সাধন সরকার

  ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

মুক্তমত

চাকরির সঙ্গে শিক্ষার মিল নেই

আমার এক বন্ধু বাংলা বিষয়ে ছয়-সাত বছর ধরে পড়াশোনা (অনার্স-মাস্টার্স) করে এখন চাকরি করছেন ব্যাংকে। আরেক বন্ধু ইতিহাসে পড়ে এখন মস্ত বড় পুলিশ অফিসার। অন্য এক বন্ধু পড়েছেন পদার্থবিজ্ঞানে, চাকরি করছেন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে। আরেক বন্ধু পড়েছেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশলে, চাকরি করছেন বিএডিসিতে। এ রকম শত শত উদাহরণ দেওয়া যাবে! বাস্তবতা হলো, এ দেশে চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষার মিল নেই! এখনকার শিক্ষিত তরুণরা তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। একজন শিক্ষার্থী একটি বিষয়ে পাঁচ-ছয় বছর ধরে পড়াশোনা করে ভালো ফলাফল করার পরও নিজের পছন্দমতো চাকরি পাচ্ছেন না। চাকরির আশায় আবার আলাদাভাবে সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করে চাকরির পড়াশোনা করতে হচ্ছে। ভালো চাকরির আশায় অনেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে চাকরির পড়াশোনার জন্য আবার কোচিংয়ের দ্বারস্থ হচ্ছেন।

একজন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে রাষ্ট্রকে অনেক টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। আর সেই পড়াশোনা তথা শিক্ষার সঙ্গে যদি চাকরির মিল না থাকে তাহলে সেই বিনিয়োগ যথাযথভাবে কাজে আসে না। নিজের পছন্দের বিষয় বা পছন্দমতো চাকরি না পেয়ে অনেকে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। অনেকে আবার প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে না পেরে অপছন্দের চাকরি বরণ করে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু যদি যে যার অনার্স-মাস্টার্সের বিষয় বা নিজের নির্দিষ্ট পড়ালেখার বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরি পেত বা পর্যাপ্ত চাকরির ক্ষেত্র থাকত; তাহলে সে নিজের অভিজ্ঞতা ও সেরাটা রাষ্ট্রকে দিতে পারত। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে ধরনের কর্মী দরকার, সে অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে না। ফলে গ্র্যাজুয়েটরাও তাদের চাহিদামতো চাকরি পাচ্ছেন না। দুঃখের বিষয় হলো, পড়াশোনা শেষ করার পর এ দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে আলাদাভাবে চাকরির পড়া পড়তে হয়। তা না হলে ভালো চাকরি পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই! চার-পাঁচ বছর ধরে চাকরির পড়া তথা প্রস্তুতি নেওয়ার ফলে চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের জীবনের সোনালি সময় নষ্ট হচ্ছে। তরুণরা যদি পড়াশোনা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই বিষয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চাকরি পেত; তাহলে রাষ্ট্রকে তারা নিজের তারুণ্যদীপ্ত মেধা ও সময় দিয়ে আরো বেশি অবদান রাখতে পারত। প্রশ্ন হলো, চাকরি পাওয়ার জন্য সব তরুণদের কেন একই বিষয় (চাকরির জন্য একই ধরনের প্রস্তুতির পড়া) পড়তে হবে। একই বিষয় পড়ে কি তরুণরা একই চাকরি করে? এমনটি নয় যে, চাকরির প্রস্তুতির পড়া একজন চাকরিপ্রত্যশীর চাকরি পাওয়ার পর তা খুব বেশি দিন মনে থাকে! তবে নিজের অনার্স-মাস্টার্সের বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সবারই কমবেশি মনে থাকে ও কাজে লাগানো যায়।

পড়ালেখা শেষে আলাদাভাবে চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার ফলে তরুণদের জীবনীশক্তি কিছুটা হলেও ক্ষয়ে যায়! চাকরির সঙ্গে শিক্ষার মিল না থাকার কারণে মেধাবী তরুণরাও সঠিক সময়ে চাকরি পাচ্ছেন না। দীর্ঘ সময়ব্যাপী বেকার থাকছেন। তথ্যমতে, দেশের শিক্ষিত তরুণদের এখন এক-তৃতীয়াংশ বেকার। প্রশ্ন হলো, শিক্ষিত তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ যদি বেকার থাকে; তাহলে সে শিক্ষাকে বা শিক্ষাব্যবস্থাকে কি মানসম্মত ও যুগোপযোগী বলা যায়? চাকরির সঙ্গে শিক্ষার মিল না থাকায় এ দেশে দক্ষ কর্মীর ব্যাপক অভাব রয়েছে। বিদেশ থেকে উচ্চ বেতন দিয়ে বিদেশি কর্মীদের দেশে আনতে হচ্ছে অথচ দেশে বেকাররা চাকরি পাচ্ছেন না। গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষার মান নিয়ে এখন অনেক কথা হচ্ছে। বর্তমান বাস্তবতায় এ দেশের শিক্ষার মান ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। পরিমাণগত নয়, গুণগত শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাস্তবতা হলো, এখন গ্র্যাজুয়েট আছে, কিন্তু বর্তমান বাজারের চাহিদা অনুযায়ী গ্র্যাজুয়েট ও দক্ষ লোক নেই! তাই এখনই কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় করে গ্র্যাজুয়েট তৈরির পাশাপাশি এ ব্যাপারে গবেষণা করতে হবে। তারুণ্যের মেধা কাজে লাগাতে বিভিন্ন দেশের পদ্ধতি, পরিকল্পনা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। একজন গ্র্যাজুয়েট যাতে পড়ালেখা শেষ করার পরপরই নিজের বিষয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চাকরি পান; সে ব্যাপারে তরুণদের নিশ্চয়তা দিতে হবে, তা না হলে তারুণ্যের মেধা যেমন কাজে লাগানো যাবে না; তেমনি শিক্ষাব্যবস্থায় রাষ্ট্রের বিনিয়োগের পুরোপুরি সুফলও আসবে না।

লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close