এস এম মুকুল

  ২৯ মার্চ, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

যক্ষ্মা : মরণঘাতী নয় নিরাময়যোগ্য

যক্ষ্মা একটি সংক্রামক ব্যাধি। যা প্রধানত ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। যক্ষ্মা বলতে সাধারণভাবে আমরা ফুসফুসের যক্ষ্মাকেই বুঝি। তবে ফুসফুস ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে যক্ষ্মা হতে পারে। যেমন- লসিকাগ্রন্থি, হার ও গিট, অন্ত্র, হৃদপিন্ডের আবরণ ও মস্তিষ্কের আবরণ ইত্যাদি। যক্ষ্মা এখন আর মরণঘাতী রোগ নয়। যক্ষ্মা নিরাময়যোগ্য, নিয়মিত ওষুধ সেবন করলে যক্ষ্মা ভালো হয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে সফলতা পাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে জনগণের মধ্যে আরো সচেতনতা বাড়াতে হবে। যক্ষ্মা উপসর্গ দেখা দিলে রোগীদেরও সচেতন হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ন্যাশনাল টিউবারকিউলোসিস প্রিভেলেন্স সার্ভে বাংলাদেশ ২০১৫-১৬ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে প্রতি লাখে ২৬০ জন মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত। এদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। তবে গ্রামের তুলনায় শহরে যক্ষ্মা আক্রান্তের হার বেশি। সারা দেশে ১ লাখ মানুষের ওপর পরিচালিত এ জরিপে দেখা গেছে, নারীদের তুলনায় পুরুষের মধ্যে যক্ষ্মা আক্রান্তের হার বেশি। প্রতি ১ লাখে ৪৫২ জন পুরুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত, এর বিপরীতে নারী লাখে ১৪৩ জন। বৃদ্ধদের মধ্যে যক্ষ্মায় আক্রান্তের হার বেশি। এছাড়া গ্রামের তুলনায় শহরে যক্ষ্মা রোগী বেশি। যদিও দেশে যক্ষ্মা এখনো জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আছে। তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যক্ষ্মার প্রকোপ এবং ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার প্রকোপ বেশি এমন দেশের তালিকা তৈরি করেছে। দুটি তালিকাতেই বাংলাদেশের নাম আছে। তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে যক্ষ্মায় ৬৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আর ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ নতুন করে যক্ষ্মার জীবাণুতে আক্রান্ত হয়। আর ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় (এমডিআর টিবি) আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৩০০। ডব্লিউএইচওর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি লাখে ৪০০ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত। কিন্তু নতুন জরিপে দেখা যাচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা ৪০০ থেকে ২০৬ জনে নেমে এসেছে। সেই হিসাবে বাংলাদেশে যক্ষ্মার প্রাদুর্ভাব কমেছে।

১৮৮২ সালের জার্মান চিকিৎসক ডা. রবার্ট কক যক্ষ্মার মারাত্মক জীবাণু মাইক্রো ব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস চিহ্নিত করেন। মূলত এর ফলেই যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত ও প্রতিকার সম্ভব হয়। ড. ককসের ঘোষণার শতবর্ষ পালনের বছরই বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর পালিত হচ্ছে দিনটি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে বছরে ৬৬ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় মারা যায়। যক্ষ্মা আক্রান্ত ৩৩ শতাংশ রোগী এখনো চিকিৎসার বাইরে। দেশে যক্ষ্মা শনাক্তকরণ আধুনিক যন্ত্রের স্বল্পতা আছে। জানা যায়, দেশে যক্ষ্মা রোগী শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে সমস্যা থাকলেও ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় সাফল্য ৯৫ শতাংশ। দেশে যক্ষ্মা নির্ণয়, সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। ব্র্যাকসহ ২৬টি এনজিও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সহাযতা করছে।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বা এনটিপির হিসেবে ১৯৯৫ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে প্রায় ৩০ লাখ যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে শিশু রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। বিশেষজ্ঞদের মতে যক্ষ্মা হলে অল্পমাত্রার জ্বর সাধারণত বিকালের দিকে আসে। কাজকর্মে আগ্রহ কমে যায়। ক্ষয়রোগ হতে পারে। সাধারণত তিন সপ্তাহের বেশি কাশি বা দুই সপ্তাহের বেশি জ্বর চলতে থাকলে যক্ষ্মা হয়েছে বলে সন্দেহ করা উচিত, যদি অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিক সেক্ষেত্রে কাজ না করে। এই সন্দেহই চিকিৎসককে দেবে রোগ নির্ণয়ের সঠিক নির্দেশনা। ফুসফুসে যক্ষ্মা হলে কাশির সঙ্গে রক্ত যায় এটা যেমন ঠিক, তেমনি আবার যক্ষ্মা ছাড়া ফুসফুসের অন্যান্য রোগেও কাশির সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। যেমন- ব্রংকাইটিস, ফুসফুসে ফোঁড়া, ফুসফুসের ক্যানসার, নিউমোনিয়া ইত্যাদি। তাই যখনই কারো খুসখুসে কাশি দেখা দেবে, জ্বর দুই-তিন সপ্তাহ পর্যন্ত থাকবে তখনই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে যক্ষ্মার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা নেওয়া বা সতর্ক হওয়া উচিত।

এটা যেহেতু ছোঁয়াচে রোগ, তাই প্রয়োজন সতর্কতা। যক্ষ্মা আক্রান্তের হাঁচি-কাশি থেকে অন্যান্য সুস্থ লোকজনের মধ্যে এর জীবাণু ছড়িয়ে যেতে পারে। তাই আক্রান্ত রোগীদের যেখানে সেখানে কফ-কাশি না ফেলে একটা আলাদা পাত্রে বা স্থানে ফেলা উচিত যাতে বাতাসে ছড়িয়ে না যায়। দেশের প্রায় সব জায়গায় যক্ষ্মার চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা কিংবা কমিউনিটি ক্লিনিক, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, গার্মেন্ট কর্মীদের চিকিৎসা কেন্দ্র, জেলখানায় যক্ষ্মার চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্তদের জন্য ৯টি বিশেষ চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে।

ডায়াবেটিস ও যক্ষ্মা যেন এক মায়ের দুই সন্তান। স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে ডায়াবেটিস এবং যক্ষ্মা অন্যতম। বিভিন্ন কারণে যেমন কায়িক পরিশ্রম কম করা, খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন, বংশগত এবং অন্যান্য কারণে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে যক্ষ্মা যা একটি জীবাণুঘটিত রোগ, আমাদের সমাজে সব সময় বিদ্যমান এবং প্রধানত দরিদ্র শ্রেণি বেশি আক্রান্ত হয়।

বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা রোগ বিস্তারের অন্যতম কারণ হলো HIV এবং AIDS রোগের ব্যাপকতা। যেহেতু যক্ষ্মা একটি জীবাণুঘটিত রোগ, তাই যেসব রোগে বা কারণে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, সেই রোগীদের যক্ষ্মা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। আমাদের দেশে এখনো AIDS রোগের ব্যাপকতা এত বেশি নয়। কিন্তু একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। আর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ। ডায়াবেটিস রোগী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলে অনেক ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় করতে যথেষ্ট দেরি হয়ে যায় কারণ ডায়াবেটিস রোগীদের যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ সাধারণ যক্ষ্মা রোগীদের মতো নাও হতে পারে। যদিও যক্ষ্মা রোগে প্রধানত ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে থাকে, কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে ফুসফুসবহির্ভূত যক্ষ্মা আক্রান্তের হার অনেক বেশি। যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের অন্যতম পদ্ধতি হলো কফ পরীক্ষা করা এবং বুকের X-ray করা। এই দুই ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক সময় X-ray তে যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ সঠিকভাবে প্রকাশ পায় না এবং কফের মধ্যে জীবাণু পাওয়ার হার অনেক কম। তাই ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে যক্ষ্মারোগ নির্ণয়ের জন্য High Degree of suspicion দরকার। যদি কোনো ডায়াবেটিস রোগী জ্বর-কাশিতে ভোগে এবং বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরেও অবস্থার উন্নতি না হয়, তখন যক্ষ্মা রোগের বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।

শনাক্তের বাইরে থাকা যক্ষ্মা রোগীরা কিংবা যারা চিকিৎসা

পুরোপুরি শেষ করেন না তাদের কারণেই এটি বাড়ছে বলে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন। তাই শনাক্তের বাইরে থাকা যক্ষ্মা রোগীরা কিংবা যারা চিকিৎসা পুরোপুরি শেষ করেন না তাদের কারণে বাংলাদেশে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআর। এ প্রসঙ্গে ঢাকায় আইসিডিডিআরবির একজন বিজ্ঞানী ড. সায়েরা বানু বলছেন, বছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। কিন্তু আক্রান্ত অনেক রোগী ওষুধের ফুল কোর্স সেবন না করায় পরিণত হচ্ছেন ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীতে। যাদের ডায়াগনোসিস হয় না বা ওষুধ খায় না তাদের কারণেই ঝুঁকি বাড়ছে। চিকিৎসা না হলে প্রতিটি রোগী আরো ১০ জনকে আক্রান্ত করাতে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ৫ হাজার রোগীর মধ্যে ৪ হাজার শনাক্তের বাইরে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ভয়ের কারণ নেই। কারণ শনাক্ত করতে অত্যাধুনিক জিন এক্সপার্ট পরীক্ষা চলে এসেছে যার মাধ্যমে দুই ঘণ্টায় পরীক্ষা করা যায়। এ ধরনের ১৯৩টি যন্ত্র বাংলাদেশে এসেছে। আর এখন বাংলাদেশই এমন পদ্ধতি বের করেছে যাতে ৯ মাসেই রোগীদের ভালো করা যায়। চিকিৎসকদের মতে, সাধারণ চিকিৎসা তাদের জন্য আর কার্যকর থাকছে না, শনাক্ত করার পর তাদের জন্য প্রয়োজন হয় আরো দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার এমনটাই মনে করছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।

লেখক : সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close