রায়হান আহমেদ তপাদার

  ৩১ মে, ২০২০

পর্যালোচনা

চরম ঝুঁকিতে এশিয়ার অর্থনীতি

করোনাভাইরাস এখন শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, সারা বিশ্বের অর্থনীতিকেই নাড়া দিতে শুরু করেছে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে হাজারো মানুষ। লকডাউন হয়ে পড়েছে প্রতিটি রাষ্ট্র। ফলে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, করোনা আতঙ্কে অধিকাংশ বড় কোম্পানির কারখানায় উৎপাদন স্থগিত রাখা হয়েছে। এভাবে উৎপাদন বন্ধ থাকলে বিশ্ববাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে।

করোনা আতঙ্কে একের পর এক বিচ্ছিন্ন হতে শুধু হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বন্ধ হয়ে পড়েছে মাঠের খেলা থেকে শুরু করে বড় বড় সব আন্তর্জাতিক আয়োজন। স্কুল-কলেজ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমে আসছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞার কারণে লোকসানে পড়েছে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলো। বন্ধ হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ফ্লাইট। ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার আশংকায় রয়েছে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিদিনই ধস নামছে প্রধান শেয়ার বাজারগুলোতে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে চাকরি হারাতে পারেন অসংখ্য মানুষ। জেপি মর্গানের মতে পরপর আগামী দুই প্রান্তিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দেবে করোনার প্রভাবে। চলতি বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১৯ সালের চেয়ে অর্ধেক কমে যাবে, জানিয়েছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা বিশ্ব অর্থনীতিতে ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের লোকসান ঘটাবে, যা গোটা যুক্তরাজ্যের জিডিপির সমান।

এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান মন্দায় পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। ২০০৩ সালেও পৃথিবীতে আতঙ্ক তৈরি করেছিল সার্স। চীন থেকে বিস্তৃত হয়েছিল সার্স। সার্সে আট হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল, মারা গিয়েছিল ৭৭৪ জন। সেই সময়ে বৈশ্বিক জিডিপির ৪ শতাংশ আসত চীন থেকে। তখনই বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্তত ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয় বলে অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা জানিয়েছেন, চীনের করোনা বিশ্ব অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এতে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘিœত হচ্ছে এবং পর্যটন খাতেও প্রভাব পড়ছে। আইএমএফ প্রধান বলেন, স্বল্পমেয়াদে হলেও করোনা বিশ্ব অর্থনীতির গতি মন্থর করতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে কী হবে, তা এখন বলা কঠিন। যত দ্রুত সম্ভব এ ভাইরাস মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকাশক্তি রফতানি ও রেমিট্যান্স। রফতানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্পকারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। অন্যদিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে তাদের পরিবার দেশে আগের মতো খরচ করতে পারবেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা বাণিজ্যে। কমে যাবে বেচাকেনা। চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে। করোনাভাইরাসের ধাক্কায় গত ৬০ বছরের মধ্যে এ প্রথম থমকে গেছে এশিয়ার অর্থনীতি। অপ্রত্যাশিত ক্ষতির মুখে পড়েছে এ অঞ্চলের রফতানি ও সেবা খাত। এশিয়া-প্যাসিফিকি নিয়ে এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানায় আইএমএফ।

এমনকি করোনা সংক্রমণের জেরে উল্লেখযোগ্য হারে কমবে ভারতীয় আর্থিক বৃদ্ধির হর, জানাল বিশ্বব্যাংক। এর আগে ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৫ থেকে ৫ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস করেছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু সংকটের প্রভাবে তা মাত্র ১ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে জানিয়েছে সংস্থা। করোনা সংক্রমণের জেরে ধাক্কা খাবে ভারতের আর্থিক উন্নয়ন, পূর্বাভাস করল বিশ্বব্যাংক। সংস্থার দাবি, চলতি বছরে মাত্র ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশ হারে উন্নয়ন হবে ভারতীয় অর্থনীতির, যা গত চার দশকে নি¤œতম। শুধু ভারত নয়, মহামারীর দাপটে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশেই আর্থিক সংকট ঘনীভূত পবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক বিকাশ রিপোর্টে সংস্থা জানিয়েছে, ২০১৯ সালের শেষে যে ঘুরে দাঁড়ানোর আশা জাগিয়েছিল অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সংকটের প্রভাবে তা তলানিতে ঠেকেছে। এর আগে চলতি অর্থবর্ষে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে গণ্য ভারতে উন্নতির হার ৪ দশমিক ৫ থেকে ৫ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস করেছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু সংকটের প্রভাবে তা মাত্র ১ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে জানিয়েছে সংস্থা। ভারত ছাড়া করোনার প্রকোপে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশেও অর্থনীতি বেহাল হবে বলে পূর্বাভাস করেছে সংস্থা। এছাড়া পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপে সংক্রমণের জেরে আর্থিক মন্দা দেখা দেবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার সরবরাহ ব্যবস্থায় ছন্দপতন ঘটেছে। ভারতে দেশজুড়ে লকডাউন আরোপের ফলে বে-রোজগেরে হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ নাগরিক, জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

তাছাড়া লকডাউন প্রলম্বিত হলে আর্থিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর জেরে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় আর্থিক সংকোচন দেখা দেবে বলে জানানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত সংকট মোকাবিলায় ২৩০ কোটি ডলার মূল্যের আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে ভারেতের কেন্দ্রীয় সরকার। লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েক কোটি দরিদ্রকে সাহায্য করতে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি নগদ জমা দিতে গিয়ে চাপ পড়েছে কেন্দ্রীয় কোষাগারে। দক্ষিণ-পূব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি কঠিন সতর্কবার্তা দিয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। তারা বলছে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রায় ৫০০ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে এবং প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সংস্থাটির আঞ্চলিক পরিচালক ড. পুনম ক্ষেত্রপাল সিং বলেন, পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। ভাইরাস যেন আরো মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে না পারে তা নিশ্চিত করতে আমাদের অতিসত্বর কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। তিনি বলেন, বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এটি যদিও একটি ইঙ্গিত যে ভাইরাস সংক্রমণ বিষয়ক নজরদারি কার্যকরভাবে হচ্ছে, তবে কোভিড-১৯ প্রতিহত করতে যে আমাদের আরো জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে সেটিও স্পষ্ট। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে শনাক্তকরণ, পরীক্ষা, চিকিৎসা, আইসোলেশন ও রোগীর সঙ্গে কারা মেলামেশা করেছিলেন তাদের শনাক্তের ওপর। ড. ক্ষেত্রপাল সিং হাত ধোয়া, হাঁচি ও কাশি নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিকভাবে মানুষ থেকে দূরে থাকার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেন।

বিশ্বব্যবস্থাকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলা করোনাভাইরাসের কারণে সামনের দিনের সুখবরগুলো ক্রমেই দুঃসংবাদে পরিণত হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিকে উল্টেপাল্টে দেওয়া এ মহামারিতে আগামীতে বেশ ভুগতে হবে চীনসহ পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে। করোনা না হলে স্বাভাবিক সময়ে যেখানে সাড়ে ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেত, সেখানে উল্টো এ অঞ্চলের ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের মুখে পড়বে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ এর সময়ে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলের অর্থনীতি শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাটি। বর্তমানে দুই শতাধিক দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এ মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত এ অঞ্চলের দেশগুলোকে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসাসামগ্রী তৈরির কারখানা সম্প্রসারণ করে তাতে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। একই সঙ্গে, অসুস্থ থাকাকালীন কর্মীদের ভর্তুকি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন তারা। প্রতিবেদনে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সামগ্রিক অর্থনীতিও করোনাভাইরাসের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি অনেক কমে যাবে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৯ সালে যা ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে বেইস লাইন তথ্য অনুযায়ী চীনের প্রবৃদ্ধি এ বছর কমে হতে পারে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। লোয়ার কেস পরিস্থিতিতে তা নেমে যাবে শূন্য দশমিক ১ শতাংশে। অথচ গত বছর এ হার ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। করোনাভাইরাসের আগের পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল চলতি বছর চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।

এছাড়া চীনসহ পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৭ দেশ বিশ্ব অর্থনীতির বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্ব বাণিজ্যের ৭০ ভাগ নির্ভর করে এই দেশগুলোর ওপর। করোনার বিরূপ প্রভাবে এসব দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে যাবে, যা আরো ১ কোটি ১০ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেবে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী অনুমান হলো করোনা সংক্রমণ না হলে এ বছর যত মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেত, এর চেয়ে ২ কোটি ৪০ লাখ কম মানুষ মুক্তি পাবে। করোনা না হলে সাড়ে ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে যেত। মহামারির পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হবে। বিশ্বব্যাংকের পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মুখ্য অর্থনীতিবিদ আদিত্য মাত্তু বলেন, মহামারি কল্পনার বাইরে বৈশ্বিক ধাক্কা দিয়েছে। এর প্রভাবে প্রবৃদ্ধি থমকে যেতে পারে এবং এ অঞ্চলজুড়ে দারিদ্র্য ছড়িয়ে দিতে পারে। করোনাভাইরাস মহামারিতে রূপ নেওয়ায় এর সংক্রমণরোধে বিশ্বের ৩০০ কোটি মানুষ এখন লকডাউনের মধ্যে আছে। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব কিছুই। আর এতে করে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে অর্থনীতি। তবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্থনীতির এই মন্দা কাটিয়ে উঠতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close