সালাহ্উদ্দিন নাগরী

  ১৮ এপ্রিল, ২০২০

মুক্তমত

করোনায় প্রাত্যহিক জীবন

করোনাভাইরাস পুরো পৃথিবীকে স্থবির করে দিয়েছে। কলকারখানা, মার্কেট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক কার্যক্রম সব বন্ধ হয়ে আছে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মানুষের সংস্পর্শে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকায় সারা পৃথিবীই কার্যত লকডাউন অবস্থায় আছে। কেউ জানে না, এভাবে আর কতদিন চলতে হবে, নাকি সামনে এর থেকেও আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ।

এ সময় ঘরে বসে থাকতে থাকতে আমাদের দৈনন্দিন রুটিনই পরিবর্তন হয়ে গেছে। যে মানুষটি আগে রাত ১০ থেকে ১১টা হলেই ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেন পরদিন ভোরে ঘুম থেকে যথাসময়ে উঠার জন্য, তার এখন অফুরন্ত সময়। কোনো কিছুতেই তাড়া নেই; রাত জেগে টিভি দেখছেন, সোফায় ঝিমুচ্ছেন, নাশতা খাচ্ছেন দুপুর ১২টায়, দুপুরের আহার বিকাল ৪টায়।

যে স্বামীকে সারা দিন কাছে পেতেন না স্ত্রী, যে বাবা সস্তানের ঘুম থেকে উঠার আগে কাজে বেরিয়ে সন্তানের রাতে ঘুমানোর পর বাসায় ফিরতেন, তারা আজ ঘরে বন্দি। যে মানুষটি কোনো দিন জগ থেকে ঢেলে এক গ্লাস পানিও খাননি, তিনি আজ কাপড় ধুচ্ছেন, ঘর মুচ্ছেন, থালাবাসন মাজছেন, সাংসারিক কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করছেন। স্বামীকে পুরোটা সময় কাছে পাওয়ায় স্ত্রীর মধ্যে একটু হলেও অন্য অনুভূতি কাজ করছে। ফেসবুকে কেউ একজন লিখেছিলেন, মনে হচ্ছে আমরা ট্রেন জার্নি করছি। বসে থাকছি, আড়মোড়া ভাঙার জন্য একবার উঠে দাঁড়াচ্ছি, পায়চারি করছি, হাত ধুচ্ছি, ঘনঘন টয়লেট-বাথরুম যাচ্ছি, আবার সিটে বসে পড়ছি। এ গ্রহের সব মানুষেরই মনে হয় এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।

এখন হাসপাতালগুলোতে সর্দি-কাশি ও জটিল রোগী অ্যাটেন্ড করা হচ্ছে না। তাই এ দুঃসময়ে অন্য রোগ-বালাই যেন আমাদের আক্রান্ত করতে না পারে সেজন্য কঠোর সাবধানতা অবলম্বন ছাড়া উপায় নেই। যেহেতু রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে, তাই অনেককেই সন্ধ্যা বা রাতে গোসল করতে দেখছি। আমাদের দেশের মানুষ সাধারণত দুপুরের মধ্যে গোসলের কাজটি সেরে নিতে অভ্যস্ত।

তাই এখন এর ব্যতিক্রম ঘটিয়ে উটকো ঝামেলাকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। সর্দি-কাশি, জ্বর হয় এমন কাজ করা থেকে বিরত ও সাবধান থাকতে হবে আমাদের। ঘরে কাজ নেই দেখে ঘরের ঝুলঝাড়া, আসবাবপত্র, ধুলাবালিমুক্ত করাটা সাবধানতার সঙ্গেই করতে হবে, যেন ডাস্ট অ্যালার্জির কারণে সর্দি-কাশি শুরু হয়ে না যায়। রাত জেগে থাকাটাও কিন্তু অসুখ-বিসুখ বাড়িয়ে দেয়, বিশেষত ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগীদের এর ফলে অসুবিধা হতে পারে। তাই সুস্থ থাকতে এ সময় আগের রুটিন কোনোভাবেই পরিবর্তন করা যাবে না। অনেকেই নাকি বাসায় থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠছেন; কিন্তু কেন? দুনিয়ায় মানুষের বেহেশত হলো তার আবাসস্থল, যদি পরিবারের সদস্য অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রকৃত অর্থে হৃদয়ের সম্পর্ক থাকে। অনেকেই কারণে-অকারণে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি করে থাকেন।

এ অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত। মনে রাখতে হবে, আমরা একটি ক্রান্তিকাল এবং এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা অতিক্রম করছি। আর এ যুদ্ধের নিয়ম হলো প্রত্যেককে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করা। তাই এ পরিস্থিতিকে আনন্দমুখর রাখার জন্য সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবারের সদস্যদের প্রতি রূঢ় আচরণ পরিহার করতে হবে। আমরা গান শুনতে পারি, টিভি দেখতে পারি। গান তো জীবনেরই কথা বলে।

আমাদের সন্তানরা ঘরে বসে মোবাইল-ল্যাপটপ চালিয়ে অলস সময় পার করছে। বাসায় খন্ডকালীন গৃহকর্মী, সেবা প্রদানকারীরা আপাতত নেই। তাই নিজের বিছানা, বাথরুম, ঘর পরিষ্কার রাখা, কাপড়-চোপড় ধোয়া ও আলমারিতে গুছিয়ে রাখার কাজগুলো করার জন্য একটি প্রশিক্ষণ এখনই হয়ে যেতে পারে।

তাদের শোনাতে হবে, বারাক ওবামা যখন মহাশক্তিধর আমেরিকার কর্ণধার, তখন তার দুই মেয়েকে হোয়াইট হাউসে অসংখ্য গৃহকর্মী থাকার পরও নিজেদের কাজটুকু করার জন্য তাগিদ দিতেন এবং ওরাও বাবা-মায়ের কথামতো তা করত। আমরাও আমাদের সন্তানদের সেভাবে মাইন্ডসেট তৈরির, অন্তত ঘরের কাজে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারি।

আমাদের তরুণ সমাজের অনেকের মধ্যে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আমরা ঘরে থাকার এ সময়তে সন্তানদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে পারি, দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধর্মীয় নীতিকথা, ভালো কাজ, ভালো চিন্তা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করতে পারি। বড় বড় মণীষীর জীবনী ও তাদের ভালো কাজগুলো সন্তানদের সামনে তুলে ধরতে পারি। বইয়ের তাক থেকে শিক্ষণীয় বইগুলো তাদের হাতে তুলে দিতে পারি। এতে তারা বই, পত্রপত্রিকা পড়ায় উৎসাহিত হবে। একটি শিশু বা সন্তানের সত্যিকারভাবে বেড়ে উঠতে পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও অন্যান্য বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

সব ধর্মেই ভালো উদ্যোগ, ভালো কাজ, ভালো ভালো কথা বলা হয়েছে। সামাজিক অবক্ষয়ের এ যুগে ঘরে বসে থাকা বাবা-মায়ের দায়িত্ব অলস এ সময়টিতে নিজের ও সন্তানের ভেতরে ধর্মচর্চার তাগিদ তৈরি করা। আমরা ছোটবেলা থেকেই কোরআন পড়ি, কোরআন খতম করি। আসুন না, সন্তানদের বাংলা অনুবাদসহ কোরআন ও হাদিস পড়তে উৎসাহ জোগাই। এগুলোই আমাদের শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। উন্নত দেশগুলোতে লকডাউন অবস্থায় দাফতরিক কাজকর্ম ও শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ঘরে বসে অনলাইনে সম্পন্ন করা হচ্ছে।

আমাদের দেশেও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু সিংহভাগ শিক্ষার্থী এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাই এসব শিক্ষার্থীকে নিজে নিজে একটু একটু করে পাঠ্যপুস্তক পড়তে হবে এবং অভিভাবকদের এ ব্যাপারে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা বাসায় অবরুদ্ধ নই, নিরাপদ থাকার জন্য বাসায় আছি। করোনা-পরবর্তী ব্যাপক কর্মযজ্ঞে নিজেকে নিয়োজিত করার জন্য এখন আমাদের যেহেতু ঘরে থাকতে হচ্ছে, তাই নিজেকে সুস্থ রেখে সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের সবার মধ্যে সত্যিকার মানুষ হওয়ার জন্য ‘উত্তম চর্চা’র অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে এ সময়টিকে কাজে লাগাতে হবে।

লেখক : সরকারি চাকরিজীবী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close