মোতাহার হোসেন

  ০৫ এপ্রিল, ২০২০

বিশ্লেষণ

স্বাধীনতার ৪৯ বছর : উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ

দেশ স্বাধীন হলো আজ থেকে ৪৯ বছর আগে। ৪৯ বছর আগের বাংলাদেশ আর ৪৯ বছর পরের বাংলাদেশ এক নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় অর্থনৈতিক, সামাজিক খাতসহ সামগ্রিকভাবেই দেশ এগিয়েছে অনেকদূর। বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য এই উন্নয়ন, অগ্রগতি বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। মূলত এটিই ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্ন ‘জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি’ অর্জনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত আমরা। বঙ্গবন্ধু দেশকে ভৌগোলিকভাবে স্বাধীন করেছেন আর তারই সুযোগ্যকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উদীয়মান সমৃদ্ধির দেশ। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর হবে দেশ। একই সঙ্গে এ সময়ের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে দেশ।

ইতোমধ্যে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, বিদ্যুৎ, জ্বলানি খাতের উন্নয়ন, বিনামূল্যে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই প্রদান, পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান, স্কুল ফিডিং কর্মসূচি, নারীশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, যোগাযোগ, সড়ক অবকাঠামো, পুল-কালভার্ট উন্নয়ন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পটুয়াখালীর পায়রা নদীতে ‘পায়রা বন্দর স্থাপন, রেলপথের সম্প্রসারণ, অত্যাধুনিক রেলবগি, ইঞ্জিন আমদানি, রাজধানীতে মেট্রোরেল স্থাপন, ঢাকা-জয়দেবপুর সড়কে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট চালু, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চার লেনে উন্নীত, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ককে চার লেনে উন্নীত, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। এই ৪৯ বছরে বড় অর্জন হচ্ছে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে স্বাধীনতার ৪৯ বছরে দেশে আবাদি জমি কমেছে ব্যাপক হারে। তার পরও কৃষিকে সরকারের নব নব সংযোজন, প্রযুক্তির প্রয়োগ, অঞ্চল, মাটি, আবহাওয়া উপযোগী ধান, গমসহ অন্যান্য বীজ উদ্ভাবন। বিশেষ করে ৪৮ ধরনের হাইব্রিড জাতের উন্নত ও অধিক ফলনশীল ধানবীজ উদ্ভাবন করায় হাজার বছরের খাদ্য ঘাটতির দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শিক্ষার হার, মানুষের গড় আয়ু, রিজার্ভ, রেমিট্যান্স বেড়েছে ঈর্ষণীয় হারে, যা এখন পুরোপুরি দৃশ্যমান। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের শতভাগ বাস্তবায়ন হলে বিশ্বে বাংলাদেশ হবে উন্নয়নের রোল মডেল।

এখানে একটি অপ্রিয় সত্য কথা হচ্ছে : স্বাধীনতাবিরোধী, দেশবিরোধী ও নৈরাশ্যবাদী বিশেষ করে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির শত্রুপক্ষ বরাবরই বলে ‘দেশ স্বাধীন হলেও তেমন লাভ হয়নি। দেশে উন্নয়ন হয়নি, অভাব যায়নি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সামগ্রিক ক্ষেত্রে দেশের যে অগ্রযাত্রা হয়েছে, তা তারা দেখেন না। অথচ নির্দ্বিধায় তাদের অনেকেই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে, বক্রপথে অর্থবিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছে। এরাই বিশ্বাসঘাতক, এরাই দেশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পরিপন্থি। গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসনের পরিপন্থি। এরাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং তার মেয়ে শেখ হাসিনাসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতৃত্বকে পছন্দ করে না। বরং পেছন থেকে ষড়যন্ত্র করে। অতীতে বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রায় ৪৬ বছর ধরে অনবরত মিথ্যাচার করেছে এই চক্র।

দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের সফলতার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এই বিশাল অংশ খুবই নিশ্চুপ থাকে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ এখনো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জিয়াউর রহমানের তুলনা করেন। বিএনপির শাসনামলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের শাসনামলের তুলনা করেন। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সঙ্গে জিয়া পরিবারের তুলনা করেন। আমি মনে করি এই তুলনা যারা করেন তারা মানসিকভাবে দৈন্যতায় ভোগেন। এতে লাভবান হয় অপশক্তি। ঠিক এমনি করে দীর্ঘ ৪৯ বছর ধরে এই অপশক্তিই মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং বর্তমানে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের অপচেষ্টায় লিপ্ত। এখন প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে সচেতন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ঐক্য।

বিজয় অর্জনের ৪৯ বছরে এসেও মনে হচ্ছে এখন অব্দি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথে পদে বাধা সৃষ্টি করছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। কাজেই ১৯৭১ সালে আমাদের লড়াই ছিল মুক্তির লড়াই। যে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তবে বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার প্রাসঙ্গিকতা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আজকের প্রজন্ম হয় তো বুঝতে পারবেন না কত ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সে কারণে এই দিকটি সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিশ্বের নবীনতম দেশ ছিল; বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশও বটে। ২৫ মার্চ কালরাত্রির পর ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে বিশ্বব্যাংকের একটি বিশেষজ্ঞ দল কয়েকটি শহর পরিদর্শন শেষে মন্তব্য করেছিলÑ ‘এগুলো দেখতে পারমাণবিক হামলার পরের একটি সকালের মতোই।’ প্রায় ৬০ লাখ বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছিল। ১৪ লাখ কৃষক পরিবার চাষ বাসের হাল-হাতিয়ার ও পশু হারিয়েছিল। পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ধ্বংস। রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত, সেতু বিধ্বস্ত এবং অভ্যন্তরীণ জলপথ অবরুদ্ধ। ত্রিশ লাখ শহিদ, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত আর বিপুল সম্পদ ক্ষতির বিনিময়ে অর্জিত হলো বাঙালির বিজয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত দেশটির ধ্বংসযজ্ঞ শুধুই বেড়েছে। কেননা, পাকিস্তান বাংলাদেশের পোড়ামাটি চেয়েছিল। বাস্তবে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরা তা-ই করেছিল।

সময়টা একেবারে কম নয়, এরই মধ্যে অতিক্রম করেছি ৪৯ বছর। এই ৪৯ বছরের মধ্যে ২৮ বছর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সরকার ক্ষমতায় ছিল। জাতি রাষ্ট্র গঠনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকা-ে সুস্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক মদদ ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়েছিল। অথচ স্বাধীনতার ৪৯ বছরে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, সম্পদে ভরপুর এবং সম্পদে উপচে পড়া ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে স্বাধীনতা অর্জন এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ, সাহসী ও যোগ্য নেতৃত্বের ফলে।

আশির দশকে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বিকাশের মাধ্যমে বৈদেশিক অর্থ উপার্জনের সূচনা হয়। কালক্রমে এই শিল্প এখন বিশ্বে অন্যতম প্রধান রফতানিকারক শিল্পে পরিণত হয়েছে। প্রবাসী আয় আজ বার্ষিক ৩২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আজ আমরা শত্রুর মুখে চুনকালি দিয়ে বিশ্ব অগ্রগতির মহাসড়কে। শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্য দেখে বিশ্ব অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকস বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি আশু সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ১১টির মধ্যে রয়েছে। জেপি মরগ্যান বলছে, বাংলাদেশ অগ্রসর দেশগুলোর মধ্যে ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’। সিটি গ্রুপ যা বলছে, তা আরো উৎসাহব্যঞ্জকÑ ‘বাংলাদেশ এখন থ্রিজি অর্থাৎ থ্রি গ্লোবাল গ্রোথ জেনারেটর গ্রুপ’। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে ‘লিঙ্গভিত্তিক আয় সমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ।

সাউথ ইস্ট এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ শীর্ষে। দেশের শ্রমজীবী মানুষের অবদানেই এই অর্জন। নতুন প্রজন্ম এই দেশকে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে বক্তৃতায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এখন চীনের সঙ্গে নেক টু নেক’ পাল্লা দিচ্ছে। ১০-১২ বছর আগে এটি ছিল অচিন্তনীয়। কাজেই স্বাধীনতার ৪৯ বছরে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করেছে, সে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় প্রয়োজন বর্তমান সরকারের অব্যাহত ধারাবাহিকতা। তবেই নিশ্চিত হবে স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close