রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

বিশ্লেষণ

ক্ষমতা রাখতেই ব্যস্ত ভ্লাদিমির পুতিন

তিনি ২০ বছরে ধরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময়ের মধ্যে ভূরাজনৈতিক সংকট যেমন তৈরি হয়েছে; তেমনি বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় আসর অর্থাৎ বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছে রাশিয়া। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির এক এজেন্ট ছিলেন ভøাদিমির পুতিন। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলেন, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিল ক্লিনটন। গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের তিন প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটেনের পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করেছেন। বৈশ্বিক সংঘাত, দেশের অভ্যন্তরে নানা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে খেলাধুলার আসর আয়োজন এবং নিজের প্রচারণার জন্য নানা কিছুর মধ্যে পুতিনের এই ২০ বছর। ১৯৯৯ সালের আগস্টে ভøাদিমির পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। বরিস ইয়েলেতসিনের বিদায়ের পর ৩১ ডিসেম্বর মি. পুতিন প্রেসিডেন্ট হন। কেজিবির সাবেক এ কর্মকর্তা ১৯৯৯ সালে যখন ক্ষমতাসীন হলেন তখন দ্বিতীয়বারের মতো চেচনিয়া যুদ্ধ শুরু করে রাশিয়া। কিছু অ্যাপার্টমেন্টে বোমা হামলার জবাবে সে অভিযান শুরু করে রাশিয়া। প্রেসিডেন্ট হিসেবে মি. পুতিনের সূচনা হয়েছিল রাশিয়ার অস্থির দক্ষিণাঞ্চলে সংঘাতের মধ্য দিয়ে। সম্প্রতি পুতিনের জনপ্রিয়তা সব সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। বলা যায় ৯০ শতাংশ। কীভাবে এটা টেকসই বা বজায় থাকবে? দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য এ পর্যায়ের জনপ্রিয়তা কি খুব ফলপ্রসূ হবে ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন!

অপরদিকে, দেড় বছর আগে জনপ্রিয়তা যখন ৮৬ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছিল, তখন কেউ তা এত দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেনি। সত্যিকার ব্যাপার হচ্ছে, প্রত্যেকে মনে করেছিল জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়ে ৬৫-৭০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। সেটা হয়নি। কেন? পুতিন দ্বিতীয়বার প্রতীকীভাবে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাকে রাজনৈতিক ক্যাটাগরি থেকে অন্যান্য জননেতার মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ব্যাপারে তার অধিকারের ব্যাপারে আলোচনা করার প্রশ্নই আসে না। ইউক্রেন এবং ক্রিমিয়ায় তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে রাশিয়ানরা বিশ্বাস করে, বিশ্বকে তার দেখানো উচিত চাপের মুখে রাশিয়া মাথা নত করে না। রাশিয়ায় এখন একটি নতুন সরকার। খুবই কৌশলগতভাবে এ সরকার গঠন করা হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন একাধিক সাংবিধানিক পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়ে তা গণভোটে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং এরপরই প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভের গোটা মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। পদত্যাগের পর মেদভেদেভ বলেছেন, ‘আমাদের দেশের প্রেসিডেন্টকে প্রয়োজনীয় সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিন। প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবগুলো রাশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করবে। পুতিনের এ ধরনের পদক্ষেপে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখন রাশিয়ায় জনগণের মধ্যে এ জল্পনাকল্পনা চলছে যে ২০২৪ সালের পরও যাতে ক্ষমতায় থাকতে পারেন, সে জন্যই পুতিন সংবিধান পরিবর্তনের এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকা যায় না।

২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের মেয়াদ যখন শেষ হবে, তখন তার বয়স হবে ৭১। কিন্তু প্রচলিত আইন অনুযায়ী, ৭১ বছর বয়সি কোনো নেতার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের বিধান নেই। এজন্য রুশ সংবিধান পরিবর্তনের এই চেষ্টা পুতিনের। যদিও পুতিনের দাবি, ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন আনা হচ্ছে। পুতিন যে কিছু একটা করবেন, তা আগে থেকেই অনেকে অনুমান করছিলেন। তবে এটা স্পষ্ট ছিল না যে, তিনি সংবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব দেবেন। পুতিন ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন, জোসেফ স্তালিনের পর তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাশিয়ার শাসক হিসেবে রয়েছেন। এবং এই ২০ বছর ধরে তিনিই রাশিয়ার রাজনীতিতে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কারগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ মাত্র দুটিতে সীমিত করা (এখন পর্যন্ত, এই সীমা পরপর দুই মেয়াদ); এ ছাড়া আর যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ভবিষ্যতে রুশ প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রার্থীকে কমপক্ষে ২৫ বছর ধরে সে দেশে থাকতে হবে; প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা নিয়োগের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে নয়, পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষের হাতে থাকবে; নিরাপত্তা-সম্পর্কিত সরকারি পদগুলোর প্রধানকে নিয়োগ করার ক্ষমতা থাকবে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের হাতে; স্টেট কাউন্সিলের হাতে আরো ক্ষমতা দেওয়া হবে। দিমিত্রি মেদভেদেভকে ইতোমধ্যে ক্রেমলিনের নিরাপত্তা কাউন্সিলে ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পুতিন এ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। অনেক পর্যবেক্ষক এ পদে মেদভেদেভের নিয়োগের কারণে তাকে প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করছেন।

কেননা, প্রতিরক্ষা এবং বিদেশনীতির বিষয়ে কথা বলার আরাে ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়েছে। যদিও উভয় বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলার অধিকার পুতিনেরই রয়েছে। মেদভেদেভের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়া শাপেবর হয়েছে বলা যায়। কারণ এমনিতেই নানা অজনপ্রিয় পরিকল্পনা নিয়ে তিনি দেশের ভেতরে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। এরমধ্যে একটি হচ্ছে পেনশন সংস্কার পরিকল্পনা। নিরাপত্তা কাউন্সিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পাওয়াটা মেদভেদেভের জন্য তার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের একটা সুযোগ। মেদভেদেভের স্থলে দেশটির কর পরিষেবার সাবেক প্রধান মিখাইল মিশুসতিনের নিয়োগ পার্লামেন্ট ইতোমধ্যে অনুমোদন করেছে এবং তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছেন। তবে মিশুসতিনকে পুতিনের উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হচ্ছে না। এমনকি তাকে পুতিনের প্রেসিডেন্সির মেয়াদকালের শেষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দেখা হচ্ছে না; অন্য কাউকে এ পদে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে এখন এবং ২০২৪ সালের মধ্যে অনেক কিছু ঘটতে পারে। সম্ভবত রাশিয়ার রাজনীতির একমাত্র নিশ্চিত বিষয় হলো এখন এবং ২০২৪ সালের মধ্যে অনেক কিছু ঘটবে। পুতিনের চূড়ান্ত খেলাটি কী হবে, তা আমরা এখনো জানি না। তার কাছে প্রচুর বিকল্প রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফিরে আসতে পারেন, তার ইউনাইটেড রাশিয়া দলের প্রধান হিসেবে থাকতে পারেন বা নতুন ক্ষমতাপ্রাপ্ত স্টেট কাউন্সিলের প্রধান হতে পারেন। কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট নুর সুলতান নাজারবায়েভ ক্ষমতায় থাকার জন্য এ রকম নানা কিছু করেছিলেন। কেউ কেউ এমনটাও বলছেন যে, পুতিন যৌথ রাশিয়া- বেলারুশীয় ইউনিয়নের শাসক হবেন, যা নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা চলছে।

চূড়ান্ত অবস্থান যাই হোক না কেন, পুতিন নিশ্চিত করেছেন যে, ২০২৪ সালের পর তিনি যে পদেই থাকুন না কেন, তিনিই দেশের প্রধান রাজনৈতিক চালক হিসেবে থাকবেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ হতে পারবেন না। এমনকি নতুন মন্ত্রিসভায় বেশ কয়েকজন উপপ্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছে। সমাজকল্যাণ ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রধানের দায়িত্বে পরিবর্তন এসেছে। তবে রাশিয়ার নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রীরা স্বপদেই বহাল আছেন। এরমধ্যে রয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শইগু, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভøাদিমির কোলোকোলতসেভ। অর্থমন্ত্রী অ্যাস্তন সিলুয়ানভকেও তার পদে বহাল থাকতে দেখা গেছে। প্রথম তিনজন উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও চতুর্থজন এ মর্যাদা পাননি। যদিও তার পদ বহাল আছে। বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ে নতুন মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের জন্য নতুন মন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। এই মন্ত্রণালয় ডোপিংয়ের কেলেঙ্কারি থেকে রাশিয়াকে বের করে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণায়ের জন্যও নতুন মন্ত্রী এসেছে। এই মন্ত্রণালয়ও বেশ কয়েক বছর ধরে বিদেশি, বিশেষ করে হলিউডের সিনেমার প্রভাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। বিশেষ উদ্যোগ হিসেবে তারা রাশিয়ায় নির্মিত দেশপ্রেমবিষয়ক সিনেমাকে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পুতিন গত মাসে সংবিধান সংশোধনের ঘোষণা দেন। এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সংকুচিত করার কথা বলা হয়েছে। এরপরই পুরো সরকারের পদত্যাগের কথা জানা যায়। দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভও পদত্যাগ করেন। মেদভেদেভের স্থলাভিষিক্ত হন মিখাইল মিশুস্তিন। তিনি রাশিয়ার শীর্ষ কর কর্মকর্তা। এই টেকনোক্র্যাট বরাবরই ক্রেমলিনের রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন।

উল্লেখ্য যে, রাশিয়ার আইনের ওপর আন্তর্জাতিক আইনকে প্রধান্য দেওয়া প্রতিরোধ করা। সরকারি কর্মচারীদের অন্য দেশের নাগরিকত্ব থাকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা। ন্যূনতম বেতন ও পেনশন দারিদ্র্যসীমার ওপর নির্ধারণ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে পুতিনের প্রেসিডেন্ট পদে থাকার চতুর্থ মেয়াদের সময়সীমা শেষ হতে যাচ্ছে। এরপর তিনি আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। এমন সময় পুতিনের এসব সিদ্ধান্ত রাশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ বিষয়ের প্রফেসর মার্ক গ্যালিওটি বলেন, পুতিন যদি প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে চাইতেন, তাহলে সময়সীমা পরিবর্তন করে ক্ষমতায় বহাল থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার আগে তিনি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনতে চাইছেন যেন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কিছুটা কমে এবং প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের ক্ষমতা কিছুটা বাড়ে। সেই সঙ্গে স্টেট কাউন্সিলের অংশ হয়ে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যাওয়ার পরও রাশিয়ার ‘জাতির পিতা’র ভূমিকায় রাজনীতিতে নিজের প্রভাব বহাল রাখতে পারেন পুতিন। বিবিসির রুশ বিভাগের সেরগেই গোরিয়াশকো বলছেন, ভøাদিমির পুতিন ক্ষমতায় থাকতে চান। প্রশ্নটা হচ্ছে কীভাবে, কী ভূমিকায়। আমরা প্রায় নিশ্চিত যে, তিনি ২০২৪ সালের পর প্রেসিডেন্ট থাকবেন না। হয়তো তিনি নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান হিসেবেও থাকতে পারেন। বিশ্লেষক কনস্টান্টিন এগার্ট টুইটারে মন্তব্য করেছেন যে, রাশিয়ার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছেএবং ২০২১ সালের মধ্যেই নতুন কাঠামো এবং নতুন পুতিনকে দেখা যাবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close