যাবে। বাংলাদেশ ছাড়াও বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে লন্ডন, নিউইয়র্ক এবং সাংহাইয়ের মতো অনেক শহরের অস্তিত্বও হুমকির মুখে রয়েছে। কোটি কোটি লোককে এর ফলে বাড়িঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে হবে। গবেষণায় আরো বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে পৃথিবী যদি এখনকার চেয়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ হয়, কার্বন নির্গমন এখনকার মতোই চলতে থাকে, তাহলে ২১০০ নাগাদ সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বাড়বে ৬২ সেমি থেকে ২৩৮ সেমি পর্যন্ত। ২০১৩ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছিল সমুদ্রস্তরের উচ্চতা ৫২ থেকে ৯৮ সেমি পর্যন্ত বাড়তে পারে। এ নিয়ে কারো দ্বিমত থাকলেও থাকতে পারে। তবে এ কথা বলার অবকাশ নেই যে, বৈশি^ক উষ্ণতা বাড়তে থাকলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। এতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হবে। ফলে বহু মানুষ উদ্বাস্তু হবে এবং দেশের অর্থনীতি এবং বসবাসের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

দাও ফিরিয়ে এ অরণ্য, লও এ নগরÑ কবির এ উক্তিতে প্রতীয়মান যে বহুকাল ধরেই মানুষ সেই গাছপালাঘেরা সবুজ পরিবেশে ফিরে যেতে চায়। আর এই পরিবেশ হারিয়ে মানুষ বহু ধ্বংসলীলার সাক্ষী। পরিবেশ বিপর্যয়ের বহু ইতিহাস আছে যেখানে এক ধ্বংসলীলা সাক্ষী হয়ে আছে। বহু জনপদ, শহর, প্রাণিকুল তাদের অস্তিত্ব হারিয়েছে পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়ে। সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট কথাটি ইংরেজিতে বহুল প্রচলিত। সারভাইভ তারাই করবে যারা প্রকৃতির সঙ্গে তাল মেলাতে সক্ষম হবে। আর যারা পারবে না তারা হারিয়ে যাবে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতির এটাই নিয়ম। পরিবেশ বদলের এই ধারাবাহিকতায় কিন্তু আমাদের মতো নিচু দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশের ঝুঁকি সবচেয়ে ভয়াবহ। অসংখ্য জীবন ও আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও হাজার হাজার নিঃস্ব মানুষের আর্তনাদ শোনা যায়। নদী ভাঙন, বন্যা, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় বা হালের বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের সমাজের একটি বিরাট অংশের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলছে। সব হারিয়ে মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। শহরের ওপর চাপ বাড়ছে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছি আমরা। অভিযোজন শব্দটি পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পরিবেশ পরিবর্তন-সংক্রান্ত ঝুঁকি মোকাবিলায় পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযোজনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অভিযোজন হচ্ছে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপখাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা।

প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ২০১৫ সালে সম্পাদিত বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি ছিল একটি বড় পদক্ষেপ। তবে কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও সেই চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পরিবেশ বিপর্যয় এড়ানোর সম্ভাবনা ঝুঁকিতেই রয়ে গেছে। গত বছরও বৈশি^ক জলবায়ুু সম্মেলনে সব দেশ জলবায়ু রক্ষায় একমত হয়েছেন। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনতে না পারলে সত্যিই আমাদের সামনে ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করে আছে। এতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো আশাবাদী ছিল যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোকে আমরা পাশে পাব। যদিও এই জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের দেশের দায় তুলনামূলকভাবে কম কিন্তু ফল ভোগ করছি আমরাই বেশি। বিশ্বের ১৮০ দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা। যে অর্থ ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করতে পারে। কয়েক বছর ধরেই আমাদের দেশে তীব্র তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে। এ বছরও প্রচন্ড গরমে অস্থির হয়ে আছে প্রাণিকুল। অতীতের প্রায় ত্রিশ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে কালবৈশাখী, টর্নেডো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আঘাত করেছে। সেসব এলাকার অনেক মানুষ আজ গৃহহীন। পরিবেশবিদরা বলছেন, আবহাওয়ার চরিত্র দীর্ঘ অনেক বছর যাবৎ বদলাচ্ছে। ষড় ঋতুর এই দেশে এখন ছয়টি ঋতু আলাদা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। চারটি ঋতু স্পষ্ট তবে হেমন্ত আর শরৎ তো রীতিমতো নাম-গুণে বের করতে হয়। কারণ যখন যে আবহাওয়া থাকার কথা তখন তা থাকছে না। শীতের সময়ে খুব অল্প সময় শীত অনুভূত হয়। যখন গরম আসার কথা তখন শীত থাকে। অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি তো আমাদের লেগেই আছে। প্রকৃতি তার চরিত্র পাল্টাচ্ছে। আমরাও প্রকৃতির খেয়ালের সঙ্গে নিজেদের প্রস্তুত করে নিচ্ছি। কিন্তু ক্ষতি পোষাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্বের ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। আমরা মূলত এ রকম বড় বড় শিল্পোন্নত দেশের কার্বন উৎপাদনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার। তার সঙ্গে রয়েছে নিজেদের ভারসাম্যহীনতা। সব মিলিয়ে অবস্থা যে ভজঘট সেটা বোঝা যায়। আমরা পরিস্থিতির স্বীকার। কিন্তু তাই বলে বসে থাকার কোন উপায় নেই। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের কাজ এগিয়ে নিতে হবে। যদি এটা মনে করি যে এই ভূমিকা সরকার একা করবে, তাহলে এটা ভুল চিন্তা। আমরা নিজেদের উদ্যোগেও কাজ শুরু করতে হবে।

পরিবেশের বিরূপ অবস্থার সঙ্গে লড়াই করার মত পর্যাপ্ত সামর্থ আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। বিগত বছরগুলোতে আইলা বা সিডর বা নার্গিসের মতো প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির দিকে তাকালে সহজেই আমরা তা অনুমান করতে পারি। আজও সেসময়কার ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের সে দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সংগ্রামের রেশ থামতে না থামতেই আবারো নতুন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের উৎপত্তি হচ্ছে। নিত্যনতুন নাম আর ভয়ংকর চেহারা নিয়ে আমাদের সাজানো গোছানো সংসারকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যাচ্ছে। যখনই সংকট সামনে এসেছে তখনই আমরা এ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি। তারপর ধীরে ধীরে সেই বিষয়টা আমরা ভুলতে থাকি। শুধু সেসব মানুষের মনে দাগ থেকে যায় যারা এর শিকার হয়েছে। বহু বছর তারা এর ক্ষতচিহ্ন বহন করে। তারপর যখন সবকিছু কাটিয়ে উঠে দাঁড়ায় তখন হঠাৎ আবারো কোনো নতুন দুর্যোগের কবলে পরে। সারা বিশ্বের পরিবেশ রক্ষা নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় তাদের কর্মসূচি দিয়ে আমাদের সচেতন করে চলেছে। আমরা কিন্তু নিজেরাও সমস্যার প্রকৃতি সম্পর্কে বুঝতে পারছি কিন্তু তাতে আমরা কতজন সচেতন হচ্ছি? সেই তো আমরা মেতে আছি পরিবেশ ধ্বংসের খেলায়। বুঝতেও পারছি না কি ঘোরতর বিপদ আমরা ডেকে আনছি। আমরা যে দেশে বসবাস করছি, যে নদীর জল পান করছি, যে গাছের ছায়ায় নিজেকে শীতল করছি সেই দেশটার পরিবেশ রক্ষা করার না চেষ্টা করে উল্টো বিভিন্নভাবে তা ধ্বংস করছি। এর ফল তো আমাদের দিতেই হবে।

সর্বশেষ ফণী, সিডর, খাইমুর, নার্গিস, আইলার মহাসেন মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। সেসব ক্ষয়ক্ষতি কাটাতে বছরের পর বছর সময় লেগে যাচ্ছে। এর ভেতরেই নতুন নতুন দুর্যোগ হানা দিচ্ছে। ২০১৭ সালে বজ্রপাতেই মারা গিয়েছিল ১৪২ জন। যার সংখ্যা দুই দিনেই ছিল ৮২ জন। এ রকমটা অতীতে দেখা যায়নি। তাই বজ্রপাতও নতুন দুর্যোগ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন সময় প্রচুর মানুষ মারা গেছে। ১৯৭০ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। আর পার্শ্ব ক্ষয়ক্ষতি তো ছিল আরো ভয়ংকর। ১৯৯১ সালের ঝড়ে প্রায় দেড় লাখ লোক নিহত হয়েছিল। তাছাড়া ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালের বন্যাতেও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম ভূমিকম্প। যা মোকাবিলা করার শক্তি আমাদের একেবারেই অপর্যাপ্ত। আমরা যখন পরিবেশ ধ্বংস করি তখন এই কথা মাথায় নেই না। কিন্তু প্রকৃতি তার নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজেই নেয়। যখন আমাদের ধ্বংসলীলা সীমার বাইরে চলে যায় তখন প্রকৃতিতে দুর্যোগ নেমে আসে। সমস্যা হলো সেই দুর্ভাগ্যের শিকারের মধ্যে কিছু অসহায় মানুষও পড়ে যায়। যারা এর ক্ষত বছরের পর বছর বহন করে চলে। আর সেই ক্ষত মোছানোর জন্য কেউ থাকে না। তাই নিজস্ব উদ্যোগে পরিবেশ রক্ষাই হোক আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Email- [email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close