রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২০ এপ্রিল, ২০২০

মতামত

করোনার আঘাতে বিধ্বস্ত ইউরোপ ও আমেরিকা

বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। ছাড়াল চীন ও ইতালিকে। হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে প্রশড়ব করা হলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যাপক হারে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স জানান, দেশটির ৫০টি রাজ্যেই এখন করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার ব্যবস্থা রয়েছে এবং সারা দেশে ৫ লাখ ৫২ হাজারের বেশি পরীক্ষা করা হয়েছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যকেই লকডাউন করা হয়েছে এবং বেশকিছু রাজ্যের বাসিন্দাদের ঘরে থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত ১২ এপ্রিল ইস্টার সানডের দিন, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন যা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ২১টি অঙ্গরাজ্য করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে তাদের নাগরিকদের ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে দেশটি মারাত্মক সংক্রামক এই রোগের নতুন এপি সেন্টারে পরিণত হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, বৈশ্বিক মহামারির পরবর্তী কেন্দ্র হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ ইতালির মতোই ভয়াবহ চিত্র হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে প্রতিদিনই মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। এই মরণ ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। চীনের উহানে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ১ লাখে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল ৬৭ দিন। তারপর ২ লাখ হতে সময় লেগেছে ১১ দিন। আর মাত্র চার দিনে আরো ১ লাখ নতুন আক্রান্ত হয়েছে। করোনার এই বিস্তার রোধের একমাত্র উপায় ঘরে থাকা এবং নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখা। তাহলেই একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমণের ভয়াবহ এ চক্র ভাঙা সম্ভব হবে।

এদিকে করোনা আতঙ্কে ত্রস্ত সারা বিশ্ব। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে হুহু করে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের এপি সেন্টার চীনের দিকেই আঙুল তুলছে সারা পৃথিবী। করোনাকে চীনা ভাইরাস বলেই উল্লেখ করা হচ্ছে বিভিনড়ব আলোচনায়। গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও করোনাকে চীনা ভাইরাস বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন বিশ্বজুড়ে এই বিপর্যয়ের জন্য চীনই দায়ী। এই ভাইরাসের উৎপত্তি চীনেই, চাই করোনাকে চীনা ভাইরাস বলাকেই যথার্থ মনে করেছেন বলে ব্যাখ্যা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এই সংক্রমণের জন্য এশীয়-আমেরিকানদের যেন দায়ী না করা হয় বলে, সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, তারা আমেরিকার প্রশাসনের কথা মেনে চলেন ও সংক্রমণ আটকাতে সরকারি প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সহযোগিতাই করছেন এশীয়-আমেরিকানরা।

সম্প্রতি মার্কিন মুলুকে এশীয় আমেরিকানদের ওপর আক্রমণের একের পর এক খবর পাওয়া যাচ্ছে। ট্রাম্পবিরোধীরা এই ঘটনার জন্য তার দিকেই আঙুল তুলেছেন। তাদের দাবি, ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলোই দেশে চীনবিরোধী আবহ তৈরি করেছে। যদিও এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তারপরই হোয়াইট হাউস থেকে ট্রাম্পের এই বিবৃতি। করোনা বিধ্বস্ত গোটা পৃথিবী। তবে চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া এই মহামারি সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে ইতালিতে। মানবতা রক্ষার যুদ্ধে চীন-রাশিয়া ইতোমধ্যে যুদ্ধ শুরু করেছে। ইতালির আক্রান্ত মানুষ রক্ষায় চীন তাদের চিকিৎসক দল পাঠিয়েছে। একইভাবে রাশিয়া ১৫টি সামরিক জেট বোঝাই করে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও চিকিৎসক দল ইতালি ও ইরানে পাঠিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা ছোট্ট দেশ কিউবাও বসে নেই। ক্ষুদ্র শক্তি নিয়েই করোনা বিধ্বস্ত ইতালিতে সেনা পাঠাল মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।

করোনার মহামারিতে সবচেয়ে বিপনড়ব দেশ ইতালির লোম্বার্ডিতে চিকিৎসা সহায়তা দিতে গেলেন কিউবার চিকিৎসক ও নার্সদের একটি দল। এর আগেই ১২ মার্চ চীনের চিকিৎসক, নার্সরা গেছেন ইতালিতে। তবে কিউবার চিকিৎসক দল ইতালিতে মহামারির চিকিৎসার জন্য যাওয়ার ঘটনায় সাড়া পড়েছে গোটা দুনিয়ায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য ইতালি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ইতালিতে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পরও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দেশ এগিয়ে আসেনি তাদের সাহায্য করতে। পাশে দাঁড়ায়নি বন্ধু আমেরিকাও। এ নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল ইতালি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি দেশও সাহায্য করেনি বলে জানিয়েছিল ইতালি। এই পরিস্থিতিতে ইতালি সাহায্য চায় চীন, কিউবা ও ভেনিজুয়েলার কাছে।

ইতালি রওনা হওয়া চিকিৎসক দলের সদস্য ৬৮ বছর বয়সি লিওনার্দো ফার্নান্দেজ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, আমরা সবাই ভয়ে ভয়ে আছি। কিন্তু এটা বৈপ্লবিক কর্তব্য, যা করতেই হবে। এক প্রশেড়বর জবাবে তিনি বলেন, ভয় সবাই পায় সুপার হিরোরা ছাড়া। আমরা সুপার হিরো নই, বিপ্লবী চিকিৎসক। ফার্নান্দেজ এই নিয়ে আটবার আন্তর্জাতিক মিশনে যাচ্ছেন। ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আগে তিনি লাইবেরিয়াতে গিয়েছিলেন। দলের আরেক সদস্য গ্রাসিলিয়ানো ডায়াজ জানান, এটা একটা সম্মানজনক কাজ, যা সংহতির নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমশই ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে করোনাভাইরাস। এবার প্রাণ গেল এক দুধের শিশু। জানা গেছে, তার বয়স এক বছরেরও কম। সাধারণত এত ছোট কোনো শিশু আগে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা এটি।

যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে দেশটি মারাত্মক সংক্রামক এই রোগের নতুন এপি সেন্টারে পরিণত হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও)। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে গৃহহীন মানুষদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। নিয়মিত হাত ধোয়া, বাড়িতে থাকা, মানুষের ভিড় থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি সতর্কতাগুলো সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। তবে কারো থাকার জায়গাটি যদি বাড়ি না হয়ে তাঁবু হয়, যেখানে পানির ব্যবস্থা নেই, অনেকের সঙ্গে পাশাপাশি বিছানায় ঘুমাতে হয়, দিনে মাত্র একবার গরম খাবারের ব্যবস্থা থাকে, তাদের কী হবে? হ্যাঁ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহহীন মানুষরা এখন এমন কঠিন পরিস্থিতিরই মুখোমুখি। গৃহহীনদের মধ্যে অনেক বয়স্ক মানুষ রয়েছেন, তাদের মধ্যে আবার অনেকেই প্রতিবন্ধী, অনেক মানুষ একসঙ্গে রাস্তায় বাস করেন,

তাদের নেই কোনো স্যানিটেশন ব্যবস্থা। যাদের বয়স বেশি, দুর্বল স্বাস্থ্য, প্রতিবন্ধী, নিঃসন্দেহে তাদের করোনাভাইরাসের ঝুঁকি অনেক বেশি। ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স টু অ্যান্ড হোমলেসনেসে তথ্যটি প্রকাশ পায়।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে পুরো মানব সভ্যতাই আজ লকডাউনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ ভাইরাস সংক্রমিত দেশে ইতোমধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে পুরো জনজীবন। অফিস-আদালতও বন্ধের জোগাড় হওয়ার মতো অবস্থা। অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পুরো বিশ্ব। বিশ্বের উনড়বত দেশগুলো সাময়িকভাবে এসব ক্ষতির সামাল দিতে পারলেও, যদি এভাবেই চলতে থাকে তবে তাদেরও হিমশিম খেতে হবে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। এ ধরনের দেশের সাময়িক বিপর্যয় ঠেকানোর মতো অবস্থাই ঠিকমতো নেই। দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা তো বাদই দিলাম।

জনজীবন যখন এরকম চরম বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই পৃথিবী নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে নতুন রঙে। মনে হয় যেন মানুষের ওপর রাগ মেটাতেই স্বয়ং পৃথিবী দাওয়াত দিয়ে এনেছে করোনাভাইরাসকে। লকডাউন আর হোম কোয়ারেন্টাইনের প্রভাবে কমে গেছে মানবকূলের পদচারণায়। মানুষ বেশিরভাগ সময় ঘরে থাকার কারণে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত পরিবহন উভয়েরই ব্যবহার কমেছে। অনেক জায়গায় অফিস, কারখানাও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে কার্বন ও নাইট্রোজেন গ্যাসের নিঃসরণও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী প্রধান দেশগুলো হলো চীন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আর করোনার এপিসেন্টার এই দেশগুলোর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। চীনের উহান থেকে করোনার শুরু হলেও উহান অনেকটা বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এবার করোনার এপিসেন্টার হতে চলেছে আমেরিকা।

লেখক : কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close