ড. রাশিদ আসকারী

  ২১ মে, ২০২০

বিশ্লেষণ

ফিরে আসলেন দেখলেন জয় করলেন

ভেনি, ভিডি, ভিসি একটি ল্যাটিন শব্দবন্ধ। যার বঙ্গার্থ : আসলাম, দেখলাম, জয় করলাম। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার পন্টাসের দ্বিতীয় ফার্নাসেসের বিরুদ্ধে জেলার যুদ্ধে সহজ জয় লাভের পর খ্রিস্টপূর্ব ৪৭ অব্দে রোমান সিনেটকে লেখা এক পত্রে শব্দগুলো ব্যবহার করেন। সিজার পরাক্রমশালী দিগ্বিজয়ী নৃপতি ছিলেন। সহজেই পররাষ্ট্র জয় করে পরমানন্দ লাভ করছেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্র জয় করার প্রয়োজনীয়তা এবং তার আনন্দ উপভোগের অভিজ্ঞতা তার তেমনটি হয়তো ছিল না- থাকলে ‘ভেনি’-এর স্থলে রিভেনিও অর্থাৎ ল্যাটিন ভাষায় ‘ফিরে আসলাম’ শব্দটি স্থান পেত।

‘ফিরে আসলেন, দেখলেন, জয় করলেন’ কথাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে যার ওপর সর্বাধিক প্রযোজ্য, তার নাম শেখ হাসিনা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঔরসজাত সন্তান হয়েও তাকে দেশ ছেড়ে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যেতে হয়েছিল ভিনদেশে। চেনা পৃথিবী হঠাৎ করে অচেনা হয়ে উঠেছিল তার কাছে। চিরচেনা মানুষগুলো কেমন জানি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল নিরাপদ দূরত্বে, হয়তোবা বিপদের গন্ধ আঁচ করে। সেই চরম প্রতিকূল অবস্থা থেকে দেশমাতৃকাকে পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন প্রায় অর্ধযুগ পরে ১৯৮১ সালের ১৭ মের এক চরম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, বিরামহীন বর্ষণ আর মুহুর্মুহু বজ্রপাত শেখ হাসিনাকে যেন বোঝাতে চেয়েছিল পঁচাত্তর পরবর্তী বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশের অমানিষার কথা। সেইদিন সেই দুর্গতিনাশিনীর সাড়ম্বর আবির্ভাবে বাংলাদেশের রাজনীতির বন্ধ বাতায়ন যেন খুলে যায়। গদিনসীন জেনারেল অবশ্য তার আগমন বন্ধ করার নানা ফন্দি ফিকির করেছিলেন। কিন্তু দেশ এবং জনগণের প্রবল আকর্ষণের কাছে আর সবকিছু যেন গৌণ হয়ে দাঁড়ায়।

শেখ হাসিনা ফিরে আসলেন। স্বচক্ষে দেখলেন পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর সম্পূর্ণ পাল্টে যাওয়া এক অদ্ভুত বাংলাদেশ। যেখানে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। দেশ-বিদেশে উচ্চপদে আসীন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ফরমান জারি করে খোদ জাতির পিতার খুনের বিচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের শ্রাদ্ধ করে একেবারে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়া হয়েছে। জাতীয়তাবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শতশত সেনা কর্মকর্তাদের নির্বিচারে হত্যাকরে এক প্রতিক্রিয়াশীল তাবেদার সামরিক ব্যুহ গড়ে তোলা হয়েছে। আর রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে সেনা ছাউনিতে বসে নতুন দল গড়ে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির জন্ম দেওয়া হয়েছে। সুবিধাবাদী আমলা, বিভ্রান্ত রাজনীতিবিদ এবং ভ্রষ্ট সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অসম্প্রদায়িক চেতনাবিরোধী যে রাজনীতির খেলায় মেতেছিলেন তৎকালীন সামরিক শাসকেরা- শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যবর্তন না হলে হয়তো তত দিনে পাকিস্তানের এক ক্লোন করা হতো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে। তাই শেখ হাসিনার সময়োপযোগী সাহসী স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে একজন ব্যক্তির দেশে ফিরে আসার মতো মামুলি ঘটনা হিসেবে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। এটি যেন বাংলাদেশেরই ঘরে ফেরা। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ম্যাসাকারে বস্তুত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাংলাদেশকেই হত্যা করা হয়েছিল।

সেদিন নিহত বাংলাদেশের একাংশ দৈবক্রমে বেঁচে ছিল বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও রাজনীতির উত্তরাধিকার জননেত্রী শেখ হাসিনার মাঝে। সেই নির্বাসিত বাংলাদেশই যেন ফিরে আসে স্বদেশে শেখ হাসিনার সঙ্গে। শেখ হাসিনার দেখা শেষ হয় না। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পরও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি কীভাবে কৌশলে মসনদে বসে থাকে- প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী শক্তির কাঁধে চড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে, তা দেখেও নিরুৎসাহিত হননি হাসিনা। অবশেষে অনেক পরে, অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে একসময় শেখ হাসিনার হাত ধরেই নতুন বিজয় আসে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের। দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, একাত্তরের গণমানুষের রাজনীতি। প্রধানমন্ত্রীর আসন অলংকৃত করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা ফিরে আসলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। কিন্তু সেই জয়সিজারের জেলার যুদ্ধে জয়ের মতো অত সহজ ছিল না। দেশের ভেতর-বাহিরে, দলের ভেতর-বাহিরে অসংখ্য সংকট মোকাবিলা করে তিনি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ক্রমাগত অনন্য উচ্চতায়। হেনরী কিসিঞ্জারের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন স্যাটেলাইট যুগের মানচিত্রে জায়গা করে নেওয়া এক গর্বিত দেশ। বিশ^ব্যাংকের অসহযোগিতাকে অগ্রাহ্য করে নিজ সামর্থ্যে পদ্মা সেতুর মতো একটি স্টেট অব দ্য আর্ট স্থাপত্য গড়ে তোলার যোগ্যতাসম্পন্ন এক স্বাবলম্বী জাতি। আর এসবের পেছনে ছায়া হয়ে মিশে আছে একজনের অনিশেষ দায়বোধ এবং অপরিসীম দক্ষতা। দুর্মর দেশপ্রেম এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং শেখ হাসিনা। জরিপকারীরা ভুল বলেননি ‘শেখ হাসিনা তার দলের চাইতেও অধিক জনপ্রিয়। অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত, সুবিধেভোগী ভ- কপট নেতাকর্মীদের কর্মকা-ে আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলকে নিয়েও অনেক সময় সমালোচনার ঝড় উঠে। অনেকে অনিশ্চয়তায় ভোগেন এই দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু কাউকে কখোনো জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর ক্ষণিকের জন্যও আস্থা হারাতে দেখি না। দিনের ২৪ ঘণ্টার সিংহভাগ সময় যার কাটে দেশের ভাবনায় ও কাজে- তার ওপর আস্থা হারানো কঠিন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটো স্বদেশ প্রত্যাবর্তন গুরুত্বপূর্ণ। একটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এবং দ্বিতীয়টি যোগ্য পিতার যোগ্য তনয়া শেখ হাসিনার। প্রথমটি ঘটেছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যখন ৭৫ মিলিয়ন মানুষের অবিসংবদিত নেতা দীর্ঘ ৯ মাস করাভোগের পর পাকিস্তানের মিয়াঁওয়ালি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশের মাটিতে পা ফেলেন। এদিকে ১৯৮১ সালের মে মাসে দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় অবতরণ করেন শেখ হাসিনা। বিমান বন্দর থেকে সরাসরি তার জন্য আয়োজিত মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সমাবেশে যোগদান করেন। বিশাল জনসমাবেশে আবেগভরা কণ্ঠে বলেন, আমি বাংলাদেশের মানুষের পাশে থাকতে এসেছি। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেতা হতে আসেনি। আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে এবং আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ^াস করে। বিশাল জনসমুদ্রে পিনপতন নিস্তব্দতা বিরাজ করছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সেই প্রথম জিয়াশাসিত বাংলাদেশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ধ্বনিত হয়। ৩০ মিনিটের ভাষণে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুসহ চার জাতীয় নেতার হত্যাকা-ের বিচার করার প্রতিজ্ঞা করেন। ভারী বর্ষণ, বজ্রপাত অগ্রাহ্য করে অসংখ্য জনতার সঙ্গে তিনি পিতৃগৃহ ধানমন্ডি ৩২-এ যান। সেখানে তখনো বঙ্গবন্ধুর রক্তের দাগ লেগে ছিল। কিন্তু আদিষ্ট নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে নিজ গৃহের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া তো দূরের কথা বাইরে বসে প্রিয়জনদের আত্মার শান্তি কামনা করতেও দেয়নি।

সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা শেখ হাসিনার পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। ক্ষমতায় এসে তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের বিচার করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। কালো আইন বাতিল করেছেন। জঙ্গি দমনে অভূতপূর্ব সাফল্য এনেছেন। আর রাত-দিন কাজ করে চলেছেন দেশের উন্নয়নের মুকুটে নতুন নতুন পালক যুক্ত করতে।

‘তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘুচিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আর শুধু বাংলাদেশেরই নয়, পুরো প্রাচ্যের বিস্ময় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতি আমরা নিজেরা দিইনি। খোদ মার্কিন বহুজাতিক ব্যাংকিং ফার্ম গোল্ডম্যান ম্যাচ যারা বৈশ্বিক বিনিয়োগ ব্যাংকিং বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাসহ অন্যান্য আর্থিক সেবা নিয়ে কাজ করছে, তারাই বাংলাদেশের সমকালীন অর্থনীতিকে একেবারে ‘প্রাচ্যের আলোচিত’ বলে দাবি করেছেন)। তাদের এই দাবি নিছক ছেলেমানুষী নয়। ক্ষুধা-দারিদ্র্য-মঙ্গাপীড়িত বাংলাদেশ আজ এক উদীয়মান অপ্রতিরোধ্য ব্যাঘ্র। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, শেয়ারবাজার ধস, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ কোনো কিছুই বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারেনি।

সব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাধা অতিক্রম করে আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। বেড়ে চলেছে জিডিপি, গ্রোথ, মাথাপিছু আয়, ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রফতানি আয় সবকিছুই। অর্থনীতির সব সূচকই এখন ঊর্ধ্বগামী। আর এই অগ্রগামিতার উত্তাপ যে কেবল সূচক চিত্রেই সীমাবদ্ধ থাকছে তাও নয়। একেবারে দৃশ্যমানভাবে তার অস্তিত্ব বিকশিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের এই অসামান্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন দৈবযোগে সংঘটিত হয়নি। এর পেছনে রয়েছে এ দেশের মানুষের স্বপ্নসাধ, অসংখ্যের শ্রম-ঘাম, আর একটি সুদক্ষ সরকারের নেতৃত্ব, বিশেষ করে সেই সরকার প্রধানের দৃঢ়তা, আন্তরিকতা, স্বাপ্নিকতা এবং দেশপ্রেম। সত্যিই আজ বাংলাদেশের উন্নয়নের উপাখ্যানে জননেত্রী শেখ হাসিনার অবদানের জুড়িমেলা ভার। শেখ হাসিনা আজ কেবল বাংলাদেশের উন্নয়নের রোল মডেলই নন, তিনি আজ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়ন-রাজনীতির রোল মডেল। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে এক অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক।

জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্রমাগত প্রমাণ করে চলেছেন, তিনি কেবল তার দলের জন্যই নয়, তিনি তার দেশের জন্যও এক অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধু যেমন আওয়ামী লীগের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার দিকে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার রক্ত ও রাজনীতির সুযোগ্য উত্তরাধিকার জননেত্রী শেখ হাসিনাও তেমনি ১৬ কোটি মানুষকে নিয়ে সবসময় ভাবছেন। ভয়াল করোনা- সংক্রমণের এই বৈশি^ক বিপর্যয়ের কালেও তিনি ভার্চুয়াল যোগাযোগের মাধ্যমে রাতদিন দেশবাসীর ভালোমন্দের খোঁজখবর রাখছেন। বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন স্বাধীনতা। শেখ হাসিনা দিচ্ছেন অর্থনৈতিক মুক্তি। এই জায়গায় পিতা-পুত্রীর অবস্থান পরস্পরের পরিপূরক। আজ বাংলাদেশের উন্নয়ন যে প্রাচ্যের বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে তার পেছনে কাজ করছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এবং তা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশবাসীর- তৎপরতা। এই তৎপরতার সাফল্য অনিবার্য।

লেখক : উপাচার্য

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close