রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৫ জুন, ২০২০

বিশ্লেষণ

করোনা বনাম অর্থনীতি

পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গভীর অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। চরম বেকারত্ব, দারিদ্র্য, মন্দার মতো নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে। জি-টোয়েন্টি গোষ্ঠী সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছে। করোনা সংকটের ফলে অর্থনৈতিক সংকটের নানা দৃষ্টান্ত ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এবার বিশ্বব্যাংক বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ দুশ্চিন্তা প্রকাশ করল। চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাপক মাত্রায় কমে যাবে বলে বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা করছে। সেই মন্দার জের ধরে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যেতে পারে। ২০১৯ সালে গড় প্রবৃদ্ধির মাত্রা যেখানে পাঁচ দশমিক আট শতাংশ ছিল, চলতি বছর তা কমে দুই দশমিক এক শতাংশ ছুঁতে পারে। করোনা সংকটের মেয়াদ সম্পর্কে এখনো কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে ওষুধ অথবা টিকার মাধ্যমে করোনার মোকাবিলা করা সম্ভব হলে অর্থনীতি আবার চাঙা করে তোলার প্রচেষ্টা সফল হতে পারে। কিন্তু এই সংকট আগামী বছর পর্যন্ত গড়ালে তার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক। আপাতত শুধু এশিয়া সম্পর্কে পূর্বাভাস দিলেও ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের পরিস্থিতিও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তবে এশিয়ার করুণ পরিস্থিতি যে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, যে মন্দা শুরু হয়ে গেছে। সম্পদ দখল নিয়ে দৃশ্যমান আর অদৃশ্য যুদ্ধের মধ্য দিয়েই পৃথিবী চলছিল। যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একটা সম্ভাব্য মন্দা নিয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ সবাই সতর্ক বার্তা দিচ্ছিল।

কিন্তু এক নিমিষেই তা থেমে গিয়ে বিশ্ব লিপ্ত হলো করোনাভাইরাসের সঙ্গে অন্যরকম এক যুদ্ধে। এ স্রেফ যুদ্ধ নয়। পরিণতিতে এটি বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে ভিনগ্রহীরা যেন পৃথিবী আক্রমণ করেছে। মানুষ দিশেহারা। এখন সব দেশ যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিতে বাধ্য হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সেই যুদ্ধে যুক্ত হয়েছে আমাদের দেশও। এর বিস্তৃতি আরও কত ভয়াবহ হবে তা করোনাভাইরাস বিস্তারের ওপর নির্ভর করছে। যুদ্ধ অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে আসে। মন্দার ভয়াবহতার ছবি আছে এরিক মারিয়া রেমার্কের উপন্যাস দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্কে। মানুষ বাজারে পণ্য কিনতে যায় ভ্যানভর্তি টাকা নিয়ে। কারণ, উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ায় শুরু হয় পণ্য স্বল্পতা। এর সঙ্গে অতি মুদ্রাস্ফীতি। করোনাবিরোধী চলমান যুদ্ধ এরই মধ্যে মন্দা তৈরি করেছে। এখন এটি মহামন্দায় যাবে কি না, সেটা মানুষের দক্ষতার ওপর নির্ভর করছে।

মন্দার পালে জোরেশোরে হাওয়া লেগেছে আমাদের দেশেও। প্রায় সবরকম উৎপাদন বন্ধ। ঘরে বসে রয়েছে কোটি কোটি লোক। এখন পর্যন্ত ৭৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক উদ্ধার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এর অবয়ব আরও বাড়বে যদি রোগের বিস্তৃতি না থামে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোথা থেকে আসবে এত টাকা। নগদ টাকার প্রবাহ বাড়ানোর জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের সিআরআর কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিবিপিআর-এর ওপর সহজে হাত দেয় না। কারণ এটা হচ্ছে সব ধরনের আমানত ও ঋণের সুদের ভিত্তি হার। আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটা হয়তো চার-পাঁচ বছরে একবার পরিবর্তন করে। কিন্তু ১৮ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দুই দফা কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ করেছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য।

এতে কম খরচে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা পাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। মজার বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিবিপিআর কমাতে কমাতে এখন শূন্য শতাংশে নিয়ে এসেছে। তার পরও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। এটা অনেকটাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পরিস্থিতির সহসা উত্তরণ না হলে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সিবিপিআর আরও কমাতে হবে। সমস্যা আরও আছে, রফতানি আয় আর রেমিট্যান্সে ধস নামা শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপ লকডাউনে। তারা আমাদের রফতানি করা পণ্য কেন কিনবে। তেলের দাম ব্যাপকভাবে পড়ে গেছে, কারণ বিশ্বের কোথাও তেমন কোনো অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হচ্ছে না। ফলে তেলনির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিও স্থবির। ওই অঞ্চলের দেশগুলো এখন নির্মমভাবে শ্রমিকদের ফেরত পাঠাচ্ছে। এপ্রিলের প্রথম ১০ দিনে সৌদি আরব দুই হাজার ৯২৮ জন ইথোপিয়ান শ্রমিককে ফেরত পাঠিয়েছে। ইথোপিয়া থেকে গরুর মাংস বহনকারী ফ্লাইট গিয়েছিল সৌদিতে। ওই বিমানে শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। হয়তো আমাদের প্রবাসীদের জন্য এই ধরনের বিপদ অপেক্ষা করছে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতি সংকটে পড়তে পারে এবং একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। এখন পর্যন্ত সরকার যেসব প্যাকেজ নিয়েছে, এর অধিকাংশই কার্যকর হবে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর। কিন্তু গরিব মানুষ আপৎকালীন খাবার পাবে কোথায়। ওএমএস-এর চাল দিয়ে তো সারা দেশের সংকট মেটানো যাবে না। ফলে গ্রাম-ইউনিয়ন পর্যায়ে দ্রুত খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। যদি তা করা না হয়, ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হবে।

ইউরোপের অন্যতম পাওয়ারহাউস ইতালিতে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেখানে পুলিশি পাহারা বসাতে হয়েছে সুপারমার্কেট রক্ষা করার জন্য। যদি মানুষ খাবার না পায়, আমাদের দেশের অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলোতে হামলা হবে। কেউ এ থেকে রেহাই পাবে না। সংকটের শেষ এখানেই নয়। ইতোমধ্যে পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। যেহেতু মানুষ টাকা খরচ করছে না, ফলে অধিকাংশ পণ্যের দাম কমবে। খাবার আর ওষুধ ছাড়া অন্য কোনো সামগ্রী এই মুহূর্তে কেউ কিনবে না। অবশ্য এসব দোকানও বন্ধ। এক কথায় চাহিদা ব্যাপকভাবে কমতে পারে। যেকোনো মন্দার সময় এটাই হয়। ফলে ওই ধরনের পণ্য উৎপাদনকারী কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তখন ইনফ্লেশন হয় না, বরং ডিফ্লেশনের ঝুঁকি তৈরি হয়। আর যদি সত্যি সত্যি তা হয়, তাহলে দুর্ভিক্ষ লেগে যায়। ফলে টাকা ছাপিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প থাকে না। লকডাউন উঠে যাওয়ার পরও আমাদের জন্য খুব একটা সুখপ্রদ দিন আসবে না। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, এই বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশে নেমে আসবে। কৃষি, রেমিট্যান্স আর পোশাক রফতানিÑ এই তিন খুঁটির জোরে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু গত চার মাসে সারা বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি আকারে দেখা দেওয়ার পর বৈশ্বিক জীবনপ্রবাহ স্তব্ধ হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৮০ লাখ থেকে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। যারা আগে দরিদ্র ছিল তারা হতদরিদ্র হয়ে যাবে। সুতরাং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি যে বলছে দুর্ভিক্ষ হবে, তা অহেতুক নয়। তারা ভবিষ্যৎ বাণী দিচ্ছে যে, অনাহারে তিন কোটি মানুষ মারা যেতে পারে।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশ নিজস্ব উদ্যোগ গ্রহণ করে চলছে। এখন কেউ কারো দিকে চেয়ে থাকার সময় নেই। গত চার মাস বিশ্বব্যাপী লকডাউন ছিল। তাই বিশ্বব্যাপী জীবনপ্রবাহ থেমেছিল। আরও কয়েক মাস এভাবে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলে বিশ্ব পরিপূর্ণভাবে অচল হয়ে যাবে। বিশ্বের জীবনসুধা হলো তার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আর বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। বাজার ব্যবস্থাকে তালাবদ্ধ করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়। সবাই তো লকডাউনে বসা। কদিন রাষ্ট্র ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছাবে? হাতে যা কিছু আছে তা তো অফুরন্ত নয়। বসে থাকলে অনাহার সমগ্র সমাজকে গ্রাস করবে। বিশ্বব্যাপী হানাহানির দরজা খুলে যাবে। করোনার মতো আরও বহু মহামারি বিশ্বে এসেছে কিন্তু বিজ্ঞানের চূড়ান্ত বিকাশের যুগে এভাবে লকডাউন বলে ঘরে বসে থাকা কোনো সঠিক কাজ নয়। প্লেগের সময়, স্পেনিশ ফ্লুর সময় কোটি কোটি মানুষ মরেছে আর তখন জীবনপ্রবাহও সমান্তরালভাবে চলেছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা বুদ্ধিমান জীব। মানুষের হাতে সবকিছু পরাজিত হয়েছে অতীতে। ভবিষ্যতেও পরাজিত হবে।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে দক্ষ বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন। আমরা এত দিন দক্ষ স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে কোনো খেয়াল করিনি। করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে আমাদের দক্ষ স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে নজর দিতে হবে। এখন আমরা বুঝি যে খাদ্য সুরক্ষা যেমন প্রয়োজন স্বাস্থ্য সুরক্ষাও অনুরূপ প্রয়োজনীয় বিষয়। এখন অর্থনীতিতে মনোযোগ দিতে হবে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো প্রদত্ত তথ্য অনুসারে গত এপ্রিল মাসে বিভিন্ন খাতে রফতানি আয় হয়েছে মাত্র ৫২ কোটি ডলার। অবশ্য একই মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এসেছে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। বাংলাদেশে রফতানি আয় রেমিট্যান্সের কমÑ এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এই মহামারির প্রভাব শুরু হওয়ার আগের যেকোনো মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সব সময়ই রেমিট্যান্সের চেয়ে আড়াই-তিন গুণ বেশি বিদেশি মুদ্রা এসেছে পণ্য রফতানি করে। কিন্তু সারা বিশ্ব করোনায় বিধ্বস্ত। সুতরাং রফতানি আয় কমবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের পোশাকের ৮০ শতাংশ যায় ইউরোপ আর অবশিষ্ট অংশ যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। উভয় বাজার করোনায় আক্রান্ত তবে লকডাউন সব দেশই শিথিল করছে। গ্রীষ্মের মৌসুম এসেছে। এখন গ্রীষ্মের কাপড় প্রয়োজন হবে। চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া তাদের রফতানি পোশাকের কারখানা খুলেছে। সুতরাং বাংলাদেশ তার পোশাক কারখানা না খুললে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাজার হারাবে। তবে এসব ব্যাপারে সঠিক চিন্তাভাবনা এবং সামগ্রিক বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞ মহলের।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close