সাহাদাৎ রানা

  ৩১ মার্চ, ২০২০

মতামত

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম

শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। পুরো পৃথিবীর অনেক সত্যের মধ্যে অন্যতম বড় সত্য এটি। এই ধ্রুব সত্য সব রাষ্ট্রের পাঠ্যসূচিতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। আর তা রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেই শিশুদের দেখা হয় আলাদা দৃষ্টিতে। তাদের ভাবা হয় রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে। বিশেষ করে শিশুর গড়ে ওঠার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখাও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবেই পালন করে থাকে রাষ্ট্র। কিন্তু আমাদের দেশে এই বিষয় নিয়ে কতটা ভাবা হয় তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ দিনকে দিন আমাদের দেশে শিশুরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। বাড়ছে শিশুদের নির্যাতনের চিত্রও। বিশেষ করে বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি সত্যিই উদ্বেগজনক। যেখানে অন্যসব দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমছে, সেখানে আমাদের দেশে বাড়ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন আইনের ভাষায় আমাদের দেশে কারা শিশু। আর শিশুশ্রম বিষয়টি কী? সাধারণত পৃথিবীজুড়ে ১৮ বছরের কম বয়সি সবাইকে শিশুর সংজ্ঞায় ফেলা হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও কাগজপত্রে বিষয়টি মানা হলেও বাস্তব চিত্র অবশ্য ভিন্ন। মূলত বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিশুদের তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। শৈশবকাল বলা হয়েছে এক থেকে পাঁচ বছরকে। যাদের বয়স ছয় থেকে ১০ বছর পর্যন্ত তাদের বিবেচনা করা হয় বাল্যকাল হিসেবে। আর ১১ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত সময়কে বলা হয় কৈশোরকাল। অবাক করা তথ্য হলো এই তিন শ্রেণি বিবেচনা করলে আমাদের দেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার অর্ধেক শিশু। তাই সহজ কথায় বলা যায়, আমাদের দেশের অর্ধেক সম্পদ এই শিশুরা। কিন্তু এই শিশুদের আমরা নানা কারণে সম্পদে রূপান্তরিত করতে পারছি না। বরং শিশুরা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নানা কারণে তাদের বঞ্চিতও করছি আমরাই। তাই এর দায় এককভাবে কারো ওপর নয়। দায় আমাদের সবার।

ভয়ের তথ্য হলো দিন দিন আমাদের দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। কিন্তু তা প্রতিরোধে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। অথচ আমাদের দেশে আইনে স্পষ্টভাবে লিখিত আছে শিশুশ্রম একটি মারাত্মক অপরাধ। কিন্তু আইনে থাকলেও প্রতিনিয়ত শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। এটাই এখন শঙ্কার বড় কারণ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সরকারি পর্যায় ছাড়া বর্তমানে আমাদের দেশে এমন কোনো কর্মক্ষেত্র নেই যেখানে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। শিশুদের শ্রমের মূল্য তুলনামূলক অনেক কম হওয়ায় তাদের প্রায় সব কর্মক্ষেত্রেই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এই সহজলভ্যতার কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিশুশ্রমিকদের পদচারণা বাড়ছেই। অবাক করা বিষয় কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা এতটাই বেশি যে, তা কল্পনাতীত। অথচ আমাদের দেশে জাতীয় শ্রম আইন ২০১৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের কোনো প্রকার কাজে লাগানো যাবে না, ১৪ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সি শিশুদের কিছু নির্দিষ্ট কাছে ব্যবহার করা যাবে বলে উল্লেখ রয়েছে। এবং তা হতে হবে নিয়ম মেনে। সর্বোচ্চ দৈনিক পাঁচ ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণ করা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে। কিন্তু এর কোনোটাই শিশু শ্রমিকের ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। বরং তাদের দিয়ে বাড়তি কাজ করিয়ে লাভবান হচ্ছে মালিকপক্ষ।

শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করার মূল কারণ হলো দেশের প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে মালিকপক্ষ। বলা যায় আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবের পাশাপাশি নিজ স্বার্থের কারণে আইনকে তোয়াক্কা করেন না মালিক শ্রেণি। এছাড়া আরো কিছু কারণ রয়েছে শিশুশ্রমিক বৃদ্ধির পেছনে। অন্যতম কারণ আমাদের দেশের দারিদ্রতা। আমাদের দেশে প্রায় মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ ভাগের বেশি লোক দরিদ্র। যাদের অধিকাংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির আয় দিয়ে সংসার চালান। যা সত্যিই কষ্টসাধ্য। তাই দরিদ্র এসব লোক সংসার চালানোর জন্য অনেকটা বাধ্য হয়ে নিজের শিশু সন্তানকে পাঠান কর্মক্ষেত্রে। বাবা-মার সঙ্গে অপরিপক্ক শিশুরা হয়ে ওঠেন উপার্জনের আরেকটি উৎস। এতে ওইসব পরিবার তাদের প্রয়োজনে সাময়িক লাভবান হলেও ভবিষ্যতে ক্ষতি হচ্ছে পরিবারের। বৃহত্তর বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রের। কারণ এসব শিশুরা নিজ পরিবারের আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ছেড়ে দিতে হচ্ছে স্কুল। বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার আলো থেকে। আর রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে পুরোপুরি শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে ওঠতে। আর এদের থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক মেধাবিরাও। এর কারণে শুধু পরিবার নয়, বঞ্চিত হচ্ছেন রাষ্ট্রও।

আমাদের দেশে শিশু শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে অস্বস্তির খবর হলো যেসব শিশু কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার উপযোগী নয়, সেই শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের দেশে সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোতেই শিশুদের যুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ইটভাটা, ইলেকট্রিকের কাজ, গাড়ির ড্রাইভার, নির্মাণ খাত, গাড়ির হেলপার, গ্যারেজ, শিল্প-কারখানা, বাসা-বাড়িসহ অসংখ্য কাজে শিশুরা শ্রমিক হিসেবে যুক্ত। এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখের বেশি শিশু, শিশুশ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১০ লাখের বেশি শিশু। এসব শিশুরা তাদের কর্মক্ষেত্রে নানা রকম বৈষম্যের শিকারও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা। বিশেষ করে যেসব শিশু বাসা-বাড়িতে কাজ করে তারা সারা দিনই কাজের মধ্যে থাকেন। আর শিল্প-কারখানায়ও নেই নির্দিষ্ট সময়। মালিকের ইচ্ছায় তাদের কাজ করতে হয়। বলা যায় মালিকের ইচ্ছায় বাধ্য হন তারা। এছাড়া রয়েছে কাজের একটু ব্যতিক্রম হলে চরম নির্যাতনের শিকার হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ। মাঝে মাঝে শিশু শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাও আমরা প্রত্যক্ষ করছি। আরো দুখের বিষয় অনেক কষ্ট করে এসব শিশুরা তাদের কর্মক্ষেত্রে রাত-দিন পরিশ্রম করলেও পান না ন্যায্য মজুরি। তাদের কাজের বিনিময়ে যা দেওয়া হয় তা নেহাত একেবারে অল্প। আমাদের দেশে শিশুদের দিয়ে কিছু অসাধু মানুষ আরো একটি বিপজ্জনক কাজ করান। কোমলমতি শিশুদের দিয়ে মাদক পাচার থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। কিন্তু যারা এর সঙ্গে যুক্ত তারা থেকে যাচ্ছেন ধরা-ছোয়ার বাইরে।

এখন প্রশ্ন হলো এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? উত্তরণের পথ অবশ্যই রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এ ছাড়া দায়িত্ব রয়েছে পরিবার ও সমাজের সচেতন মানুষের। বিশেষ করে রাষ্ট্র ও যারা বিত্তশালী, তারা যদি দরিদ্র শিশুদের বিশেষ তহবিলের আওতায় আনে, তবে অনেকাংশে কমানো যেতে পারে শিশুশ্রম।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close