জাকির আজাদ

  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

মুক্তমত

বাড়ছে মাদকাসক্ত শিশু-কিশোর

রবুকে দেখতে এসেছিল তার বন্ধুরা। রবুর বন্ধুদের মধ্যে সাজু, কিসলু ডিব্বা, মুলি কাউকেই সদর উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার দেখতে দেয়নি। ডাক্তারের নির্দেশনা ছিল তাকে এ মুহূর্ত থেকে কোনোরূপ ডিসটার্ব করা যাবে না। সুস্থ হতে হলে পুরোপুরি রেস্টে থাকতে হবে। কারণ প্রচুর পরিমাণ বমি করেছে সে, বমির সঙ্গে রক্তক্ষরণও হয়েছে খানিকটা। অতিরিক্ত বমি করার কারণে তার খাদ্যনালি এলোমেলো হয়ে গেছে। এ সময় কথা বলা ঠিক হবে না। একরাশ হতাশা নিয়ে রবুর বন্ধুরা ফিরে আসে তাদের আস্তানা উপজেলার পরিত্যক্ত খাদ্যগুদামের পেছনে। যেখানে রবু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই রবুর বাবা এক সকালে কাজে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই থেকে তার মা ছোট্ট বোনটিকে নিয়ে উপজেলা অফিসের কোষাধ্যক্ষের বাসায় ঝির কাজ নিয়ে নেয়। একা পড়ে যায় রবু তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাটি হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। অভিমান করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সে। কুমিল্লা রেলস্টেশনে এসে মিশে যায় একদল কিশোরের সঙ্গে, যারা চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িত। রবুও বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের সঙ্গে রেলস্টেশনে সকাল থেকে গভীর রাত অবধি সুযোগের সন্ধানে থাকে। সুযোগ পেলে অপকর্মটি করে আর তার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নেশাদ্রব্যের মাধ্যমে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে। দু-দুবার জিআরপির কাছে ধরা পড়লেও নেশার কর্মটি ছাড়তে পারেনি।

এ চিত্রটি কেবল নিম্নশ্রেণির সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের মধ্যে নয়, উচ্চ-মধ্য সব বৃত্তের শিশুর মধ্যে মাদকের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে সমহারে। এসব কোমলমতি শিশু-কিশোর সুন্দর শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে মাদকের বিষাক্ত থাবায়। তারা ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে দুর্ধর্ষ অপরাধী।

জেলা শহর-শহরতলি এমনকি গ্রামগঞ্জেও দ্রুত বেড়েই চলছে মাদকতাসক্ত শিশু-কিশোর। শুধু গাঁজা নয়, এসব শিশু বর্তমানে ড্যান্ডিতেও আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বস্তি এলাকার শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘সন্তানের প্রতি পারিবারিক অবহেলা আর শিক্ষার যথোপযুক্ত পরিবেশের অভাবে শিশুদের জন্য মাদক ভয়ংকর সমস্যা হয়ে উঠছে। পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশের কারণে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোররাও মাদকতাসক্ত হচ্ছে। তারা মাদকদ্রব্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করছে ইয়াবা।’

বাংলাদেশ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক গবেষণায় লক্ষ করা যায়, গত ২০১৯ সালে চিকিৎসা দেওয়া মাদকাসক্তদের ৪ দশমিক ৩১ শতাংশই শিশু। যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল বেকারত্বের কারণে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। যদিও ২০১৯ সালে এ হার ছিল ৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রোপলিটান অঞ্চলের সহকারী পরিচালক নাজমুল আলম বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের মধ্যে মাদক ব্যবহারের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা শিশু-কিশোরদের সংখ্যা দেখে আতঙ্কিত হতে হয়। দেশে অভিভাবকদের সচেতনতা কতখানি উদাসীন হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী বছরগুলোতে দেশের কোমলমতি শিশুদের অবস্থা ভয়ানক হয়ে দাঁড়াবে। অচিরে এ ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ ছাড়াও অভিভাবকদের সচেষ্টা সতর্ক থাকতে হবে।’

সম্প্রতি মাদকাসক্ত রোগীর ওপর বয়সওয়ারি এক গবেষণায় উল্লেখ, ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সিদের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেলেও শিশুদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালে ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সিদের মধ্যে মাদকাসক্তের হার ছিল ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ২১ থেকে ২৫ সংখ্যাও কিছু হ্রাস পেয়েছে। ২০১১ সালে এ বয়সিদের মধ্যে মাদকাসক্তের হার ছিল ১৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।

বর্তমানে দেশের ৫১২টি পয়েন্ট দিয়ে ৩২ ধরনের মাদক অবাধে ঢুকে পড়ছে। পৃথক সিন্ডিকেটের হাত ঘুরে তা পৌঁছে যাচ্ছে শহর, বন্দর জনপদে শিশু-কিশোর, যুবসহ নানা বয়সি মাদকাসক্তের নাগালে। এ পর্যন্ত ভিন্ন নামে যেসব মাদক উদ্ধার হয়েছে তা হলোÑ হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, কেডিন, ফেনসিডিল, তাড়ি, প্যাথেডিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, বনোজেসিক ইনজেকশন, টেরাহাইড্রোবানবিল, এক্সএলমুগের, মরফিন, ইয়াবা, আইএপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম, পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন। তাছাড়া ইনোকট্রিন, সিডাক্সিনসহ বিভিন্ন ঘুমের ট্যাবলেট, জ্যামবাকসহ ব্যথানাশক ওষুধ সেবন কিংবা টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে কেউ কেউ নেশা করে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র থেকে জানা গেছে, ৩৭টি ইয়াবা কারখানার সবই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন ও শিন প্রদেশে অবস্থিত।

মাদক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ কি পরিবার, সমাজ না রাষ্ট্র এ রকম প্রশ্নের উত্তরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘মাদকের সামাজিক প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ। মাদক একটি সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উৎপাদনক্ষম কিশোর-যুবশক্তি ধবংস করে দিচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে রাষ্ট্রকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। পরিবারের সবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করছে। মাদক ঘিরে সমাজে যে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে; সেটি সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে।’

বর্তমানে কোনদিকে ধাবমান আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম? নীতিনৈতিকতার ধার না ধেরে বাংলাদেশে বেড়েই চলছে নেশার সাম্রাজ্যের ভয়াল সীমানা। এর বড় অংশ জুড়ে আছে এ দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণ সমাজ। ভয়াবহ এক সামাজিক অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্তে এখন আমাদের সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা লাল-সবুজের বাংলাদেশ। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে এক্ষুনি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু বিকাশ ও সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে পাড়ামহল্লায় গঠনমূলক সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র, পাঠাগার। নানা কাজে ব্যস্ত এ যুগের পিতা-মাতারা মোটেও ছেলেমেয়েদের সময় দিতে চান না। এমনকি বন্ধু হতেও ইচ্ছা পোষণ করেন না। ফলে এক ধরনের বন্ধ-অস্থির নিরানন্দ পরিবেশে বেড়ে উঠছে এখনকার শিশু কিশোর-কিশোরীরা। নেশার জগতে পা দেওয়ার পেছনে মা-বাবার সন্তানের প্রতি অমনোযোগিতাই মূলত দায়ী। কোনো শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব শুধু পিতা-মাতার নয়, আমাদের সবার। শিক্ষকরা যদি দায়িত্বশীল হয়ে শিক্ষার্থীর খোঁজখবর নেন এবং অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে অভিভাবককে অবহিত করা হয়; তাহলে সহজেই তাকে অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

লেখক : সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close