আবু আফজাল সালেহ

  ০৩ জুন, ২০২০

পর্যালোচনা

রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই ভরসা

ইতোমধ্যে সাধারণ ছুটি দুই মাস পেরিয়ে গেছে। করোনা দুর্যোগে মানুষজন এমনিতেই খুব কষ্টে আছে। অনেক দিন থেকে মানুষজনকে ঘরে থাকার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। একদিকে হাঁফিয়ে উঠছি আমরা। আবার অর্থনৈতিক ধ্বসও নামতে শুরু করেছে। একদিকে জীবন; অন্যদিকে জীবিকা। সরকার দোটানায় পড়েছে। উন্নত দেশের মতো অনেক দিন ধরে লকডাউন কার্যকর রাখা আমাদের জন্য কঠিন। আমেরিকাসহ ইউরোপের অনেক দেশ করোনার পিক পর্যায়ের মধ্যেও লকডাউন তুলে নিতে মত দেন অনেকে। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বেশি দিন লকডাউন রাখা কঠিন হয়ে যাবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক পেশার লোকেরা খুবই অমানবিক জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। স্কুল-কলেজ বন্ধ। শিশুরা ঘরে থেকে ধৈর্যশক্তি হারিয়ে ফেলছে। লকডাউন কেউ মানছেন, কেউ কেউ মানছেন না।

ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো ও চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসের আক্রান্তের হার বেশি। তার পরও গার্মেন্টস খুলে দিতে হলো। এটা না হলে আমাদের বাজার নষ্ট হবে বলে আশঙ্কা ছিল। বিশ্ববাজারে একবার বাজার হারিয়ে ফেললে তা ফিরে পাওয়া কঠিন। কল-কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। শর্ত দিয়ে ও সীমিত আকারে শপিং মল-দোকান খুলে দেওয়া হয়েছে। জীবন ও জীবিকা একসঙ্গে চলতে দিতে সরকারের এ পথ বেছে নিতে হয়েছে। সরকারকে দুটিই ভাবতে হয়। দুটিকে একসঙ্গে চলতে দিতে সরকার বিধিনিষেধ আরোপের পাশাপাশি শিথিলতাও এনেছে। ৩১ মে থেকে ১৫ দিনের জন্য বলা যেতে পারে পরীক্ষামূলক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সব অফিস খুলে দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি গণপরিবহনের চাকাও ঘুরবে। উভয় ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আছে। কিছু বিষয় প্রতিপালন করার কথা বলা হয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এত সব নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব নয়। তাই বিকল্প চিন্তা করতেই হবে। এখন আমরা তিনটা বিষয়ের ওপর জোর দিতে পারি। প্রথমত, ‘সামাজিক দূরত্ব’ বা ‘নিরাপদ দূরত্ব’ বজায় রাখা। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। তৃতীয়ত, শরীরে রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা জোরদারকরণ। রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা জোরদারকরণই এখন প্রধান ভরসা।

আক্রান্তদের মধ্যে আনুপাতিক হারে বয়স্করা বেশি মারা যাচ্ছেন। কারণ বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কম। শিশুদের বিভিন্ন টিকা দেওয়া হয়। তাই তাদের দেহে প্রতিরোধক ক্ষমতা কিছুটা বেশি। তাই করোনাভাইরাসে বিশ্বে শিশুদের মৃত্যুহার তুলনামূলক কম। করোনাভাইরাসের প্রকোপ অনেক দিন থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন। এত দিন লকডাউনের মতো ব্যবস্থা কার্যকর রাখা কঠিন। এতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নষ্ট হচ্ছে। ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার পাশাপাশি তাই বিকল্প ভাবার সময় এসেছে। এ ক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে দেহে রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থার উন্নয়ন। প্রতিরক্ষাতন্ত্র বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ওসসঁহব ংুংঃবস) হলো বিভিন্ন জৈবিক কাঠামো সহযোগে গঠিত জীবদেহের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা; যা জীবদেহকে আক্রমণকারী রোগব্যাধির বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। দেহে এটি এক জটিল প্রক্রিয়া। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যত কার্যকরী হবে দেহে; ততই শক্তিশালী/স্বাস্থ্যবান হবে।

রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সঙ্গে সব সময় যুদ্ধ করে ইমিউন সিস্টেম। বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাশ, পরজীবীর সঙ্গে লড়াই করে। এ সিস্টেম দুর্বল হলে দেহে সহজেই বিভিন্ন জীবাণু বাসা তৈরি করতে পারে। ইমিউন সিস্টেমকে রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করার জন্য অন্যতম সহজ উপায় হচ্ছে নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস। এটি হচ্ছে নিজেকে, পরিবারের সদস্যকে ও নিজের বিচরণ-আওতার মধ্যে থাকা অন্যান্য লোককে সুস্থ রাখারও সেরা উপায়। হ্যান্ডওয়াশ বা সাবান ব্যবহার করে হাত পরিষ্কার করে রাখা যায়। তাছাড়া অ্যালকোহল-বেসড হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করেও হাত জীবাণুমুক্ত রাখা যায়। খাবার তৈরি ও পরিবেশনের আগে, বাথরুম ব্যবহারের পরে ও জীবাণু থাকতে পারে এমন কিছুর সংস্পর্শে এলে হাত ধুয়ে নিতে হবে।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধের অন্যতম ধাপ হলো প্রত্যেকের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। ইমিউন সিস্টেম বাড়িয়ে তোলা। করোনাভাইরাস সংক্রমণ মারাত্মক। এতে শ্বাসযন্ত্র এবং পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণ হয়। সেগুলো সহজে প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেকোনো ভাইরাস হলো প্রোটিনযুক্ত অণুজীব, যার কারণে মানুষ জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট এমনকি মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। তা ছাড়া এই ভাইরাস ভয়ংকর প্রাণঘাতী রোগ তৈরি করতে পারে খুব সহজে। তাই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেশি পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে প্রতিদিন। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হলো শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়ে শরীরে জীবাণু সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই করে ঝুঁকি প্রতিরোধক করতে সহায়তা করে। প্রধান অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলো হলো বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন এ, সি, ই, লাইকোপেন, লুটেইন সেলেনিয়াম ইত্যাদি। উজ্জ্বল রঙের ফল, সবজি যেমন গাজর, পালংশাক, আম, ডাল ইত্যাদি বিটা ক্যারোটিনযুক্ত খাবার। গাজর, পালংশাক, মিষ্টিআলু, মিষ্টিকুমড়া, জাম্বুরা, ডিম, কলিজা, দুধজাতীয় খাবারসহ ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাবার। ভিটামিন-ই সমৃদ্ধ খাবার কাঠবাদাম, চিনাবাদাম, পেস্তাবাদাম, বাদাম তেল, বিচিজাতীয় ও ভেজিটেবল অয়েল, জলপাইয়ের আচার, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি। এগুলো আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে।

প্রোটিন শরীরের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা বাড়ায়, রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি জোগায়। ডিম, মাছ, মুরগির মাংস, ডাল থেকে পেতে পারেন প্রোটিন। তবে লাল মাংস এড়িয়ে যেতে হবে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন-সি দারুণ কার্যকর। ভিটামিন-সি আছে আমলকী, লেবু, কমলা, সবুজ মরিচ, করলা ইত্যাদি ফলে। পরিচিত ফল পেয়ারায় প্রচুর ভিটামিন-সি আছে। ভিটামিন-সি মানবদেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট। ভিটামিন-সি ত্বক, দাঁত ও চুল ভালো রাখতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। আমাদের শরীর ভিটামিন-সি জমা করে রাখতে পারে না। তাই প্রতিদিন ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। পূর্ণবয়স্ক পুরুষের দৈনিক ৯০ মিলিগ্রাম এবং নারীর ৮০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি দরকার। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও রোগ থেকে দ্রুত সেরে উঠতে ভিটামিন বি-১২ দারুণ কার্যকর। বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাবার ও ডিমে ভিটামিন বি-১২ পাওয়া যায়। শরীরে জিঙ্কের ঘাটতি হলে রক্তে শ্বেতকণিকার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। ফলে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। বাদাম, শিম, দুগ্ধজাত পণ্যে জিঙ্কের পরিমাণ বেশি থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে জিঙ্কের পরিমাণ কমে গেলে তারা বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। পাশাপাশি সব ধরনের কার্বনেটেড ড্রিংকস, বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, তামাক, সাদাপাতা, খয়ের ইত্যাদি হতে দূরে থাকতে হবে। এগুলো রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতায় বাধা দিয়ে ফুসফুসে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। ঠান্ডা খাবার, আইসক্রিম, চিনি ও চিনির তৈরি খাবার পরিহার করতে হবে। এ রকম খাবার সব রকমের ভাইরাসের সংক্রমণে সহায়তা করে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তবে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হলে ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।

করোনা মোকাবিলায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা শরীরের ইমিউনিটি বাড়াতে খাদ্যাভ্যাসে বদল আনতেই হবে। কী খেলে করোনা হবে না বা কীভাবে থাকলে করোনার কবল থেকে মুক্ত হওয়া যাবে, তা নিয়ে চিন্তিত সবাই। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে এ ধরনের ওষুধের চাহিদাও এখন তুঙ্গে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদেরই পরামর্শ, এ সময় প্রোটিনযুক্ত খাবার খেয়ে শরীরের ইমিউনিটি বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু সেটা করলেই যে করোনাভাইরাস ছোঁবে না, এ রকম ভাবারও কোনো কারণ নেই। তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকলে মোকাবিলা করা যাবে যেকোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে। বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাটজাতীয় খাবার সামঞ্জস্য রেখে খেতে হবে। বিশেষজ্ঞদের কথায়, টক দই শ্বাসযন্ত্র ও গ্যাস্ট্রোইনটেসটিন্যাল সংক্রমণের ঝুঁকি প্রতিরোধ করে। সবুজ শাকসবজিতে রয়েছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা; যাতে রয়েছে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, মিনারেল ও ফাইবার; যা খুবই উপকারী। টকজাতীয় খাবার নিয়মিত খেতে হবে। এতে আছে ভিটামিন-সি; যা সর্দি, কাশি, জ্বরের ক্ষেত্রে খুবই উপকারী। শরীরের উপকারী শ্বেতরক্তকণিকা তৈরি করতে সাহায্য করে ভিটামিন-সি। রসুনে আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট; যা ঠান্ডা লাগা ও ইনফেকশেন দূর করতে খুবই উপকারী। বিভিন্ন খাদ্যোপাদানের মধ্যে সুষম থাকতে হবে। শরীরের পক্ষে সব থেকে উপকারী হলো দিনে যত বেশিবার খুশি গরম পানি পান করতে হবে।

খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের পাশাপাশি কিছু কৌশলগত বিষয় বা স্বাস্থ্যবিধি আছে; সেগুলো মেনে চললে ইমিউনিটি সিস্টেম পজিটিভ উন্নতি করা যায়। ধূমপান না করা। অ্যালকোহল সেবন না করা। পরিমিত ব্যায়াম করতে হবে। শারীরিক ব্যায়াম সুস্থ দেহের জন্য অন্যতম উপায়। কোষ ও রক্তের বিভিন্ন সার্কুলেশন ঠিক রাখে। ফলে ব্যায়াম ইমিউনিটি সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। ব্লাডপ্রেসার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পর্যাপ্ত ঘুমের ব্যবস্থা করতে হবে। বয়স্কদের নিয়মিত চেকআপ করতে হবে।

কিছু মানুষের জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এর ফলে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অর্গান বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। খুব কম ক্ষেত্রেই এই রোগ মারাত্মক হয়। তবে এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বয়স্ক ও আগে থেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। যাদের আগে থেকেই হৃদযন্ত্রের সমস্যা, ডায়াবেটিস, শ্বাসতন্ত্রের অসুখ এবং উচ্চরক্তচাপ রয়েছে তারা এই ভাইরাসে সহজেই সংক্রমিত হতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে করোনাভাইরাসে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকলে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিহত করা যায়।

কোভিড-১৯ প্রবলবেগে বিস্তার লাভ করছে। স্বাস্থ্যবিধি মানছি কম। লকডাউন আর কত দিন রাখা যাবে? সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সঙ্গে বিকল্প কিছু করার সময় এসেছে। কত দিন এ মহামারির প্রকোপ থাকবে, তাও জানা নেই। আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পনা শুরু করে দিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নীতি মেনে চলার পাশাপাশি এ-সংক্রান্ত কাজ আমাদের করতেই হবে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close