ড. মো. হুমায়ুন কবীর

  ০৮ এপ্রিল, ২০২০

বিশ্লেষণ

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সচেতন ও সতর্ক থাকা

ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চীন থেকে শুরু হয়েছে। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে করোনার প্রথম আক্রমণ শুরু হয়। গবেষণায় অনেক ধরনের করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের মতো ক্ষতিকর আর কোনোটিই নয়। নভেল মানে নতুন এবং করোনা হলো রাজমুকুট। ভাইরাসটির অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে যে ছবিটি দেখা যায় তার আকার-আকৃতি রাজমুকুটের মতো বলে একে নভেল করোনাভাইরাস বা n-Corona Virus হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। আর ২০১৯ সালে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছে এবং এর প্রভাবে অতি ছোঁয়াচে রোগ (Disease) সৃষ্টি হয়েছে বলে এ ভাইরাস এবং এর প্রভাবে সংঘটিত রোগটির নামকরণ করা হয়েছে- Corona এর Co, Virus এর, Disease এর d এবং ২০১৯-এর ১৯ সম্মিলনে n-Corona Virus Disease-২০১৯ মিলে সংক্ষিপ্তভাবে Covid-19।

সেই চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে শুরু হয়ে সারা চীনেই ছড়িয়ে পড়েছিল করোনাভাইরাস। এরপর একে একে এক দেশ, দুই দেশ, তিন দেশ, চার দেশÑ এমন করতে করতে এখন বিশ্বের প্রায় ২০০-এর মতো অঞ্চল ও দেশেই তা ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। বিশ্বের আক্রান্ত দেশ প্রায় ২০০, আক্রান্ত মানুষ প্রায় সাড়ে ৯ লাখ, মৃতের সংখ্যা ৪৭ হাজারের বেশি, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন প্রায় ২ লাখ। দেশ হিসেবে চীনকে দিয়ে শুরু হলেও এখন বেশ কয়েকটি দেশ চীনকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রায় ১৫০ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনের আক্রমণ এখন কমে নতুন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোটায়। কিন্তু চীনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক কম এবং আরো উন্নত অনেক দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশ অনেকাংশে চীনের ভয়াবহতাকেও হার মানিয়েছে। এসব পরিসংখ্যান প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তনশীল। যেকোনো কারণে একটি মৃত্যুও কাম্য নয়, কিন্তু তারপরও বলা যায়, সর্বশেষ পরিসংখ্যানে আক্রান্তদের মধ্যে মৃতের হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

তখন থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যম, ব্যাপকভাবে বিষয়টি প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে কোনো কোনো দেশ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, আবার কোনো কোনো দেশ হয়তো ভাবতেও পারেনি এর প্রাদুর্ভাব এত ভয়াবহ হতে পারে। আমি যেহেতু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করি এবং এ বিষয়টি নিয়েও যথারীতি লেখার পরিকল্পনা করেছিলাম। নজর রাখছিলাম কোথা থেকে শুরু করব। কিন্তু এটি ধারাবাহিকভাবে এমনভাবে বিশ্বময় ছড়িয়ে যাচ্ছিল যে, প্রতি মুহূর্তেই এর রং পাল্টাতে থাকল। একসময় বলা হচ্ছিল, এ ভাইরাস বয়স্কদের বেশি আক্রমণ করছে কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে রকম পরিবর্তন করছে। এখন তা সব বয়সের মানুষকেই আক্রমণ করছে বলে জানা গেছে।

এ ভাইরাসটি কাকে আক্রমণ করবে আর কাকে করবে না এমন কোনো নিয়ম মানছে না। বাদ যাচ্ছে না স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, মন্ত্রী-মিনিস্টার, রাজা-বাদশা, ধনি-দরিদ্র, বৃদ্ধ-যুবক-শিশু, নারী-পুরুষ কেউই। আক্রান্ত হয়েছেন ব্রিটেনের প্রিন্স চার্লস, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং তার স্বাস্থ্যমন্ত্রী। স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেল এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তার স্ত্রী। এমন আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবেÑ যা মুক্ত ও অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে এখন সবার মুখে মুখে।

করোনাভাইরাস সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে মাঝে-মধ্যে কিছু গুজবের কথাও শুনতে হচ্ছে। সরকারি কিংবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য ছাড়া এর কোনোটাই সঠিক নয় এবং তা বিশ্বাস করার কোনো ভিত্তি নেই। তবে একটি বিষয় খুব পরিষ্কারভাবে বলা যেতে পারে, আর তা হলো বাংলাদেশে করোনার প্রভাব ও এর বিস্তার সম্পর্কে। চীন আমাদের বাংলাদেশ থেকে খুবই কাছের একটি দেশ। তারপরও এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ পেরোয়নিÑ যা আমাদের জন্য আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কিছুই না। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বপ্রস্তুতি, নাগরিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম, আঞ্চলিক আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্যÑ এগুলো অন্যতম কারণ হতে পারে। সে জন্য হয়তো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশে আক্রমণের ভয়াবহতা এখনো এতটা প্রকট হয়নি। অথচ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জনসংখ্যা ১৩০ কোটি। জনসংখ্যার অনুপাতে আক্রান্ত হলে কেমন ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে।

তবে এ অঞ্চলে আক্রান্ত কম হয়েছে তা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে বসে থাকলে চলবে না। কারণ বিশেষজ্ঞরা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আরো অনেকের ভবিষ্যদ্বাণী এমনও শোনা গেছে যে, করোনাভাইরাসটি যেহেতু ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ পাল্টাচ্ছে সেজন্য তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গেই এর প্রভাব বিস্তারের সম্পর্কÑ এটি সব সময় ঠিক থাকছে না। কাজেই এক্ষণই আরো সতর্ক ও সচেতন না হলে এতদাঞ্চলের ৭০ ভাগ মানুষের এ রোগে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর কীভাবে সচেতন ও সতর্ক হওয়া যায় সে বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া খুললেই তা পাওয়া যাচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে গত ৮ মার্চ। এরপর সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে পরিস্থিতি পর্যালোচনায় ১৭ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল সরকার থেকে। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা অবলোকনে সেটি বাড়িয়ে ইতোমধ্যে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ সার্ভিসগুলো সীমিত আকারে চালু রেখে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশকে অঘোষিত লকডাউনে রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে তা ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। তার মধ্যে আগে থেকে ঠিক করা মুজিব জন্মশতবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ সব কর্মসূচিসহ স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে মহান স্বাধীনতা দিবসের সব কর্মসূচি বাতিল করা হয়। কোনো ধরনের সমাবেশ ছাড়া সংক্ষিপ্ত কলেবরে পালিত হওয়ার কথা রয়েছে এবারের পহেলা বৈশাখ। পুরো বিশ্বই করোনা মোকাবিলায় একই ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে কার্যত সারা বিশ্বই এখন অচল হয়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশের জন্য আগামী দুই সপ্তাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সাময়িক লকডাউনের জন্য দেশ-বিদেশের সব মানুষ এখন একাকার হয়ে যার যার গ্রামের বাড়িতে অবস্থান নিয়েছেন। তারা সেখানে গিয়ে সামাজিকভাবে মেলামেশা করছেন। যদিও সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় কিছুটা গণজমায়েত কমেছে, কিন্তু সেটি শুধু হাট-বাজার জাতীয় স্থানে সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বাদবাকি সব মানুষকে লকডাউনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। কাজেই দেখা যাচ্ছে, সম্প্রতি বিদেশফেরত মানুষ যদি বাড়ি, পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে মেশার জন্য যদি করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণ হয়। তাহলে একই কারণ নিহিত রয়েছে যারা শহর থেকে গ্রামে পাড়ি জমালেন। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে তারা কাদের সংস্পর্শে এসেছেন সেগুলো বের করা খুবই কঠিন। আর যেহেতু কারো শরীরে করোনা আক্রমণ থাকলে তা দুই সপ্তাহ সময়ের মধ্যে প্রকাশ পায়, তাই সামনের দুই সপ্তাহ আমাদের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কাজেই এ সময়টা ঘরে থাকার বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে নিজে নিজের জায়গায় সচেতন না হলে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব দিয়ে সচেতন করে আর যাই হোক রোগ সংক্রমণ রোধ করা যাবে না। কারণ সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষ ছুটি দিয়েছে বিনোদনের জন্য নয়, পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় ঘরে থাকার জন্য। ধরে নিন না, এ সময় এটাই আপনার কাজ। ফেসবুক খুললেই দেখা যায় কোনো হাসপাতাল থেকে বলছেন, আপনার জন্য আমরা হাসপাতালেÑ দেশের জন্য আপনি ঘরে থাকুন। আবার ব্যাংক থেকে বলছেন, আপনার জন্য আমরা ব্যাংকেÑ দেশের জন্য আপনি ঘরে থাকুন। সত্যিই কী মহানুভবতা!

অতীতে আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, কলেরা, ম্যালেরিয়া, প্লেগ, জিকা ভাইরাস মোকাবিলা করেছি। সাম্প্রতিক ডেঙ্গু মহামারিসহ আরো অনেক মহামারি রোগকে মোকাবিলা করতে পেরেছি। তবে সেগুলোর সঙ্গে এটার একটা বেসিক পার্থক্য রয়েছে। এর আগে কোনো রোগই গোটা বিশ্বময় এমনভাবে প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারেনি। এত অল্প সময়ে এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি করতে পারেনি। কাজেই করোনাকে মোকাবিলা করার জন্য যেসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে সেগুলো মেনে চললে অবশ্যই এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভবÑ যা চীন ইতোমধ্যে দেখিয়ে দিয়েছে।

পরিশেষে বলতে হয়, আতঙ্কিত না হয়ে কিংবা কোনো ধরনের গুজবে কান না দিয়ে শুধু যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মাধ্যমে করোনাভাইরাসকে এবারের মতো বিদায় করা সম্ভব। ভাইরাসটি নতুন আবিষ্কৃত হওয়ায় ও প্রাদুর্ভাব ছড়ানোতে এখন পর্যন্ত এর পুরো টিকা কিংবা নিরাময়ের ওষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তবে কাজ চলছে। আশার কথা হলো, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ এ ডিজিটাল বিশ্বে নিশ্চয়ই এ থেকে পরিত্রাণের জন্য একটি সুখবর আসবে আগামী দিনে। আমরা আগামীতে তেমন একটি সুখবরের অপেক্ষাতেই রইলাম। আর এখন এ নভেল করোনাভাইরাস-২০১৯ অর্থাৎ n-Covid-19 ঠেকানোর জন্য আমাদের ঘরে বসে থেকে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close