ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  ০৫ এপ্রিল, ২০২০

মুক্তমত

নির্দয় নয়, সহমর্মী হোন

একের পর এক নেতিবাচক খবরে মনটা ভেঙে যাচ্ছে। আমাদের সমাজের কথা শুধু নয়Ñ বিশ্বের অনেক গুণিজনসহ কোনো কোনো নেতাও ভেঙে পড়েছেন। কেউ বাড়িতে নির্বাসনে চলে গেছেন। ইতালির প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সেদিন আবেগাপ্লুত হয়েছি। এদিকে জার্মানির একটি রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর চলন্ত ট্রেনের নিচে পড়ে মৃত্যুর বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। ওরা সম্ভবত দুঃখ-কষ্ট-হতাশাকে আমাদের মতো হজম করতে অভ্যস্ত নন।

করোনাভাইরাস বুঝিয়ে দিচ্ছে মানুষের গর্ব, দম্ভ করার আর কিছু বাকি নেই। বড় দেশগুলোর আত্মম্ভরিতা, অহঙ্কার ধুলোয় মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তারাও এখন বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। শুধু আমাদের নিজেদের জন্য নয়Ñ ওদের জন্যও আমাদের সহমর্মিতা ও মানবিকতা জেগে উঠুক।

এদিকে এক খবরে জানা গেল, বগুড়ার শিবগঞ্জে এক শ্রমিককে ট্রাক থেকে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে ট্রাকটির অন্য যাত্রীরা নিজ নিজ গন্তব্যে চলে গেছেন। ঢাকা থেকে রাতে অন্যদের সঙ্গে ফেরার সময় ট্রাকে ভ্রমণকালীন ওই শ্রমিকের জ্বর ও কাশি শুরু হলে সঙ্গীরা তার কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয়েছে সন্দেহে রাস্তার পাশে ফেলে চলে যায়! মানুষ কতটা নির্দয় হলে এমন কাজ করতে পারে?

খুলনার এক হাসপাতালে রোগীর কাছে ডাক্তাররা আসেননিÑ এমন খবর এসেছে কয়েক দিন আগে। জানা গেছে, ওই ব্যক্তি কয়েক দিন আগে ভারত থেকে এসেছেন। জ্বর-কাশি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ হয়েছেÑ এমন সন্দেহে ডাক্তাররা তাকে সেবা দিতে যাননি! কারণ সেখানে নাকি ডাক্তারদের প্রটেকশন স্যুট নেই, করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার সরঞ্জাম নেই; নেই অন্যান্য নিরাপত্তা সরঞ্জামও।

কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারকে এলাকাবাসী হুমকি দিয়ে হাসপাতাল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বগুড়ার শিবগঞ্জে সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত এক রোগীকে চিকিৎসা না দেওয়ায় ২৮ মার্চ তিনি মারা যান। সম্প্রতি কোনো হাসপাতালে সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত রোগী এলেই সবার আতঙ্ক বেড়ে যাচ্ছে এবং জ্বরে আক্রান্ত রোগীর প্রতি যে আচরণ করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত অমানবিক।

দেশের হাসপাতালগুলো এখন প্রায় ফাঁকা। বছরের স্বাভাবিক সময়ে যতসংখ্যক রোগী সেবা নিতে আসেন, এর সিকিভাগ রোগীও এখন হাসপাতালগুলোয় নেই। সেসব স্থানে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার কথা বলা হলেও অদ্যাবধি সেই পরীক্ষার কাজ শুরু করা যায়নি।

এজন্য আগাম প্রস্তুতি না থাকায় এখন প্রস্তুতি নিতেই সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেক রোগী করোনাভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে এসে মৃত্যুবরণ করলেও এলে সেটা করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য ঘটেছে কি না, তা বোধগম্য হচ্ছে না। ফলে ভাইরাস পরীক্ষার অভাবে আমরা দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সঠিক তথ্যের অভাবে এখনো অন্ধকারে রয়েছি।

এদিকে বলা হচ্ছেÑ আমরা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে করোনাভাইরাসের তৃতীয় পর্যায়ের সময়সীমায় ঢুকতে যাচ্ছি। এটি কমিউনিটি পিপল বা সমাজের মানুষের থেকে সংক্রমণ হওয়ার ভয়াবহতার সময়কে নির্দেশ করে! এ বিষয়েও আমরা এখন পর্যন্ত ওয়াকিবহাল নই। তাই সেটিরও প্রকৃত অবস্থা আঁচ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।

সামাজিক দূরত্বের কথা প্রচার করা হলেও মানুষ বাজারঘাট করছে, প্রার্থনা করতে বাইরে যাচ্ছে। নিম্নআয়ের কিছু মানুষ জীবিকার তাগিদে পথে বের হচ্ছেন। বস্তির বাচ্চারা দল বেঁধে রেললাইনের ওপর খেলাধুলা করছে। সামাজিক দূরত্বের যে সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে, সেটা আসলে জনতার ভিড় এড়িয়ে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে নিরাপদ দূরত্বে বসা, খাওয়া, ভ্রমণ করা, কাজ করা, টিভি দেখা, ঘুমানো ইত্যাদিকে বোঝালেও অনেক মানুষ সেটার মর্মার্থ সঠিকভাবে বুঝতে পারছেন কি নাÑ এটাও এক প্রশ্ন। গ্রামের মানুষ হাটবাজারে চায়ের দোকানে গিয়ে টিভি দেখেন। কারণ তাদের অনেকের বাড়িতে টিভি নেই।

করোনাভাইরাসের জন্য এখন হাট-বাজারে একত্রে বসতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ কঠিন সময়ে সচেতনতামূলক বায়োস্কোপ দেখানোটাও বিপদ। আমরা আসলেই একটি ক্রান্তিকালে অবস্থান করছি। আসলে এ সময় আক্রান্ত বা সুস্থ সব ধরনের মানুষের জনভিড় এড়িয়ে নিরাপদে থাকাকে বোঝানো হলেও আমাদের সামাজিক বাস্তবতার কারণে অনেকে এ দূরত্ব মেনে চলতে পারছেন না।

সমাজে এমন মানুষও রয়েছেন, যারা জীবনবাজি রেখে পেটের ভাত জোটানোর জন্য চৈত্রের দাবদাহ উপেক্ষা করে ভ্যানগাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। তাই শুধু সীমিত সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে সাহায্য করার পাশপাশি এদের জন্য পরিকল্পিতভাবে এবং দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করা জরুরি।

‘সামাজিক দূরত্বের’ মতো সাধারণের অবোধগম্য শব্দ ব্যবহার না করে সহজভাবে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে দৈহিক দূরত্বে অবস্থানের কথা বলা উচিত। জনসভা, খেলার মাঠ, স্টিমার, ট্রেন, বাস, বাজার, বসতবাড়ি, শোয়ার কক্ষ সব জায়গায় ‘ক্রাউড’ বা জনতার বড় ভিড় অথবা ছোট ভিড় এড়িয়ে করোনা সংক্রমণ থেকে মানুষকে নির্দিষ্ট নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান, চলাচল, বসা, হাঁটা, খাওয়া, কাজ করা ও ঘুমানোর কথা বলা ভালো।

ব্যস্ত মানুষ এখন বাড়িতে বন্দি। পরিবারের সব সদস্য বাসায় থাকায় বড় পরিবারের সদস্যরা ঠিকমতো নিয়ম মেনে চলার সুযোগ পাচ্ছেন না। কোনো কোনো পরিবারের ছোটকক্ষে কয়েকজনকে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। সেখানে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, ইরানসহ কয়েকটি দেশ আমাদের কাছে করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য সরঞ্জাম ও সহায়তা চেয়েছে বলে জানা গেছে। আমরা কাউকে হতাশ না করে সবাইকে সাধ্যমতো সহায়তা করতে চাই।

দেশের ধনাঢ্য ও সম্পদশালী দরদি মানুষ কালবিলম্ব না করে এ বিপদের সময় পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ান। আসুন আমরা সবাই দেশের মানুষের প্রতি মানবিক আচরণ করি এবং দেশের বাইরের মানুষকেও সাধ্যমতো সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন

সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close