মিল্টন বিশ্বাস

  ১১ এপ্রিল, ২০২০

মতামত

আতঙ্কিত হবেন না

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশ যখন সংকটে তখন একদল সুবিধাভোগী মহল শেখ হাসিনা সরকারের অর্জনকে

বিভিন্নভাবে হেয় করছে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিচিত্র গুজব রটানো হচ্ছে। বিশেষত করোনাভাইরাসে ৬১ জন নয়, হাজার জন আক্রান্ত, করোনা রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা মিলবে না, সরকারের কোনো ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে চলছে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া সরকার যে প্রতিশ্রুতি দেয়নি তাও সোচ্চারে প্রকাশ করা হচ্ছে। এজন্য গত ২ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করীম জানান, বাড়িভাড়া মওকুফ, ব্যাংক ঋণ ও বিদ্যুৎ বিল তিন মাসের জন্য স্থগিত, সব অফিসে এক মাসের ছুটি সংক্রান্ত যে গুজবটি ফেসবুকে ভাইরাল করা হচ্ছে তা পুরোপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট। যারা অপপ্রচার চালাচ্ছেন তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের প্রথম পর্যন্ত কয়েক দিন ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই মাসের বাড়িভাড়া মওকুফ করে দিয়েছেন বলে যে তথ্যটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সেটি অপপ্রচার বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তিনি আরো জানান, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার গৃহীত পদক্ষেপ নিজেই অথবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জানাবেন। তবে করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব উত্তরণের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হবেÑ এটাও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে সরকারের তরফ থেকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ৩ এপ্রিল বলেছেন, একটি মতলবি মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশের এই সংকটে গুজব, অপপ্রচার ছড়িয়ে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। কেউ যাতে গুজব ছড়াতে না পারে সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্ব এগিয়ে চলছে। করোনা সংকটের কারণে সারা বিশ্ব এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছে। জাতিসংঘের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে এমন ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হয়নি। সামষ্টিক স্বার্থে সামাজিক দূরত্ব মেনে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে এবং ঘরে বসে স্বাধীনতা উপভোগ করার আহ্বান জানান হয় তার তরফ থেকে। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে, দেশে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যসামগ্রী মজুদ রয়েছে। করোনা মোকাবিলায় ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নিম্নআয়ের মানুষের ‘ঘরে ফেরা কর্মসূচি’-এর আওতায় নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে। উপরন্তু এই সংকট মুহূর্তে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের উজাড় করে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। করোনা প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার স্বাস্থ্যসেবায় নবতর ব্যবস্থার উন্নতি করে চলেছে।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সঙ্গে ভুয়া সংবাদে বাড়ছে ঝুঁঁকি। মানুষ দুর্দশায় পড়লে অনেক সময় যুক্তি দিয়ে বিবেচনা না করে আবেগে পরিচালিত হয়। ফলে তখন বানানো তথ্য দিয়ে উপস্থাপিত নানা ভুয়া সংবাদের পেছনে মানুষকে ছুটতে দেখা যায়। ৩০ মার্চ ফ্রান্সের বিজ্ঞানী হুগো মার্সিয়া গার্ডিয়ানকে এসব ভুয়া সংবাদের ঝুঁঁকি নিয়ে তার মতামত জানিয়েছেন। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য নানা ওষুধ আবিষ্কারের তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া এবং এসব তথ্য কতটা প্রভাব ফেলতে পারে সেসব বিষয়ে মতামত তুলে ধরেছেন তিনি। এসব ভুয়া নিউজ ছড়িয়ে পড়া এবং মানুষ এসব নিউজ কেন সহজে গ্রহণ করে সে বিষয়েও রয়েছে অনেক যুক্তি। করোনাভাইরাসের ওষুধ নিয়ে গুজব রটনা হয়েছে। ‘ক্লোরোকুইন’ নামে একটি ওষুধ সেবনের মাধ্যমে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে জানানো হয়। অথচ এটির কোনো ভিত্তি ছিল না। আসলে যেকোনো সংকটময় মুহূর্তেই মানুষ সরলভাবে ভুয়া তথ্যগুলো গ্রহণ করে। তবে এটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়; সমস্যাটা হলো তারা কী করবে তা বুঝতে পারে না। এমন ভুয়া সংবাদই হয়ে ওঠে মূল ভয়ের কারণ। তথ্যের ঘাটতির জন্য ফ্রান্সের মানুষ মার্চ মাসে জনসমাগম ঘটিয়েছিল, কারণ করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলেও ওই তথ্যের মধ্যেও ঘাটতি ছিল। ভুয়া তথ্য গ্রহণ করার বিষয়ে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত যুক্তি হলো, মানুষ তখনই কোনো কিছু গ্রহণ করে যখন তা তার ধারণা কিংবা বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা তথ্যটি কোথা থেকে পাচ্ছি। হতে পারে কেউ এসব তথ্য বানিয়ে বানিয়ে আমাদের সরবরাহ করছে। সব সময় সংবাদ বা তথ্য যাচাই-বাছাই করাটা খুবই জরুরি।

অসহায় মানুষ বেঁচে থাকার জন্য বিশ্বব্যাপী ছড়ানো গুজবে বিশ্বাস করলেও আমাদের করোনা পরিস্থিতি আলাদা। এখানে করোনা দুর্যোগ শতাধিক মানুষের কাছে না পৌঁছালেও সরকারবিরোধী শিবির বেশ সক্রিয়। শেখ হাসিনা সরকারের সতর্ক দৃষ্টি এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপকভাবে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়নি। কিন্তু ডিজিটাল যুগের সুবিধাকে কৌশলে কাজে লাগাচ্ছে দুষ্কৃতকারীরা। অথচ একটি পরিবার যদি তার আশপাশের বাসার দিকে নজর রাখে তাহলে দেখতে পাবে মানুষ ঠিকই আছে। আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেনি। বরং নিজে হোম কোয়ারেন্টাইন পালন করলে সরকারকে সহযোগিতা করা হচ্ছেÑ এটাও বুঝতে সক্ষম হচ্ছে এদেশের জনগণ। তাছাড়া আমরা গত কয়েক বছরে দেখেছি যেকোনো দুর্যোগে একটি গ্রুপ সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য নানা রকম গুজব তৈরি করে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করে। স্কুলছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কিংবা পোশাক শিল্পের শ্রমিক অসন্তোষ, অথবা ছাত্র হত্যা, কিংবা ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তিÑ এরকম আরো অনেক বিষয় রয়েছে যা নিয়ে বিপুল গুজব ও অপপ্রচার ডালপালায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে গুজবের ফলাফল শূন্য। অতীতে গুজব ছড়িয়ে স্বার্থান্বেষী মহল সুবিধা লাভ করতে পারেনি। এবারও সরকারের নেওয়া যৌক্তিক ও কঠোর পদক্ষেপে সেই মতলববাজ মহল সুবিধা নিতে পারবে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেও বার বার বলা হচ্ছে মানুষকে যথাযথ তথ্য দেওয়ার জন্য। কারণ সরকারের কাছ থেকে যৌক্তিক তথ্য না পেলে বা যখন সত্য জানার উপায় থাকে না, তখনই গুজব ছড়ায়। মানুষ তখন অপপ্রচারে বিশ্বাস করে। অবশ্য তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকার স্বচ্ছ। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে সঠিক তথ্য। করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) দেশের ১০ জেলায় সংক্রমণ ঘটেছে। এগুলো হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাইবান্ধা, কক্সবাজার, চুয়াডাঙ্গা, রংপুর, কুমিল্লা ও গাজীপুর। কেবল ঢাকায় ৩৬ জন শনাক্ত হয়েছে। এই সংক্রমণ রাজধানীর ১৮ এলাকায় বিস্তৃত রয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ মণিপুর (পাঁচজন), বাসাবো (চারজন), পুরান ঢাকার বাংলাবাজার (তিনজন), সেনপাড়া, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, হাজারীবাগ, মগবাজার, উত্তরা ও উত্তরখান (দুজন করে) এবং মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বর, যাত্রাবাড়ী, আজিমপুর, কলাবাগান, রামপুরা, মহাখালী, বনানী-গুলশান, বারিধারা ও খিলক্ষেত (একজন করে)। অন্যদিকে সংবাদপত্র সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, ভাইরাসের স্বরূপ বুঝতে ৩৫টি দেশ মিলে হাজারের বেশি জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করেছে করোনার। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে মানুষকে আক্রান্ত করা ভাইরাসটির আটটি প্রজাতি খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বার বার বৈশিষ্ট্য বদল করা এ ভাইরাসের স্বরূপ বুঝতে চেষ্টা করছেন সবাই। ভারতও পরিবর্তন পেয়েছে তাদের দেশে আক্রমণ করা করোনাভাইরাসের। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এর স্বরূপ জানা যায়নি। ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে আইইডিসিআরকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে। কিন্তু গুজব সারা বিশ্বকে এখনো ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এজন্য বিশ্বাস করার আগে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য যাচাই করা দরকার। নির্ভরযোগ্য তথ্যের সন্ধান করতে হবে আমাদের।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, লুকোচুরির দরকার নেই। উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। অর্থাৎ মানুষকে কুসংস্কার এবং অপপ্রচার ও গুজবে বিশ্বাস না করে

বিজ্ঞানবিশ্বাসী হওয়ার পরামর্শই তিনি দিয়েছেন। আমরা এখন তার নির্দেশনাই মেনে চলব এবং দেশকে মহামারি থেকে রক্ষা করব।

লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close