মোতাহার হোসেন

  ১৮ এপ্রিল, ২০২০

মতামত

করোনায় মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে প্রয়োজন সচেতনতা

বিশ্ব আজ স্থবির। জরুরি পরিষেবা ছাড়া প্রায় সব ধরনের যানবাহন বন্ধ। কল-কারখানার চাকা ঘুরছে না। অফিস, আদালত, ব্যাংক-বিমা প্রায় বন্ধ। আবার কোথাও কোথাও এসব সীমিত আকারে চলছে। পৃথিবীজুড়েই আতঙ্ক বিরাজ করছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের সব রাষ্ট্র এই সমস্যার সমাধান খুঁজছে। মূলত বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি হওয়া আতঙ্কের নাম প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। ইতোমধ্যে প্রাণঘাতী এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। আকাশের যেমন সীমা-পরিসীমা নেই। তেমনি প্রাণঘাতী এই রোগের বিস্তারেও সীমা-পরিসীমা নেই। চিকিৎসায় প্রতিকার মিলছে না এই রোগ থেকে। মৃত্যুই যেন অবধারিত। এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে কঠোরভাবে মেনে চলা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘরে নিজেদের বন্দি করে রাখা বা হোম কোয়ারেন্টাইন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই নিয়ম বা অনুশাসন মানা হচ্ছে না। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমিত হচ্ছে এই রোগ। বিশেষ করে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকেই ছড়াচ্ছে এই রোগের জীবাণু।

চীনের উহান প্রদেশে গত বছরের ডিসেম্বরে এই রোগ দেখা দেয়। পরবর্তী সময়ে দ্রুতগতিতে বিস্তার ঘটে এই রোগের। ক্রমান্বয়ে এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সাউথ আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো। অর্থাৎ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস থেকে এখন মুক্ত নয় বিশ্বের কোনো দেশ। সব রাষ্ট্রেই এখন এই প্রাণঘাতী রোগের সর্বগ্রাসী ও সর্বনাশা বিস্তার ঘটেছে। ধনী, গরিব, উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, কালো, সাদা, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না। পুরো মানবজাতি এখন এই মরণঘাতী রোগের বিরুদ্ধে এক মহাযুদ্ধে লিপ্ত। জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির অপ্রতিরোধ্যে এই অগ্রযাত্রার এই সময়েও করোনাভাইরাস থেকে পরিত্রাণে কোনো কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি। অনুমানভিত্তিক প্রতিষেধক দিয়েই চলছে মরণব্যাধি এই রোগের চিকিৎসা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ঠাঁই দেওয়া কিংবা ন্যূনতম চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে মাঠে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ক্লাবে, পানির জাহাজে, স্টেডিয়ামে, পার্কে, আবাসিক হোটেলে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন বা তাঁবু টাঙ্গিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা হচ্ছে। মর্গে লাশ রাখার স্থান সংকুলান হচ্ছে না। চীনের পর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, ইউরোপের দেশ ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য তথা লন্ডনে আক্রান্ত এবং মৃত্যু হচ্ছে বেশি হারে মানুষ। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই মহামারিকে আখ্যা দিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে সর্বাধিক বড় রকমের দুর্যোগ হিসেবে। আর ইতালির প্রধানমন্ত্রী এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ উল্লেখ করে তিনি কেবল এই মহামারি থেকে পরিত্রাণে আকাশের (আল্লাহর) সহায়তার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। অনুরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এই দুর্যোগ সামাল দেওয়ার মতো সামর্থ্য তার সরকারের নেই। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তযুদ্ধের মতো করোনা যুদ্ধেও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের জয় হবে। এজন্য তিনি সবাইকে নিজ নিজ ঘরে থাকারও আহ্বান জানিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আহ্বানে দেশব্যাপী গত ৫ এপ্রিল রাতে ৯ মিনিটের মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালিত হয়েছে করোনাভাইরাস থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশে।

জনসমাগম ঠেকাতে পুরো বিশ্বে হচ্ছে লকডাউন। লকডাউন চলাকালে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা নিয়োজিত বাহিনীকে। এটি সত্য যে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধেও বিশ্বের এত রাষ্ট্র জড়ায়নি, এত ক্ষতিও হয়নি। এবারের করোনা মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছে পুরো বিশ্ব। বিশ্বের সব রাষ্ট্রই আক্রান্ত। এতে শুধু মানুষ মরছে না, ক্ষতি হচ্ছে তামাম দুনিয়ার অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিল্প, কল-কালখানা। স্থবির হয়ে পড়েছে জীবনযাপন। জীবনের কোলাহল প্রায় স্তব্ধ হওয়ার পথে। পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষ বন্দি নিজ বাড়িতে। আর এর বাইরে যারা আছেন তারা জরুরি পরিষেবা বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, খাদ্যপণ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিবহনে নিয়োজিতরা, ডাক্তার, নার্স, টেলিফোন, বিদুৎ, পানি, গ্যাস পরিষেবা কার্যক্রম চলছে। চলছে সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনের কার্যক্রম। সীমিত আকারে প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রাম চলছে দুনিয়ায়জুড়ে। তবে বন্ধ রয়েছে সব রকম গণপরিবাহন, গণজমায়েত, জনসমাবেশ ও জনসমাগম।

এই রোগে বিস্তার ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, হাত মেলানো, কোলাকুলি থেকে বিরত থাকা, সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া, হাঁচি হলে রুমাল অথবা টিস্যু দিয়ে নাক মুখ চেপে ধরা, বা কনুই দিয়ে তা ঠেকানো, হাঁচি-কাশি, জ্বর সর্দি হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া, চিকিৎসা নেওয়া। এছাড়া প্রাথমিকভাবে রক্ষার উপায় হিসেবে হ্যান্ড গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি কেমিক্যাল যুক্ত বিশেষ অ্যাপ্রোন ব্যবহারকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই রোগের বিস্তার কোথা থেকে, কীভাবে হচ্ছে তা নিয়েও নানা আলোচনা আছে। ভাইরাসটি কোনো একটা প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ঢুকেছে এবং একজন থেকে আরেকজনের দেহে ছড়াতে ছড়াতে আবার নিজের জিনগত গঠনের সময়ও পরিবর্তন আনছেÑ যাকে বলে মিউটেশন। তাই এ ভাইরাস হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যে আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, এমন আশঙ্কা চিকিৎসকদের। কিন্তু এ ভাইরাসটির প্রকৃতি এবং কীভাবেই বা তা রোধ করা যেতে পারেÑ এ সম্পর্কে এখনো বিজ্ঞানীরা বিশদভাবে জানার চেষ্টা করছেন। ইবোলার মতো নানা ধরনের প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবর মাঝে মাঝেই সংবাদ মাধ্যমে আসে। এই করোনাভাইরাসের সর্বশেষ সংযোজন। করোনাভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র সাতটি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।

এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠা-া লাগার মতো করেই এ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। এক দশক আগে সার্স নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৮০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেটিও ছিল এক ধরনের করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রধান লক্ষণ হলো, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, জ্বর এবং কাশি। কিন্তু এর পরিণামে অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, নিউমোনিয়ায় মৃত্যু ঘটতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন সময় লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তার পর দেখা দেয় শুকনো কাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট এবং তখন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

এই ভাইরাস কত বিপজ্জনক তা এখন বড় প্রশ্ন। এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের ২ শতাংশ মারা গেছেন, আরো মৃত্যু হতে পারে। তা ছাড়া এমন মৃত্যুও হয়ে থাকতে পারে। মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। ৩১ ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর গত ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। তবে ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছিল তা এখনো নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা। যেহেতু এই ভাইরাসটি নতুন, তাই এর কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন এখনো নেই এবং এমন কোনো চিকিৎসা নেই যা এ রোগ ঠেকাতে পারে।

আমরা প্রতিনিয়ত যে হারে প্রকৃতির ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করছি। প্রকৃতিকে স্বাভাবিক নিয়মে থাকতে দিচ্ছি না। পৃথিবীব্যাপী প্রতিনিয়ত শিল্প-কারখানা স্থাপন, কল-কারখানা এবং শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় বাতাসকে তথা বায়ুম-ল এবং ভূম-লকে উত্তপ্ত করছে। একইসঙ্গে নদী, সাগরের পানিকে দূষণ, ক্রমাগত বৃক্ষনিধন, সবুজ প্রকৃতিকে ধ্বংস, পাহাড় কেটে জনবসতি, শিল্প-কারখানা স্থাপন, প্রতিনিয়ত শক্তিধর দেশ কর্তৃক পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়া, ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ভূম-ল এবং বায়ুম-লকে বিষাক্ত করে তোলার পরিণামে করোনা নামক মানব বিধ্বংসী এই ভাইরাসের প্রকোপ বা মানুষের প্রতি প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ কি-না এটা এখন বিজ্ঞানীদের গবেষণা করে বের করা দরকার। পাশাপাশি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোকে অর্থনীতি পুনঃগঠনে ও কর্মস্থানের নিশ্চয়তা বিধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। নতুবা বিশ্বজুড়েই জনজীবনে আরেক মারাত্মক ব্যাধি বা উপদ্রব হিসেবে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম [email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close