ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

  ২১ মে, ২০২০

মতামত

কত অজানারে জানাইলে তুমি

৩১ জানুয়ারি ২০১৯। চিনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে নভেল করোনাভাইরাসের আবির্ভাব। তাৎক্ষণিক ৪১ জন সংক্রমিত মানুষের মধ্যে একজন মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে চিকিৎসাধীন মারা যান। চিন ১২ জানুয়ারি ভাইরাসটির জিন সিকুয়েন্স বের করে। এই সিকুয়েন্স ব্যবহার করে চীনসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের কিট আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়। নভেল করোনাভাইরাসের থাবা আজ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। ভাইরাসটি সম্পর্কে এখনো খুব বেশি কিছু জানা যায়নি বলে এর নামের আগে নভেল কথাটিজুড়ে দেওয়া হয়েছে। নভেল শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে উপন্যাস। লেখক উপন্যাসে যে গল্প উপস্থাপন করে তার পুরোটা সত্য নয়। তবে ভাইরাসটি কীভাবে সংক্রমিত হয় সেসব বিষয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞান পুরোনো। কেননা এসএআরএস বা সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম ভাইরাস নামে করোনাভাইরাস ২০০৩ সালে চীনে আবির্ভাব হয়েছিল। এর পর ২০১২ সালে এমইআরএস বা মিড্ল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম ভাইরাস নামে সৌদি আরবে আবির্ভূত হয়। সুতরাং করোনাভাইরাস সংক্রমণের ইতিহাসে এটি তৃতীয়। মহামারির অনেক ইতিহাস চিকিৎসা বিজ্ঞানে আছে তবে সভ্যতার জয়-জয়কারে এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের রৌদ্র করোজ্জ্বল সময়ে এমন মহামারি মানবসভ্যতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।

ভাইরাস সম্পর্কে আমাদের সাধারণ মানুষের জ্ঞান অনেক কম। ভাইরাস একটি ল্যাটিন শব্দ যার আভিধানিক অর্থ বিষ। অতি আণুবীক্ষণিক হওয়ায় ইহাকে কেবল ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে দেখা যায়। করোনা শব্দটিও ল্যটিন যার অর্থ মাথা। ভাইরাসটিকে মাথার মতো মনে হয় বলে বিজ্ঞানীরা এর এমন নামকরণ করেন। ভাইরাসটির বিস্তার ও সংক্রমণ সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় সেই ধারণাটুকুও আমাদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবাবিক জীবনে ঠিকমতো কাজে লাগানো যায়নি। চীন উহান শহরে করোনার বিস্তার এবং নতুন সংক্রমণ ঠেকাতে ব্রুটাল কোয়ারেন্টাইন অর্থাৎ বাধ্যতামূলক দমননীতির মাধ্যমে শহরের মানুষদের গৃহবন্দি রেখে সংক্রমণ কমিয়ে মড়ক কমাতে সফল হয়। সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উহান সফর করেন এই কঠোর চিনা অপারেশনের নেতৃত্ব দেন। এই কঠোর নেতৃত্ব ইতালিতে দেখা যায়নি। আরো জানা যায় ইতালির মানুষের বেপরোয়া মনোভাব, কিঞ্চিত বেশি গণতন্ত্র আর অত্যধিক ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের সামাজিকতা দেশটাতে এমন মড়ক লাগিয়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে বোকার হাট-বাজারে পরিণত হয়েছে বিশ্ব নেতৃত্বের দেশ আমেরিকা। নেতৃত্বের ব্যর্থতায় অবধি হাস্যকর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকার সিআইএ পরপর ১২ বার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে করোনার ভয়াবহ ক্ষতি সাধনের বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করে। কিন্তু ট্রাম্প বিষয়টিকে হেলায় উড়িয়ে দিয়েছেন এবং কোনো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেননি। প্রেসিডেন্ট বিষয়টি বুঝতে-বুঝতে সপ্তাহ তিনেক সময় নিলেন। কিন্তু করোনা সময় নেয়নি। করোনা যখন কমিউনিটি পর্যায়ে বিস্তার লাভ শুরু করেছে তখন চীনের সঙ্গে যাতায়াত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। কিন্তু মার্চে এসে দেখা গেল করোনা সংক্রমণে নিউইয়র্ক শীর্ষ হতে চলেছে। আমেরিকান চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা তাদের সংক্রমণকারী ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স করে দেখেন ভাইরাসটি সরাসরি চীন থেকে নয়, এসেছে ইউরোপ থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলো বিলাত ফেরত ডাক্তার দেখেছি, এত বিলাত ফেরত রোগী। সবকিছু হলো দেরিতে, যাকে বলে সময়ের এক ফোর আর অসময়ের ১০ ফোর। ইউরোপের সঙ্গে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এলো মার্চের শুরুতে, কিন্তু ততক্ষণে মিসিসিপি নদীতে অনেক জল গড়িয়ে গেছে।

বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের এই মহাসংকটে চীনকে রাজনৈতিক চাপে রেখেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি দাবি করেন, উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজীর এক ইন্টার্ন দুর্ঘটনাবশত করোনাভাইরাসটি ছড়িয়ে দিয়েছেন। এইডস ভাইরাসের (এইচআইভি) আবিষ্কারক ফ্রান্সের নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী লুক মন্টানিয়ের ফ্রান্সের একটি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, উহানের ল্যাবরেটরিতে চলতি শতকের গোড়ার দিক থেকেই করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা চলছে। তিনি আরো বলেন, কোভিড-১৯ এর ভাইরাস প্রাকৃতিক নয়। এটি একটি জিন প্রকৌশলজাত ভাইরাস। করোনাভাইরাসের কোষের মধ্যে এইচআইভি ভাইরাসের কিছু জিনগত চরিত্রের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে।

শুরুতে করোনাভাইরাস বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্লিপ্ত ছিলেন, আমাদের মধ্যেও এমন নির্লিপ্ততা দেখা যায় যাতে আমাদের ভোগতে হয়েছে, হয়তো আরো ভোগতে হবে। অবাধ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য আমাদের সমাজে এই নির্লিপ্ততার জন্ম দেয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতের নিজাম উদ্দিন মারকাজে সরকারি বাধা অবমাননা করে তাবলিগের জামায়াত পরিচালনা করে অভিযুক্ত হয়েছেন ভারতের তাবলিগ প্রধান মওলানা সাদসহ অনেকে। তাদের বিরুদ্ধে মহামারি আইন ১৮৯৭ অনুযায়ী এফআইআর করা হয়েছে। জানা যায় মারকাজ কেন্দ্রিক ৪০০ জন লোক করোনা সংক্রমিত হয়েছেন এবং এদের মধ্যে ১০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। তাবলিগ জামায়াতের লোকেরা ভারত সরকারের কাছে দাবি করেছিলেন করোনাভাইরাস একটা গজব, এই গজব এই মারকাজে আসবে না। ঢাকার সাভারে এক জুমার নামাজ শেষে ইমাম সাহেব মোনাজাতে বললেন, হে আল্লাহ তুমি করোনার মাধ্যমে ইহুদি-নাচারা, বেদিন-মুশরেকদের মাইরা সাফা কইরা দেও। মোনাজাত শেষ হতে না হতেই কিছু সচেতন শিক্ষিত মুসল্লি ইমাম সাহেবকে ভর্ৎসনা করতে বিলম্ব করেননি। আমাদের অনেক ধর্মীয় ইমাম শুরুতে মসজিদে ছোঁয়াচে রোগ বলে কিছু নেই বলেছেন। পরে অবশ্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছেন। কিন্তু সমস্যা থেকেই যায়, মুসল্লিদেরও থামানো যাচ্ছে না। গাজীপুরের মেয়র সম্প্রতি রমজানে একটা বয়ান দিয়েছেন, যেখানে করোনা রোগী নেই তারা একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন। প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কীভাবে বুঝবেন, রোগের লক্ষণ নেই অথচ কোন লোকটি করোনা ভাইরাসের বাহক? আমাদের সরকার এবং সরকার প্রধান করোনা নিয়ন্ত্রণে অনেক আন্তরিক, কিন্তু জনগণ এক কাতারে আসছে না।

সবকিছুর পরও বলা যায় কিছু মানুষ অনেক সচেতন। তারা মাস্ক পড়া, হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বুঝতে শিখেছে। ২০ সেকেন্ড সময় নিয়ে হাত ধুতে আমাদের আর ঘড়ির দিকে তাকাতে হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি আমেরিকানরা কীভাবে বিশ সেকেন্ড সময়ের হিসেব করে। হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ গানের সুরে তিনবার বললে ২০ সেকেন্ড সময় পার হয়। এক বিজ্ঞাপন চিত্রে সেদিন লক্ষ করলাম, আমরা করব জয় একদিন- গানটির প্রথম তিনটি পংক্তি সুর করে গাইলে ২০ সেকেন্ড সময় অতিবাহিত হয়।

লেখক : মাশরুম গবেষক এবং উদ্যোক্তা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close