নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৮ মার্চ, ২০২০

পর্যালোচনা

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থসংরক্ষণ জরুরি

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দেশে প্রায় সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়েছে। নীরব-নির্জন হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের

বিভিন্ন শহর। বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ বাসাবাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। বয়স্ক মানুষরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বেশি। কারণ যাদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ ও কিডনি রোগ আছে, তাদের এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে সংক্রমণের সম্ভাবনা অধিক। তাই তাদের অনেকে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হয়ে আছেন। যাচ্ছেন না জনসমাগমপূর্ণ স্থানে। প্রসাধনি, জুয়েলারি, শাড়ি, লুঙ্গি, কাপড়, হার্ডওয়্যার ও তৈরি পোশাকের দোকানগুলোতে বেচাকেনা একেবারে কমে গেছে। মানুষ এক অজানা আতঙ্কে ভুগছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার প্রতিই মানুষের আগ্রহ বেশি। এসব কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দিনমজুর, খেতমজুর, কুলি, ভ্যান, রিকশাচালকসহ স্বল্প আয়ের মানুষ। বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের বিপদও কম নয়। এসব প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন সংকট ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিনামূলে সরকারিভাবে সরবরাহ করার জন্য দাবি জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দলসহ সামাজিক সংগঠন। তাদের মতে, রাজধানী ঢাকা শহরে কমপক্ষে ৪০ লাখ ভাসমান শ্রমজীবী ও পেশাজীবী মানুষের বাস। করোনার কারণে এসব প্রান্তিক মানুষ কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপনের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। এছাড়া দেশের ৪ হাজার ৫৬০টি পোশাক কারখানায় রয়েছে ৪০ লাখ শ্রমিক। ইতোমধ্যেই ৯০টি পোশাক কারখানায় ১০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করা হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৮৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি। পোশাক রফতানির বড় বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় আরো ক্রয়াদেশ বাতির ও স্থগিতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তখন পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রকিদের জীবনেও নেমে আসবে অনিশ্চিত অন্ধকার।

উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিশিয়ায় করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সাধারণ অবরোধ (লকডাউন) ঘোষণা করা হয়েছে। গত ২১ মার্চ, দেশটির প্রেসিডেন্ট এ ঘোষণা দেন। এ পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৪ এবং মৃতের সংখ্যা একজন। এরই মধ্যে দেশটিতে ব্যাংক, রেস্তোরাঁ ও মসজিদ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দরিদ্রদের জন্য আগামী ছয় মাস ঋণ পরিশোধ বন্ধ রেখেছে তিউনিশিয়া। জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট কায়েস সায়েদ জনগণকে ভীত ও আতঙ্কিত না হয়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের না হওয়ার আহ্বান জানান এবং উল্লেখ করেন জাতির এই দুর্দিনে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনগণের খাবার, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মতো জরুরি সেবা প্রদান নিশ্চিত করা হবে।

করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্যের সব নাগরিকের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিল কেরালার বামপন্থি সমাজতান্ত্রিক সরকার। এ সংকটে নাগরিকদের সুরক্ষায় সংকটকালীন বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। করোনা শুধু স্বাস্থ্য সমস্যাই নয়, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক সমস্যা। এসব দিক বিবেচনা করেই কেরালার প্রতিটি নাগরিকের জন্য এক মাস বিনামূল্যে খাবার জোগান দেবে পিনারাই বিজয়ের সরকার। কার কত আয় এসব বিষয় বিবেচনা না করে সবার জন্য সমান এবং একই ধরনের রেশন চালু থাকবে সংকটকালীন। ফলে করোনায় লকডাউন ঘোষণাকালীন সাধারণ মানুষ সংকটে পড়বে না। শুধু বিনামূল্যে রেশনই নয়, রাজ্য ও রাজ্যবাসীর জন্য একগুচ্ছ কল্যাণকর ও ইতিবাচক পদক্ষেপের কথাও ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেন। কোভিড-১৯ ভাইরাসের কবল থেকে রাজ্যের প্রতিটি মানুষকে বাঁচাতে যেমন কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে বিজয়ন সরকার, তেমনি রাজ্যের অর্থনীতিকে চাঙা রাখতেই মুখ্যমন্ত্রীর এই শক্তিশালী উদ্যোগ। রাজ্যে কমপক্ষে ৫০ লাখ মানুষ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা ভাতা পেয়ে থাকেন। সেই ভাতাও দুই মাসের আগাম হিসেবে দেওয়া হবে এ মাসেই। গত ২০ মার্চ পর্যন্ত কেরালায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২৮ জন। তাদের মধ্যে হাসপাতালে রয়েছেন ২৩ জন। নজরদারিতে আছেন ৩১ হাজার ১৭৩ জন। সংক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি রাজ্যকে বিপর্যয় থেকে টেনে তুলতে কেরালা রাজ্য সরকারের গৃহীত মানবতাবাদী এই পদক্ষেপ সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ মার্চ বিশ্বব্যাপী মহামারি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস বিশ্বের ১৮৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাসে চীনে ৮১ হাজারের অধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। সেখানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৫ জন। সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে চীনে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে করোনাভাইরাস। চীনে শুরু হলেও বর্তমানে করোনাভাইরাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ইউরোপ। এক মাস পর হানা দিলেও ইতালিতে মৃতের সংখ্যা চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। নানা পদক্ষেপ গ্রহণের পরও ইতালিতে প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এ পর্যন্ত ইতালিতে মৃত্যু হয়েছে ৪ হাজার ৩২ জনের। আক্রান্ত হয়েছে ৪৭ হাজার ২১ জন। চিকিৎসাধীন ৩৬ হাজার ৮৬০ জনের মধ্যে ২ হাজার ৬৫৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এছাড়া যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও ভয়াবহ। করোনায় ইরানও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেখানে এ যাবৎ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৫৫৬ জন। নতুন ৯৬৬-সহ মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৬১০ জন। এছাড়া চীনের প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮২ হাজার ৭১৯ জন। মৃতের সংখ্যা ১০২ জন। জাপানে আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৭ জন। মারা গেছেন ৩৫ জন। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২৮০ জন, মারা গেছেন পাঁচজন। সেখানে জনতার কারফিউ ঘোষণা করেছে মোদি সরকার। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ২৭ জন, মারা গেছেন চারজন। এমনই এক সংকটময় পরিস্থিতিতে ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে প্রয়োজনে জরুরি অবস্থা জারির পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। একই সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কোনো কোনো শহর লকডাউন করা উচিত বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ১১৫ লোকের বাস। দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থনৈতিক অবস্থাও চীন, ইতালি, দক্ষিণ ও কোরিয়ার মতো নয়। সে ক্ষেত্রে কেরালার বাম সরকারের মতো বাংলাদেশ সরকারকেও প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্যাকেজ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। দিতে হবে বিনামূল্যে সংকটকালীন রেশন। হাত ধোয়া ও পরিষ্কার-পরিছন্নতার জন্য সাবান, হ্যান্ডওয়াশ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার। দুই মাসের জন্য অগ্রিম সামাজিক সুরক্ষা ভাতা। শুধু ঢাকা-চট্টগ্রামে নয়, সারা দেশের জেলা হাসপাতালগুলোতে রোগ শনাক্তকরণের পরীক্ষা, সঙ্গনিরোধ ও চিকিৎসাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে আর্মি মেডিকেল কোরের সাহায্য নিতে হবে। রোগ শনাক্তকরণ কাজে সাহায্য নেওয়া যেতে পারে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে ডাক্তার ও নার্সদের জন্য প্রয়োজনীয় পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্টের (পিপিই) ব্যবস্থা করতে হবে। সেইসঙ্গে প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় সরকারের সব স্তরের প্রতিনিদের নিজ এলাকায় বিদেশ থেকে আগত প্রবাসীদের শনাক্তকরণ ও হোম কোয়ারেন্টাইনের নিশ্চিত করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য যাতে ভোক্তাদের সাধ্যের মধ্যে থাকে, সে ব্যাপারেও সরকারের পদক্ষেপ অব্যাহত রাখতে হবে। ভাবনার বিষয়, এ পর্যন্ত দেশে ফেরা প্রবাসীদের মাত্র ৮ থেকে ১০ ভাগ হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। বাকিরা কোথায় কীভাবে আছেন, আমাদের জানা নেই। যে ২৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন, তার বেশির ভাগই হয় বিদেশ থেকে এসেছেন, না হয় তাদের সংস্পর্শের শিকার হয়েছেন। মৃত ব্যক্তিদের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। তাই নতুন প্রবাসীদের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধ্যতামূলক সঙ্গনিরোধ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। জাতির এই মহাসংকটে বিভেদ ভুলে সবাইকে দেশ, দেশের মানুষ ও অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এক হয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ে এবং নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষ বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। বাঁচবে সমাজ, সভ্যতা, শিল্প, সাহিত্য ও রাজনীতি।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close