জহিরুল ইসলাম

  ০৬ এপ্রিল, ২০২০

বিশ্লেষণ

অদম্য করোনাভাইরাস অনিবার্য পাবলিক হেলথ

মানব ইতিহাসে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) রোগটি অভিনব ও স্বকীয়। প্রথমবারই প্রাদুর্ভাব হয়ে অতিদ্রুত বিশ্ব মহামারিতে পরিণত হয়। দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (Homo Sapiens), এমনকি, কয়েক শতাব্দী ধরে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানসমূহ সংক্রমণ থেকে মানব প্রজাতির সুরক্ষায় যে ব্যূহ রচনা করে, সেটিও ব্যর্থ হতে চলেছে! সত্যি কি তাই? এই মুহূর্তের বাস্তবতা প্রশ্নটিকে বারবার সামনে নিয়ে আসে। পার্টিকেল থেকে ভিজিবল ইউনিভার্স পর্যন্ত সুবিশাল সাম্রাজ্যে বিজ্ঞান তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। মিটারের হিসাবে এর ব্যাস ১০-১৫? থেকে ১০২৭? পর্যন্ত। বিজ্ঞানের পজিটিভিস্ট দর্শনের দাবি, অনেক প্রমাণও রেখেছে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান প্রয়োগে সাম্রাজ্যভুক্ত প্রায় সবকিছু পর্যবেক্ষণ, বোঝা ও মানবকল্যাণে চালিতকরণ সম্ভব। পাবলিক হেলথ বিষয়ে গবেষণা ও একাডেমিয়া (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা) এবং ব্রিটিশ সোসাইটি ফর ইমিউনোলজি ও পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়ার সম্পৃক্তি থেকে আমার উপলব্ধি, দুনিয়া অচল করা ব্যাধি কোভিড-১৯ মোকাবিলাও সম্ভব।

সপ্তদশ শতকে ইউরোপে আধুনিক পাবলিক হেলথ বিজ্ঞানের যাত্রা শুরুই হয়েছিল রোগ প্রতিরোধ করে মানুষের সর্বোচ্চ কল্যাণের ব্রত নিয়ে। ফরাসি এনলাইটেনমেন্ট এবং জার্মান আইডিয়ালিজম সংশ্লিষ্ট দুটি ন্যারেটিভ নিজের অন্তর্গত করে নেয়। হিউম্যান এমান্সিপেশন : ‘মানুষের সর্বজনীন মুক্তি’। এই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রোগ, অসুস্থতা, মহামারি ও স্বাস্থ্যহীনতা থেকে মুক্তি। হিউম্যান রিজোনিং : ‘মানুষের যুক্তির ক্ষমতা’। এ ক্ষেত্রে রোগ, অসুস্থতা, মহামারি তথা স্বাস্থ্য অধ্যয়নে বৈশ্বিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অনুসরণ। এটি একাধারে একটি জ্ঞানকা-, পেশাগত ক্ষেত্র এবং সমাজের কল্যাণ-সমৃদ্ধির অবস্থা। গত শতাব্দীর মধ্যভাগেই পাবলিক হেলথ তার শতবর্ষব্যাপী স্বর্ণযুগ অতিক্রম করে। নিজস্ব বিশ্বদৃষ্টি, তাত্ত্বিক ভিত্তি, পদ্ধতিমালা, ইন্সট্রুমেন্টেশন এবং প্রায়োগিকতায় পরিপূর্ণ এই বিজ্ঞান, কুন সাইকেল অনুসারে, প্যারাডাইম পর্যায়ে উপনীত হয় তারও আগে। কাজেই, করোনাভাইরাসসহ সব সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচার নিশ্চিৎ পথ দেখানো জ্ঞানক্ষেত্রটির জন্য ম্যান্ডেট হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ। আমি এই সংকটের টেকসই এবং পূর্ণাঙ্গ সমাধানের কথা বলছি।

বাংলাদেশে জৈবচিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি প্রশাখা হিসেবে পাবলিক হেলথ বিজ্ঞানের পরিচিতি শুরু। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে স্নাতকোত্তর (এমপিএইচ) শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালিত হয়। বাংলা পরিভাষা ‘জনস্বাস্থ্য’। সংবিধানে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য হিসেবে গণ্য। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এই সেক্টরে নিয়োজিত। বহির্বিশ্বে বিশেষ করে উন্নত দেশসমূহের একাডেমিয়া, পাবলিক পলিসি এবং জনকল্যাণে পাবলিক হেলথ আধুনিক যুগের প্রারম্ভ থেকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়ে আসছে। প্রায় প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি একটি স্বতন্ত্র একাডেমিক ডিপার্টমেন্ট। জাতিসংঘ সূচকে (টঘঐউও) যেসব অগ্রগতির জন্য উন্নত দেশগুলো শীর্ষস্থানে, সেগুলোর সিংহভাগই পাবলিক হেলথ সংক্রান্ত। আমাদের আশান্বিত হওয়ার খবর হচ্ছে, স্বকীয় জ্ঞানকা- হিসেবে পাবলিক হেলথ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার পূর্ণাঙ্গ ডিপার্টমেন্ট দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পথিকৃৎ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। দেশে পাবলিক হেলথ ক্ষেত্রটি যথেষ্ট সম্ভাবনাময়, তবে পূর্ণ বিকশিত হতে আরো পথ পাড়ি দিতে হবে।

একটি প্রতিবেশ অবস্থা (জুনোটিক?) থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি, মানুষের সংস্পর্শে এসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এবং সেলুলার পর্যায়ে রোগ সংঘটন। এই পথপরিক্রমায় কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই। পাবলিক হেলথ যুগপৎ মানবিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে। মানুষ শরীর, মন, সংস্কৃতি এবং সমাজসমেত সত্তা। করোনাভাইরাস নিয়ে যেকোনো ইন্টারভেনশনে মানুষের আচরণ যেমন, বিশ্বদৃষ্টি, আবেগ, চেতনা, মূল্যবোধ, অভ্যাস, কর্মকা- গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। সর্বাধিক ভাবনার বিষয় মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক নৈকট্য এবং ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নিরন্তর সংস্পর্শে আসা। সমাজ কিংবা একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন মানুষ কল্পনাই করা যায় না। প্রজাতিগত উৎপত্তি কিংবা মনোগত ঐক্য সময় ও স্থান নির্বিশেষে সব মানুষকে প্রথমেই বিশ্বব্যাপী এক সম্পর্কের তন্তুজালে নিয়ে আসে। পরিবার, আত্মীয়তা, জেন্ডার, প্রজন্ম, প্রতিবেশী, সম্প্রদায়, শ্রেণি, কমিউনিটি, কাস্ট, এথ্নিসিটি, নেশন, রেস ও স্পেসিসÑ এই বর্গগুলো সামাজিক সম্পর্কেরই বিভিন্ন রূপ। এ ধরনের বহুবিধ সম্পর্কের জালে স্বাস্থ্যবিধি পালন এবং পারস্পরিক সংস্পর্শ বন্ধ করাই করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানোর মুখ্য কৌশল, তবে চ্যালেঞ্জিং। আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, কারফিউ, পরিচ্ছন্নতাকরণ, স্যানিটাইজেশন, হাইজিন, নাক-মুখ-চোখকে হাতের অধরা রাখা, আইন প্রয়োগ, রাষ্ট্রীয় সীমান্ত বন্ধ করা, প্রভৃতি উদ্যোগ। অবশ্য এই সংস্পর্শহীনতা এক্সক্লুসিভ নয়, বরং বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এক ধরনের ইনক্লুসিভনেস। পারস্পরিক মানবিকতা, সহানুভূতি, দায়িত্ব-কর্তব্য বিশেষ রূপে অনুশীলিত হয়। এভাবে, ইন্টারভেনশন সঠিক পথে রাখার পূর্বশর্ত, করোনাভাইরাসের প্রকৃতি ও প্রবণতার পাশাপাশি, মানুষ, মানুষের আচরণ, আন্তব্যক্তিক সম্পর্ক ও সংস্পর্শ বিষয়ে সম্যক জ্ঞান।

জলবায়ু, অণুজীবজগৎ, জৈবিক ইমিউনিটি এবং মানুষের সামাজিক অবস্থা ও বৈজ্ঞানিক সক্ষমতার পরিবর্তন, বিবর্তন এবং বিকাশ পরিপ্রেক্ষিত থেকে করোনাভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী প্যাথোজেনগুলো দেখার অবকাশ থেকে যায়। মহামারির প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাস এবং প্রতিরোধ উপায় উদ্ভাবনের জন্য তা জরুরি। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী মাইকেল লেভিট ২০১৩ সালে এবং পরে অনেকে চীনের করোনা মহামারির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তিত হওয়ার একটি প্রতিবেশগত পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের আবির্ভাব। এর আগেও সংক্রমণজনিত একাধিক মহামারির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা পৃথিবীবাসীর রয়েছে। যেমনÑ প্লেগ (১৬৫, ৫৪১ ও ১৩৪৬ খ্রি.), কলেরা (১৮৫২, ১৯১০), ফ্লু (১৮৮৯, ১৯১৮, ১৯৫৬, ১৯৬৮) এবং এইড্স (২০০৫)। একদিকে রোগের অণুুজীবসত্তা বিবর্তন ধারায় নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। অন্যদিকে উৎপত্তি, কারণ, বিস্তৃতি অনুসন্ধানসহ রোগ প্রতিরোধ এবং নিরাময়ে বিজ্ঞানের নিরন্তর সামনে চলা। মানবকল্যাণ ও প্রগতিতে যুগান্তকারী অবদান। তা স্পষ্ট হয় আধুনিক যুগের মৃত্যু ও রুগ্ণতা হার হ্রাস, আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের সঙ্গে প্রাচীন অথবা মধ্যযুগের প্রভেদ থেকে। করোনাভাইরাসের মতো মহামারিও এই গ্রহ থেকে নির্মূল হতে বাধ্য। প্রগতির চাকা ইতিহাসে কখনো পেছনে ঘোরেনি। এবারও এর ব্যত্যয় হবে না। মানবতার জয় সুনিশ্চিত।

জ্ঞান উৎপাদন, পুনরুৎপাদন এবং প্রয়োগের মহাযজ্ঞে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার নিবিড় সঙ্গী পাবলিক হেলথ। নিজস্ব তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ ও পদ্ধতিমালা অবলম্বনে এই জ্ঞানশাখা মানুষের কল্যাণ ও প্রগতিতে অবদান রেখে চলেছে। ‘পাবলিক’ পদটি ‘মানুষ’কে নির্দেশ করেÑ সব মানুষ, সমগ্র মানব প্রজাতি (Homo Sapiens)। বিশেষ কোনো বর্গের মানুষ নয়, এই বিজ্ঞানের মুখ্য ও প্রত্যক্ষ বেনিফিশিয়ারি হলো বিভিন্ন পরিচয়ে, সম্পর্কের তন্তÍজালে ও সামাজিক সংগঠনে থাকা এবং বিভিন্ন সংস্কৃতিসমেত মানুষ। শুধু রোগ থেকে ব্যক্তিবিশেষকে রক্ষার মধ্যে স্বাস্থ্য সীমাবদ্ধ নয়। এর পরিধি সম্প্রসারিত সব মানুষের সুস্থতা, কল্যাণ, সুখ ও সমৃদ্ধি পর্যন্ত। মানুষ শুধু জৈবিক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক সত্তা নয়। আবার এটাও বলা যায় না, মানুষ শুধু সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক সত্তা। বস্তুত মানুষকে নিয়ে কাজে একটি জ্ঞানক্ষেত্রই যথেষ্ট নয়। আন্তজ্ঞানকা-ীয় (interdisciplinary) দৃষ্টিভঙ্গি ও এক্সপার্টিজ আবশ্যক, এই উপলব্ধি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে। ‘আন্তজ্ঞানকা-’ পাবলিক হেলথের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এই আন্তজ্ঞানকা-ীয় বিজ্ঞান নির্যাস নেয় সব জ্ঞানক্ষেত্র যথা, জৈবচিকিৎসা, ফরমাল, অজৈব, জৈব, সামাজিক বিজ্ঞানসমূহ, এমনকি কলা ও মানবিকী থেকে। পাবলিক হেলথ পরিসরে এসে সব ক্ষেত্রের জ্ঞান ‘পাবলিক হেলথ জ্ঞানে’ রূপান্তরিত হয়।

‘রোগ শুধু ব্যক্তিক প্রপঞ্চ নয়, সামষ্টিকও’, একটি পাবলিক হেলথ নোশন। প্যাথোজেনেসিসÑ সেলুলার পর্যায়ে রোগ উৎপন্ন করার আগেই প্যাথোজেনকে রুখে দেওয়া হয়। অসুস্থতা ও মৃত্যুর গুরুত্বপূর্ণ কারণ রোগ, তবে একমাত্র নয়। দৈহিক, মনস্তাত্ত্বিক, প্রতিবেশ ব্যবস্থা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-রাজনৈতিক পর্যায়ে নানা বাস্তবতা মানুষের বেঁচে থাকা, সুস্থতা, সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি এবং উন্নয়নকে প্রভাবিত করে। বাজার অর্থনীতির যুগে একদিকে রোগীর ক্রয়ক্ষমতাভিত্তিক প্রাইভেট বা এক্সক্লুসিভ ট্রিটমেন্ট অনুশীলনের হিড়িক। অন্যদিকে, পাবলিক হেলথ ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ তথা ইনক্লুসিভ স্বাস্থ্যব্যবস্থার মিশন অর্জনে এগিয়ে চলেছে। সব ধরনের অনিষ্ট থেকে মানুষের সুরক্ষা। এ রকম একটি পৃথিবীর স্বপ্ন এই জ্ঞানক্ষেত্র এবং পেশাকে অনন্যতা দান করে। এভাবে, বিশ্ববাসীর কাছে বর্তমানের কোভিড-১৯ (কিংবা আগামী দিনের) বিশ্ব মহামারি প্রতিরোধে পাবলিক হেলথ অনিবার্য হিসেবে উপস্থিত।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close