মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

  ০২ এপ্রিল, ২০২০

মতামত

করোনা অসচেতনতার পরিণতি মারাত্মক

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের মারাত্মক অবস্থান আমরা প্রতিদিনই দেখছি। আমাদের দেশেও করোনার সংক্রমণ ঘটায় সরকার জনসাধারণকে ঘরে থাকার জন্য সরকারি-বেসরকারি অফিস ছুটি দিয়েছে। শহরগুলোতে সেনা টহল চলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাত-দিন মানুষকে ঘরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই ঘরে থাকা মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। বিশেষত স্বল্প আয় ও হতদরিদ্র মানুষ খাদ্য ও অতীব প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর জন্য ঘরের বাইরে চলে আসছে। তাদের খাদ্যের সঞ্চয় নেই, হাতে টাকা নেই, বাইরে কাজও নেই। ফলে বিপুলসংখ্যক বিত্তহীন ও স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে রুজি ছাড়া বেঁচে থাকা কষ্টকর। ঢাকা শহরে বিভিন্ন বস্তিতে বসবাসকারী এমন মানুষের সংখ্যা মোটেও কম নয়। এছাড়া বস্তিতে এদের থাকার ঘর এবং পরিবেশ একেবারেই অস্বাস্থ্যকর, করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার অনুকূল পরিবেশ এগুলোতে বিরাজ করছে। এই মুহূর্তে ঢাকা শহরে অবস্থানকারী এসব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবনের ঝুঁকি কতটা প্রকট হয়ে উঠছে সেটি সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া জরুরি মনে করছি। এই মানুষরা যদি ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় তাহলে অন্যরাও মুক্ত থাকার তেমন কোনো কারণ থাকবে না। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেবে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে গ্রাম এবং উপজেলা ও জেলা শহরগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকার নিয়মাবলি অনেকেই অনুসরণ করছেন না এটি প্রতিদিনই গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষই হাটবাজার, ধর্মীয় সমাবেশ এবং সামাজিক যোগাযোগ পুরোপুরি পরিহার না করে নির্বিঘেœ চলাফেরা করছে। গণমাধ্যমগুলো যতই গুরুত্ব দিয়ে নির্দেশনাগুলো অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য পালন করা প্রচার করুক না কেন একটা বিরাটসংখ্যক মানুষ সেগুলো খুব একটা অনুসরণ করার তাগিদ অনুভব করছেন নাÑ এটি সহজেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। খোদ ঢাকা শহরেও অলিগলির ভেতরে কারণে-অকারণে ঘোরাফেরা করছে। কোনো বাহিনী এদের এভাবে চলাফেরা করা থেকে নিবৃত্ত করতে পারছে না। বিষয়টি সচেতন মহলকে বেশ অবাক করছে। এটি শুধু অবাক করার বিষয় নয়, আত্মঘাতীও হওয়ার মতো বলে অনেকেরই ধারণা। যারা এভাবে বের হয়ে আসছেন তারা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারছেন না, তাদের মধ্যে হেলাফেলার মনোবৃত্তি কতটা কাজ করছে সেটি সহজেই বোধগম্য। অথচ গণমাধ্যমে তারাই প্রতিদিন অন্যান্য দেশে কত কড়াকড়িভাবে জনসাধারণকে ঘরে থাকার নির্দেশনা মানতে হচ্ছে সেটি দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে এসব খবরাখবর প্রচারিত হলেও মেনে চলার প্রবণতা মনে হচ্ছে খুব একটা অনুসৃত হচ্ছে না। এর পরিণতি যদি সত্যি সত্যি আমাদের ভোগ করতে হয় তাহলে দেখার সৌভাগ্য কতজনের হবে বলা মুশকিল।

আমাদের হতদরিদ্র মানুষদের বেঁচে থাকার উপায় আমাদের বের করতেই হবে। তাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা জরুরি। সরকার বলছে, সরকারের হাতে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে। দেড়-দুই কোটি মানুষের খাদ্যের সংস্থান করা সরকারের পক্ষে সাময়িকভাবে হয়তো করা সম্ভব। তবে এই পরিস্থিতি বেশি দিন চললে সরকারের একার পক্ষে হতদরিদ্র মানুষদের দায়িত্ব নেওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া করোনাভাইরাস উপেক্ষা করে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা খুবই ঝুঁঁকিপূর্ণ কাজ। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি এবং উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সরকারের খাদ্য সহযোগিতার সমন্বয় সাধন করে হতদরিদ্র এবং কর্মহীনদের খাদ্য সাহায্য দেওয়া গেলে এক্ষেত্রে অপচয় যেমন- রোধ করা সম্ভব হবে, একইভাবে বণ্টন সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্ন করা সম্ভব হতে পারে। প্রকৃত অভাবীদের খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার সহজ ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। একই সঙ্গে বস্তিবাসীসহ হতদরিদ্র মানুষদের বসবাসের বর্তমান ঘিঞ্জি পরিবেশকে কীভাবে স্বাস্থ্যসম্মত ও করোনা সংক্রমণমুক্ত করা যাবে সেটিও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। সেটি করতে দেরি হলে করোনার প্রাদুর্ভাব কতটা শহর এবং গ্রামে ঠেকানো যাবে সেটি নিয়ে আমার গভীর সন্দেহ আছে। উন্নত দেশগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের অবস্থা এখন আমরা যেমন দেখছি সেটি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের জনঘনত্ব অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কী রূপ হতে পারেÑ সেটি ভাবতেই আঁতকে উঠতে হয়। আমাদের এখানে ঘন জনবসতিপূর্ণ শহর এবং গ্রামগুলোতে যেসব অব্যবস্থা, অসচেতনতা, হেলাফেলা, অন্ধত্ব, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অজ্ঞানতা ও নিয়তিবাদিতা বিরাজ করছে তার পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে সেটি সবাইকে ভেবে দেখার অনুরোধ করব।

আমাদের বেশির ভাগ মানুষই ভাইরাস সংক্রমণের পূর্ব ইতিহাস খুব একটা জানেন না। ভাইরাস সম্পর্কেও বেশির ভাগ মানুষেরই কিটতাত্ত্বিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞানগত ধারণা নেই। ফলে অনেক কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস তাদের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। চার-পাঁচ দশক আগে কলেরা, ডায়ারিয়া মহামারিতে যখন বিনা চিকিৎসায় হাজার হাজার মানুষ মারা যেত তখন এটিকে মানুষের পাপের পরিণতি হিসেবে বিশ্বাস করা হতো। অথচ এসব সংক্রমণ ব্যাধিতে অসংখ্য শিশু মারা যায়। শিশুদের এভাবে মৃত্যুর কোনো জুতসই জবাব কেউ খুঁজত বলে মনে হয় না। সেই কলেরা, ডায়ারিয়া, স্যালাইন উদ্ভাবনের পর আর কোনো অতি প্রাকৃতিক শক্তির প্রতিশোধের গল্প কলেরাকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে এখন কেউ বিশ্বাস করাতে পারছে না। এই দেশেই এক সময় যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত ইত্যাদি মহামারিতে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। যেকোনো মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটলে মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে নিকটবর্তী আত্মীয় স্বজন এর কাছে আশ্রয় নিত। সেখানেও মহামারিটি ছড়িয়ে পড়ত। তারা জানত না তারা সংক্রামক রোগ বহন করছে। ফলে একেকটি রোগ মানুষের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ত এবং বিনা চিকিৎসায় অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করত। এসব মহামারি তাদের কাছে ছিল প্রকৃতির নির্দয় অভিশাপ আর মানুষের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার এক স্বাভাবিক নিয়মÑ যা মানুষের নিয়তিতে পূর্বনির্ধারিত বলে বিশ্বাস করা হতো। এটি শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্র সংক্রমণজনিত কারণ ও চিকিৎসা জানা না থাকার কারণে মানুষ সামাজিকভাবে বিশ্বাস করে এসেছিল। আদিম গোত্রীয় সমাজে সংক্রমণজনিত রোগের প্রাদুর্ভাবে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল, অনেক গোত্রই প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। সভ্যতায় উত্তরণের পরও মহামারির প্রাদুর্ভাব অব্যাহত ছিল। প্রাচীন সভ্যতার সবক’টিতেই মহামারিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর ঘটনা স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবেই ছিল। কারণ প্রতিরোধ করার মতো ওষুধ তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এখন থেকে ৫ থেকে ৬ হাজার বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায় এক ধরনের প্রতিষেধক ভেষজ উপায়ে গোত্রীয় চিকিৎসকরা উদ্ভাবন করেছিলেন। অন্য অঞ্চলের মানুষ সেসব সম্পর্কে অনেক পরে কিছু কিছু জেনেছে। কিন্তু ততদিনে মহামারির বিষয়টি আগের মতই মানুষের সংক্রমিত মৃত্যুর ভাইরাস হিসেবে চলে আসছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের সংক্রমণজনিত রোগের বিস্তারে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু যেন এক নিয়তির বিষয় হিসেবে চলে এসেছিল। সবচাইতে বড় ধরনের মহামারি সংঘটিত হয় ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ায় যখন অপরিকল্পিতভাবে নগর গড়ে উঠছিল। ১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ সালে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও পূর্ব এশিয়া, মিসর, চীনসহ বিশাল এই অঞ্চলে কালো মড়ক তথা নষধপশ ফবধঃয মহামারিতে সেই সময়ের পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগের বেশি তথা ২০০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। ইউরোপের কোনো কোনো অঞ্চলের ৬০ শতাংশ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেছিল। মধ্যপ্রাচ্যে জেরুজালেম, দামাস্ক, মক্কা, মউসি, বাগদাদসহ অন্যান্য শহর এবং জনবসতি প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। মিসর, মধ্য এশিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন এই মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাস কালো মড়ককে ভুলতে পারেনি। লাতিন আমেরিকায় ইউরোপীয়দের নেওয়া সংক্রমক ব্যাধিতে আদিবাসীদের বড় অংশই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর অনেক শাসক, রাজা-বাদশাও এসব সংক্রমক ব্যাধিতে মৃত্যুবরণ করেছেন। পর্তুগিজ রাজপুত্র ডম পেদ্রো ছিলেন ব্রাজিলের প্রথম সম্রাট। পর্তুগালের সিংহাসনে বসার জন্য ফিরে এলেন কিন্তু মরণ ব্যাধি যক্ষ্মা তার সেই স্বাদ পূরণ করতে দেয়নি (১৮৩৫ খ্রি.)। ইতিহাসে এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যা খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। আমি এই মহামারিগুলোর ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মহামারি সম্পর্কে ঐতিহাসিক ধারণা লাভ করে সবাই যেন সচেতন হওয়ার চেষ্টা করেন। সম্প্রতি করোনায় আক্রান্তদের তালিকায় অনেক দেশেরই শাসক, প্রশাসক এবং প্রভাবশালীদের নাম উঠে এসেছে। এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের এমন উন্নতির যুগেও আমাদের করোনাভাইরাসের মতো সংক্রমণ ব্যাধির এমন আলামত দেখতে হচ্ছে যা ভাবতেও বেশ কষ্ট হয়। সুতরাং করোনাভাইরাসকে নিয়ে হেলাফেলা কিংবা কম গুরুত্ব দেওয়ার পরিণতি আমাদের জন্য কি হতে পারে আমরা তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তবে আগামী কয়েকটি দিন আমাদের অবশ্যই ধৈর্য ধরতেই হবে, করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ মেনে চলতেই হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে জনবহুল এই দেশে মারাত্মক কোনো বিপর্যয় ঘটা খুব বেশি অস্বাভাবিক হওয়ার বিষয় নয়। কারণ সংক্রমণ ব্যাধির বিস্তার যত বেশি ঘটবে এর আর্থসামাজিক প্রতিক্রিয়াও তত বেশি ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সে কারণে এখনই সবকিছুকে টেনে ধরতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে হবে, হতদরিদ্রদের খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close