দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ৩১ মার্চ, ২০২০

বিভ্রান্তি

যারা গুজব ছড়ায় তারা রাষ্ট্রের শক্র

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে জনজীবনে যেমন কল্যাণ নিশ্চিত হয়, তেমনি এর অপব্যবহারে অকল্যাণ থাবা বিস্তার করে। করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে সামাজিক গণমাধ্যমে ইবলিশের বরপুত্ররা সক্রিয় হয়ে ওঠায় জনজীবনে সৃষ্টি হচ্ছে বিভ্রান্তি। ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। দেশে খাদ্যপণ্যের মজুদ এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। চাহিদার তুলনায় মজুদ অনেক বেশি হওয়ায় সরকার চাল রফতানি এবং রফতানিকারকদের আর্থিক সহায়তাদানেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

দেশে আগামী এক বছরের মতো পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ থাকা সত্ত্বেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একদল মতলববাজ অথবা মহামূর্খের অপপ্রচারে গত কয়েক দিন ধরে বাজারে খাদ্যপণ্যের কেনাকাটায় ধুম পড়ে যায়। তাতে লাভবান হন অসৎ ব্যবসায়ীরা। চাল, পেঁয়াজ, আদা, ডালসহ অনেক পণ্যের দাম ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। অথচ বাস্তবতা হলো, গত ১৬ মার্চ পর্যন্ত দেশে সরকারি পর্যায়ে খাদ্য মজুদ রয়েছে ১৭ লাখ ৫১ হাজার টন। চাল রয়েছে ১৪ লাখ ২৯ হাজার টন, গম ৩ লাখ ২২ হাজার টন। তবে সরকারি মজুদের চেয়ে অনেক বেশি খাদ্য মজুদ রয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে। দেশের চাল মিল, পাইকার, আমদানিকারক, খুচরা ব্যবসায়ী এবং কৃষক পর্যায়েও বিপুল পরিমাণ খাদ্য মজুদ রয়েছে। এর বাইরে আটা, ময়দা, তেল, ডাল, চিনিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য প্রচুর মজুদ রয়েছে। আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করে ছোলা, খেজুরসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যও আমদনি করা হচ্ছে। চাহিদার সিংহভাগই দেশে মজুদ থাকায় এ নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, আটা ও শাকসবজি। এগুলো সবই অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে নিত্যপণ্য নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। করোনাভাইরাসের কারণে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন, এর জন্য খাদ্য চাহিদা কিছুটা বাড়বে। কিন্তু ১৮ কোটি মানুষের দেশে ৬ বা ৭ লাখ অতিরিক্ত মানুষের খাদ্য তেমন চিন্তার বিষয় নয়। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও চাল রফতানি করা হচ্ছে। তাছাড়া সামনেই বোরো মৌসুম। এ মৌসুমেও বাম্পার ফলনের আশা করা হচ্ছে। আশার কথা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। এর পাশাপাশি গুজব যারা ছড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের সামাল দিতে সরকারকে কঠোর হতে হবে।

সময়ে সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়েছে। এ গুজবের খেসারতে প্রাণও হারিয়েছে বহু মানুষ। সাম্প্রদায়িক সহিংসতারও সৃষ্টি হয়েছে নানা সময়ে। রাজনৈতিক বা বিভিন্ন গোষ্ঠী এ গুজব ছড়িয়ে ফায়দা লুটিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা করেছে। তবে বিভিন্ন গুজবরোধে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিতে দেখা গেছে।

পদ্মা সেতুতে লাগবে শিশুর মাথা, নিখোঁজ হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, বেসিনে হারপিক ঢাললে মরবে এডিস মশাÑ এমন সব গুজব ছড়িয়েছে বাংলাদেশে। গুজবে কান দিয়ে জামায়াত নেতা সাঈদীকে চাঁদেও দেখেছিলেন কেউ কেউ।

পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা : পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে মানুষের মাথা লাগবে বলে যে খবর রটে যায়। এরপর সেতু কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়ে জানান এটি গুজব। কিন্তু ততক্ষণে বিকারগ্রস্ত জনতার হাতে গণপিটুনিতে বহু মানুষের প্রাণ শেষ হয়েছে।

চাঁদে সাঈদী : ২০১৩ সালের মার্চে মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিত সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। এই খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে জামায়াত ও বিএনপির কর্মীরা দেশেজুড়ে তান্ডব চালায়, গুলি ছুড়তে বাধ্য হয় পুলিশ।

নিখোঁজ স্যাটেলাইট : ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিখোঁজ’ শিরোনামে একটি খবর বেনামি কিছু ওয়েবপোর্টাল ও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে সরকারি ভাষ্যে এ খবরকে গুজব বলে নিশ্চিত করা হয়।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে হারপিক : কমোডে বা বেসিনে হারপিক ও ব্লিচিং পাউডার ঢেলে এডিস মশা মারার একটি বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরে বিশেষজ্ঞরা এটিকে গুজব বলে উড়িয়ে দেন। হারপিকের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও জানায়, এই তথ্যের কোনো সত্যতা নেই।

ছেলেধরা গুজব : পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে এমন গুজব ছড়িয়ে শিশুদের ধরে নেওয়া হচ্ছে বলে ‘ছেলেধরা’ গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ছেলেধরা সন্দেহে কয়েকজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে এ নিয়ে সতর্কবার্তা জারি করে সরকার। এই গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতার করে।

বিদ্যুৎ বন্ধ : ছেলেধরা গুজবের রেশ না কাটতেই দেশের বিভিন্ন স্থানে তিন দিন বিদ্যুৎ বন্ধ রেখে বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে বলে ম্যাসেঞ্জারেরর মাধ্যমে গুজব ছাড়িয়ে পড়ে। পরে বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, এই খবরটি সঠিক নয়।

মোটরযান আইন : সংশোধনী মোটরযান আইন অনুযায়ী জরিমানার পরিমাণ সর্বোচ্চ এক হাজার গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা ঠিক নয় বলে জানানো হয়।

ভুয়া নোট : এক পাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্য পাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ছবি সংবলিত নতুন ১০০ টাকার নোট বাজারে ছাড়া হয়েছে জানিয়ে সেই নোটের একটি ছবিও ছড়িয়ে যায় ফেসবুকে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায় এই তথ্য ভুয়া।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা গুজব ছড়ায় তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শক্র। তাদের চিহ্নিত করা সময়ের দাবি। গুজবের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হোক।

লেখক : সহসভাপতি, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close