সাধন সরকার

  ৩০ মে, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

এটা পাহাড় ধসেরও মৌসুম

চলছে বর্ষা-দুর্যোগের মৌসুম। পুরো বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর পাহাড়ে বা পাহাড়ের কোলঘেঁষে বসবাসকারী পরিবারগুলোর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। বর্ষা মৌসুম আসে আর পাহাড়ধস নিয়ে আলোচনা হয়, সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও প্রতি বছর পাহাড়ধসে জানমালের ক্ষতি হয়। আর এর অন্যতম কারণ, পাহাড়কে পাহাড়ের মতো করে থাকতে না দেওয়া। পাহাড় কেটে পাহাড়ের পাদদেশে গরিব গৃহহীন মানুষের বসতি স্থাপনের মাধ্যমে বেশ কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী পাহাড়ের স্থায়ী ক্ষতি করে চলেছে। পাহাড় কেটে সমতল ভূমিতে রূপান্তরিত করে পাহাড়ের পাদদেশে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। প্রভাবশালী গোষ্ঠী পাহাড় কেটে একদিকে অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে অন্যদিকে পাহাড়ধসকে ত্বরান্বিত করছে। পাহাড়খেকো প্রভাবশালীদের সম্পর্কে নিশ্চয় প্রশাসন অবগত! তারপরও এই গোষ্ঠী পাহাড় কেটে প্রকৃতি ও পাহাড়ের সৌন্দর্য নষ্ট করার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে।

পাহাড়ের সৌন্দর্য বিনষ্ট হওয়ার ফলে পর্যটনের প্রতি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা নিম্নআয়ের মানুষদের মধ্যে অল্প বৃষ্টিতে ভয় কাজ করে আর টানা বৃষ্টি হলে রীতিমতো মহাআতঙ্ক শুরু হয়ে যায়! জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, চট্টগ্রামে ২৮টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসতি বয়েছে। এখানে কয়েক হাজার পরিবার রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করা জনগোষ্ঠীকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা অনেক সময় কাজে আসে না! ঝুঁকির কথা চিন্তা করে অনেক সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলোর গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যাতে তারা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু সেসব সিদ্ধান্ত ঠিকঠাক বাস্তবায়ন হয় না। করোনাকালে সবাই যেহেতু নিজ ঘরে অবস্থান করছে ফলে এখন যদি কোনো কারণে পাহাড়ধস হয় তাহলে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে।

বিভিন্ন বছর পাহাড় কাটা ও বন উজাড়ের ফলে বর্ষা মৌসুমে একের পর এক পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে ‘প্রাচ্যের রানি’ বলা হয়। ‘বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার’ খ্যাত এ শহরের অপরূপ সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান হচ্ছে পাহাড়। পাহাড়ের সঙ্গে রয়েছে এ শহর ও অঞ্চলের আত্মিক বন্ধন। পাহাড় ধ্বংস করা হলে এ শহরের ভৌগোলিক চরিত্রও বদলে যেতে পারে। কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্রের লোভ ও লালসা পাহাড়ের এই সৌন্দর্য নষ্ট করছে। দিনে ও রাতের আঁধারে সংঘবদ্ধ চক্রের পাহাড় কাটা থেমে নেই! জানা যায়, ১৯৭৫ সাল থেকে পাহাড়ে অবৈধ দখল শুরু হয়। তারও আগ থেকে কমবেশি পাহাড় কাটার সূত্রপাত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড় কাটা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি পাহাড়ে বসবাসকারী জনবসতির সংখ্যাও দিনে দিনে বেড়েছে।

বিভিন্ন সময়ের পাহাড়ধসের চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে নিহত হয় প্রায় ১২৭ জন, ২০০৮ সালে ১৪ জন, ২০১১ সালে ১৭ জন, ২০১২ সালের ২৮ জন, ২০১৩ সালে দুজন, ২০১৭ সালে প্রায় ১৫০ জন। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পাহাড়ধসে মৃত্যু অনেকাংশে হ্রাস করা গেছে। সামনের সময়গুলোতে পাহাড়ধস আবারো যে মৃত্যুর কারণ হবে না; তার কোনো নিশ্চয়তা নেই! সহজ কথায় পাহাড়কাটা বন্ধ করতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে সব ধরনের বসতি উচ্ছেদ করতে হবে। ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে প্রাণহানির পর গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি পাহাড়ধসের ২৮টি কারণ চিহ্নিত করে পাহাড়ধস বন্ধে কিছু সুপারিশ করেছিল। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে আজ পাহাড়ধস নামক দুর্যোগ নিয়ে এত চিন্তিত হতে হতো না!

পাহাড়ে অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতি তৈরি, বন উজাড়, যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণ, পাহাড় কাটা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, পাহাড়ধস বন্ধে পুরো পাহাড়ের চারপাশে পাথর ও সিমেন্টের ব্লক তৈরি করা হয়। পাশাপাশি পানি নিষ্কাশনের জন্য রাখা হয় পৃথক ব্যবস্থা। বাংলাদেশেও এখন এ প্রযুক্তিতে পাহাড় রক্ষার কৌশল কাজে লাগানো যেতে পারে। পাহাড়ধস বন্ধে এ ব্যবস্থাপনায় এ দেশের বেশ কিছু পাহাড় সংরক্ষণ করে দেখা যেতে পারে। পাহাড়গুলো আমাদের সম্পদ, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যায় না! ধারাবাহিকভাবে পাহাড়ের ক্ষতি করে চললে পাহাড়ও একসময় তার প্রতিশোধ নেবে। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। পাহাড়কে নিজেদের স্বার্থে কোনো গোষ্ঠী বা চক্র যেন ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশের সার্বিক ভারসাম্য রক্ষা ও পর্যটনের বিকাশে পাহাড় রক্ষা করতেই হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও পরিবেশকর্মী

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close