এস এম মুকুল

  ১৭ এপ্রিল, ২০২০

মতামত

সবার চেষ্টায় করোনামুক্ত হবে দেশ

বাঙালি অনেক সহনশীল জাতি। শাসন-শোষণ আর অমানবিক অত্যাচারের দীর্ঘ ইতিহাস পেরিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার ঐতিহ্যবাহী বীরত্বেও গৌরবগাথা রয়েছে এই জাতির। বাঙালিরা সব পারে, পথ দেখিয়ে দিলেই হলো। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে এই বাংলার মানুষের নিত্যলড়াই যেন সখ্যতারই নামান্তর। কি পাহারে, কি হাওরে অথবা উপকূলে সর্বত্র প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে হয় বাংলাদেশের জনগণকে। বলা যায়, প্রাকৃতিকভাবেই আমরা পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের মানুষের চেয়ে যথেষ্ট বেশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রাখি। রোদে পুড়ে, বৃষ্টি ভিজে, খরা, বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, ধুলাবালি, যান্ত্রিক বিষবাষ্প, অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক আর ভেজালের বিষ হজম করে আমরা যেন প্রতিকূলতা প্রতিরোধী হয়ে উঠেছি। করোনাভাইরাস মোকাবিলাও করতে সক্ষম হব আমরা। সেজন্য নিয়ম মেনে চলতে হবে। সরকারের নির্দেশনাগুলো মেনে চলে প্রত্যকের নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। ১৪ দিন হোক বা দিন হোক নিয়ম মেনে ঘরে কাটান। জীবিকার প্রশ্নটা গুরত্বপূর্ণ। তাই বলে নিয়ম ভাঙ্গা উচিত হবে না। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকান। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অবরুদ্ধ কাটাতে হচ্ছে। কারণ এটা বেঁচে থাকার লড়াই। মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এই ভাইরাসকে যদি দমন করা যেত তাহলে এটা চীনের উহান রাজ্য ছাড়িয়ে উন্নত দেশ আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ইটালি, স্পেন, ফ্রান্সের মতো মহামারি ছড়াতে পারত না। ভেবে দেখুন, এই ভাইরাসের কাছে সবাই অসহায়। ধনি-গরিব, রাজা-প্রজা, মুসলমান-হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ কাউকেই সে ছাড় দিচ্ছে না। আমরা যদি এই ভাইরাসের কবল থেকে নিজেদের বাঁচাতে চাই, আমাদের দেশকে বাঁচাতে চাই- তাহলে অবশ্যই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাগুলো আমাদের মেনে চলতে হবে। আরো কিছু দিন ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে।

চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট-এ গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, সামাজিক দূরত্বের কারণে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে আবার বার বার হাত ধোয়া, পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা এবং রোগী ও সন্দেহভাজন রোগীর সংস্পর্শ এড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। এই বিষয়গুলো আমাদের মেনে চলতে হবে। তা না হলে- মহাবিপর্যয় দেখা দেবে আমাদের দেশে। আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশটা অত উন্নত নয়- উন্নয়নশীল একটা দেশ। আমরা এত বড় বিপর্যয় সামলে উঠতে পারব না। সে সক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা যদি নিয়ম না মেনে চলি, সরকারকে যদি সহযোগিতা না করি তাহলে আমাদেরই ক্ষতি হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটাও একটা যুদ্ধ। সত্যিই করোনাভাইরাস মোকাবিলা করা আমাদের জন্য একটা যুদ্ধ। আমাদের দেশের ৫ কোটি তরুণ প্রাণ- মেধা ও প্রযুক্তি বিকাশের নানা যোগ্যতায় এক উন্নত বাংলাদেশ গড়ার অপেক্ষায়। তাই করোনার কাছে আমরা সহসা হেরে যেতে পারি না। বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ, আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস শক্ত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রবল। মানবিক উদারতার অনন্য উদাহরণ আমাদের রয়েছে। আমরা ১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গাকে মানবিক আশ্রয় দিয়ে লালন পালন করছি। আমরা হেরে যেতে পারি না। দেশের এই দুঃসময়ে তরুণ সমাজ সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। মনে রাখতে হবে টাকার অভাবে বাংলাদেশ হারবে না। সচেতনতা আর দেশপ্রেমের অভাব হলে আমরা হেরে যেতে বাধ্য। নিশ্চয়ই আমরা এমন ভুলটি করব না।

নেগেটিভ ভাবার মতো অনেক ভাবনাই হয়তবা আছে। কিন্তু আমাদের বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে তাকাতে হবে। আমাদের দেশের বাস্তবতা, সক্ষমতার দিকেও তাকাতে হবে। সরকারের দায়িত্বের পাশাপাশি সচেতন নাগরিক দায়িত্বও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখন ভুল ধরার সময় নয়, লড়াই করার সময়। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটলে তবেই আমাদের ভুলগুলো, সীমাবদ্ধতাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। তখন সেগুলোকে শুধরাতে হবে। ভবিষ্যতের উপযোগী প্রস্তুতি পরিকল্পনা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ উন্নত দেশ নয়। উন্নত দেশের দেশের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন হোঁচট খেলে এই গতি মন্থর হতে বাধ্য। আমরা নিশ্চয়ই সেই ভুলটি করব না।

ভেবে দেখুন, পৃৃথিবীতে এখন কোনো যুদ্ধাবস্থা নেই। তবু বিরাজ করছে এক নির্মম মৃত্যুপুরীর হাহাকার। কোনো অস্ত্রের লড়াই নেই। নেই রক্তপাত, তবু অকাতরে দিতে হচ্ছে জীবন। তামাম পৃথিবীজুড়ে যেন চলছে জীবন বাঁচানোর লড়াই। বোধকরি, মানবসভ্যতা নিকট অতীতে এমন ভয়াবহ অস্তিত্বের সংকটে পড়েনি। গবেষকরা অবশ্য বলছেন, এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে লড়াই চালানোর উপায় একটাই, সেটা হলো- হোম কোয়ারেন্টাইন। একমাত্র বাড়িতে থাকাটাই সব থেকে নিরাপদ। কোনোভাবেই সংস্পর্শে আসা যাবে না। আহারে মানবজীবন, কতনা দম্ভোক্তি ছিল তোমার। আজ কত অসহায়। সবার আগে দরকার করোনার সংক্রমণ ঠেকানো। আর এজন্য সরকারকে যত কঠোর ভূমিকা নিতে হয়Ñ তাই নেওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে করোনা মোকাবিলায় আমাদের সামর্থ্য সীমিত। চিকিৎসক, চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা, মান সবকিছুতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তার ওপর এটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। ঢাকা সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। সরকারের পদক্ষেপ সময়োপযোগী হয় না অনেক ক্ষেত্রে। আবার জনগণের মাঝে নাগরিক দায়িত্বশীলতারও অভাব রয়েছে। ফেসবুকে দৃষ্টি দিলে মনে হয় সবাই দার্শনিক, বিশেষজ্ঞ, ডাক্তার, গবেষক...। আমরা ভীষণরকম প্রতিক্রিয়াশীল জাতি। খুব দ্রুত মতামত দিতে পছন্দ করি। পক্ষ-বিপক্ষ আর প্রতিপক্ষের শেষ নেই। সমালোচকের অভাব নেই। দায়িত্বশীলদের ভূমিকায় কয়জন আছেন? আপনি প্রবাসী, রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন বলেই আপনার স্বেচ্ছাচারিতা গ্রহণযোগ্য নয়। আপনি দেশের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারেন না অথবা আপনার কারণে দেশের জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা থাকলে আপনাকে অবশ্যই নিরাপত্তার স্বার্থে নিয়ম চলতে হবে। কারণ এই ঝুঁকি আপনার একার নয়। তাই আমাদের সবাইকে নাগরিক দায়িত্ব নিতে হবে। বিশেষ অবস্থায় নিজের এবং অপরের সুরক্ষায় যেকোনো নিয়ম মেনে নিতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেনটাইনে থাকা বাধ্যতামূলক আরো আগেই করা উচিত ছিল। সরকার এ পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছে, ভুল করেছে। তাই বলে আমরা সচেতন হবো না কেন। প্রবাসীর সংখ্যা বেশি এমন এলাকায় বিশেষ ও কঠোর ব্যবস্থা চাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে তবে শ্রমঘন প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েও ভাবা দরকার। প্রত্যেক সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার উদ্যোগে জনগণের জন্য হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গণপরিবহনে মালিকদের উদ্যোগে স্যানিটাইজার ব্যবস্থা নিতে পারে। মালিকরা পুঁজিপতি তারা কেন এটা করবে না। ওষুধ কোম্পানিগুলো জনসচেতনতা এবং চিকিৎসা সেবায় কেন এগিয়ে আসছে না। সবাই নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। আরেক মাফিয়া শ্রেণির বণিকরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জনগণের পকেট কাটার ধান্ধা করছে। এ দেশে সবচেয়ে বড় অভাবটি হচ্ছে নাগরিক দায়িত্বশীলতা আর দেশ প্রেমের। যদিও এজন্য আমাদের রাজনীতি অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু আমাদের দায়-দায়িত্বের বিষটিকেও হাল্কা করে দেখার সুযোগ নেই। একজন বুজুর্গ মুরুব্বির বয়ান শুনে অবাক হলাম। সাধারণত ওয়াজ-মাহফিলে এ ধরনের কথা আগে কারো মুখে শুনিনি। তিনি বললেন, ‘এই বাঙালিরা এমন একটা জাতি, এরা পাশাপাশি ফুটওভার ব্রিজ আর আন্ডারপাস থাকার পরও রাস্তার মাঝখান দিয়া দৌড় দিয়া রাস্তা পার হয়। এদেরকে নিয়ম মানাইতে হইলে আরো ১০০ বছর লাগব। হুজুরের মুখে একথা শুনে বিস্ময়ে ভাবলাম সত্যিই তো তাই। আমরা সহসা নিয়ম মানতে চাই না। এই প্রবণতা বন্ধ করতে হলে উন্নত বিশ্বের মতো লঘু অপরাধে গুরুদন্ড বিধান কার্যকর করার বিকল্প নেই। যাই হোক করোনা আমাদের জন্য কেবল জাতীয় দুর্যোগ নয়- এটি আন্তর্জাতিক বড় মহামারি। তাই করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় নিজে সচেতন থাকা এবং অপরকে সচেতন করা এমনকি সচেতনতায় ভূমিকা নেওয়া এখন আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। এর ব্যতিক্রম কিছু হলে কেবল নিজের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে তা নয়, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র চরম বিপদে পড়বে।

প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে আমাদের এই করোনাভাইরাস মোকাবিলার যুদ্ধে জাগ্রত নাগরিক ভূমিকা পালন করতে হবে। এজন্য অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে না। আমাদের প্রতিপক্ষ কোভিড-১৯, একে দুর্বল হতে দিন। করোনাভাইরাসকে সংক্রমণের ক্ষমতা নষ্ট হতে দিন। জীবন বাঁচাতে, জীবনের প্রয়োজনে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলুন। চিকিৎসকদের পরামর্শ, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলুন। সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন জানান, সহযোগিতা করুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। বাইরে বিপদÑ তাই ঘরে থাকুন। পরিচ্ছন্নতার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। পারিবারিক সদস্য ও আত্মীয়দের খবর নিন। দূরে থেকেও পাশে থাকুন। সাধ্যমতো কর্মহীন, অভাবগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করুন। নিজে না পারলে অন্যদের উদ্ধুদ্ধ করুন। এভাবে সবাই মিলে করি যদি চেষ্টা, করোনামুক্ত হবে আমাদের এই দেশটা।

লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close