নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

পর্যালোচনা

হাওরে সবজি চাষে নীরব বিপ্লব

বেশি দিনের কথা নয়, ২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢল ও আগাম বন্যায় হাওরে উঠতি বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রবল পানির তোড়ে ভেসে যায় পাকা ধান, যে ধান কদিন পরই কেটে গোলায় ওঠানোর কথা ছিল কৃষকের। হাওরে বোরো ধান নষ্ট হলে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব আর্থসামাজিক কর্মকান্ডে। ওই সময় পাহাড়ি ঢলে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জÑ এ ছয় জেলায় মোট ৬ লাখ ২৩ হাজার ৩৭৯ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। ২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমির প্রায় ১০ লাখ টন বোরো ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় পানিতে পচে। গত বোরো মৌসুমে ধানের দাম কম থাকায় ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচও তুলতে পারেননি হাওর এলাকার কৃষক। হাওরে আগাম রোপণকৃত ব্রিধান ২৮ জাতে ব্যাপক ব্লাস্টরোগের আক্রমণের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হন অনেক কৃষক। এ ছাড়া ওই অঞ্চলে বোরো ধান কাটার সময় কৃষিশ্রমিকের মজুরি অত্যধিক বেড়ে যায়। দ্বিগুণ মজুরি দিয়েও ধান কাটার জন্য সময়মতো কৃষিশ্রমিক পাওয়া যায় না। এসব কারণে ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন হাওরের কৃষক। বেঁচে থাকার জন্য তারা খুঁজছেন নতুন লাভজনক ও ঝুঁকিমুক্ত কৃষি। খুঁজছেন স্বল্পমেয়াদি ফসল। একসময় বোরো ধান ও মাছ শিকারই ছিল হাওরবাসীর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এখন সে অবস্থা নেই। কার্তিক মাসে হাওরের তুলনামূলক উঁচু জমি থেকে পানি সরে গেলে কৃষক ওই উর্বর পলিযুক্ত দোআঁশ মাটিতে চাষ করছেন মুলা, গাজর, আলু, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, টমেটো, খিরা, মিষ্টিকুমড়া, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক, মাষকলাই, মরিচ, লাউসহ নানা ধরনের সবজি ও রবি ফসল। ফলে বোরোর বাম্পার ফলন এলাকা হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চল দিন দিন রবিশস্যের নতুন ভান্ডারে পরিণত হচ্ছে। আজ থেকে তিন-চার বছর আগেও যা ছিল ধারণার অতীত।

করিমগঞ্জ উপজেলার হাওর-সমৃদ্ধ সাগুলি, উত্তর গণেশপুর, নিয়ামতপুর; ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা, বরিবাড়ি; মিঠামইন উপজেলার কামালপুর, ইসলামপুর, মহিষারকান্দি, বোরনপুর; অষ্টগ্রাম উপজেলার ছাতিরচর, দামপাড়া, সিংপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের উঁচু এলাকার জমিগুলোতে শাকসবজি ও রবিশস্যের ব্যাপক চাষ হচ্ছে। এভাবে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন কৃষক। তাই তারা ধানের পাশাপাশি শুষ্ক মৌসুমে পতিত জমিতে রবিশস্যের আবাদে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। এ মৌসুমেও তারা ভালো ফলনের আশা করছেন। রবিশস্যের আবাদ করে একাধিক কৃষক তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা গ্রামের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ফরিদ মিয়া ছিলেন বর্গাচাষি। কয়েক বছর ধরে তিনি নিজের সামান্য পতিত জমিতে শাকসবজি চাষ করে নিজের ভাগ্য বদলাতে পেরেছেন। ফরিদ মিয়ার মতো গ্রামের অনেক কৃষক জীবনের মোড় ঘোরাতে সক্ষম হয়েছেন সবজি চাষ করে। সবজি ও রবি ফসল চাষের মাধ্যমে হাওর এলাকার কৃষক লাভজনক কৃষির একটি সঠিকপথের সন্ধান পেয়েছেন। ১০ বছর আগেও সবজি চাষের এমন অবস্থা ছিল না সেখানে। মহিষাকান্দি গ্রামের রুহুল আমীন, কাঞ্চন মিয়া; ইটনা উপজেলার শিমুলবাগ গ্রামের মোমেন হোসেনসহ অনেকে সবজি ব্যবসার মাধ্যমে অতীতের দুঃখ দূর করে সচ্ছল জীবনের অধিকারী হয়েছেন। হাওরের একফসলি জমিতে সবজির আবাদ হবে, তা তাদের বাপ-দাদারাও কল্পনা করতে পারেননি। হাওর থেকে পাইকারি দরে সবজি কিনে ব্যবসায়ীরা প্রতি সপ্তাহে তিন-চার ট্রাকবোঝাই সবজি ঢাকার কারওয়ান বাজারে পাঠান। শিমুলবাগ গ্রামের কৃষকের সবজি চাষ দেখে কাজলা, কৃষ্টপুর, চন্দ্রপুর, গজারিয়া, মাগাবি, বর্মা প্রভৃতি গ্রামেও সবজি চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। একফসলি জমিতে বোরো ধান আবাদ ও মাড়াইয়ের পরপরই বর্ষা শুরু হয়ে যায়। এ সময় হাওরে বসবাসরত একটি বড় জনগোষ্ঠী মাছ শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রায় ছয় মাস তাদের কোনো কাজ থাকে না। কার্তিক মাসে হাওর থেকে পানি নেমে যায়। উজান এলাকায় এ সময় সবজি চাষ দেখে হাওরের কোনো কোনো এলাকার চাষি পানি নামার পরপর সবজি চাষের উদ্যোগ নেন। বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের পরামর্শক্রমে চাষিরা গ্রামভিত্তিক সবজি উৎপাদন কমিটি গঠন করে সবাইকে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। আর এভাবেই শুরু হয় হাওরে সবজি বিপ্লব। আগে নৌকা করে শহর থেকে হাওরে সবজি আসত। এখন হাওর থেকে শত শত নৌকায় সবজি যাচ্ছে শহরে। ইটনার চৌগাঙ্গা গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়া এবার ৩০ শতাংশ জমিতে শুলা চাষ করে ১০ হাজার টাকা মুনাফা করেন। মুলা বিক্রি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই জমিতে তিনি বোরো ধানের চাষ করেছেন। একই গ্রামের আসাদুজ্জামান তার ৩০ শতাংশ জমিতে বেগুন, মুলা ও রসুন চাষ করেছেন। জমিতে উৎপাদিত সবজি দিয়েই তার সারা বছর চলে যায়। একই গ্রামের রাহেলা খাতুন দুই একর জমিতে সবজি চাষ করে ৫০ হাজার টাকা মুনাফা করেছেন। ইটনা উপজেলার শিমুলবাগ গ্রামের আকলিমা আক্তার সবজি চাষ করে তাদের জীবনে সচ্ছলতা আনতে সক্ষম হয়েছেন। ইটনা উপজেলার শিমুলবাগ গ্রামে ৩৮৯টি পরিবারের বসবাস। তারা সমিতির মাধ্যমে হাওরে দুই বছর ধরে সবজি চাষ করছেন। গ্রামের অধিকাংশ লোক অতিদরিদ্র শ্রেণির হয়েও বর্তমানে সবজি চাষের মাধ্যমে তারা সচ্ছল। কারো কারো মতে, হাওরে সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবজি চাষে গ্রামের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেছে। এজন্য হাওরবাসী তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। মিঠামইন উপজেলার রহমতপুর গ্রামের ৯০টি কৃষক পরিবার বিভিন্ন সবজি উৎপাদন করছে। স্বল্প সময়ে বেশি লাভ হওয়ার কারণে দিন দিন সবজি ও রবিশস্য চাষের পরিধি বাড়ছে। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের আটটি হাওর ও আংশিক হাওর উপজেলায় প্রায় ২৫০টি গ্রামে সবজি উৎপাদন হচ্ছে। ২০ হাজার দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের আড়াই লক্ষাধিক মানুষ এতে উপকৃত হচ্ছে। তাই সবজি চাষে হাওর এলাকার চাষিদের সব ধরনের সরকারি সহায়তা দেওয়া উচিত। হাওরে সবজি উৎপাদন অনেকটাই নীরব বিপ্লব। কৃষকরাই বাজার ব্যবস্থার সার্বিক চিত্র বদলে দিতে পারেন। হাওরে সবজি চাষ তার বড় প্রমাণ।

আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে পাবনার ভাড়ইমারী, ছলিমপুর, নওদাপাড়া, সাহাপুর, আওতাপাড়া, পাকুড়িয়া, দাশুরিয়া, চরমীরকামারী, চররূপপুর প্রভৃতি গ্রামে আগাম ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো ও গাজর চাষের যে সূচনা ঘটেছিল, আজ তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। ওই সবজি চাষের যারা সূচনা করেছিলেন তাদের মধ্যে জাহিদ, আবদুর বারী ও রবিউল ইসলামের নাম উল্লেখযোগ্য। চলন বিলাঞ্চলেও একসময় বছরে একবার বোরো ধানের চাষ ছাড়া আর কিছুই হতো না। ওই এলাকায় বিনা চাষে রসুন চাষ সেখানকার কৃষি ও কৃষকের জীবনে এনে দিয়েছে সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতা। বিলের পানি নামতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আশ্বিনের শেষে কার্তিকের শুরুতে নরম পলিমাটিতে বিনা চাষে কৃষক রসুনের কোয়া রোপণ করেন এবং খড় দিয়ে ঢেকে দেন। তারপর সামান্য সেচ ও সার প্রয়োগ করে তারা রসুন উৎপাদন করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হন। চলনবিল এলাকায় সম্ভব হলে হাওর এলাকাতেও বিনা চাষে রসুন চাষ সম্ভব হবে। বিনা চাষে রসুন উৎপাদনে খরচ কম। লাভ বেশি। তাই এ প্রযুক্তি হাওর অঞ্চলে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্যোগ নিতে পারে কৃষি বিভাগ। আগাম মুড়ি পেঁয়াজের চাষেরও উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে সেখানে। হাওর এলাকায় সবজি চাষকে জোরদার করার জন্য হাওরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ও সহযোগিতায় একটি সবজি গবেষণা উপকেন্দ্র স্থাপন করা উচিত। সবজি চাষের ওপর কৃষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের মধ্যে বিনামূল্যে সবজির বীজ বিতরণের মতো কৃষি প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকা উচিত। হাওরের মাটি আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে দেশের বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলোকেও হাওরে চাষ উপযোগী সবজি বীজ উৎপাদনে এগিয়ে আসতে হবে। বিএডিসিকেও হাওরে চাষ উপযোগী সবজির বীজ উৎপাদন ও বিপণনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ করে সিলেট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে হাওরে সবজি চাষের ওপর গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। ওই এলাকায় চাষ উপযোগী সবজির নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে। ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটও এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে হাওর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। হাওর এলাকায় আগাম স্বল্পমেয়াদি সরিষা চাষের পর বোরো ধানের চাষের কথাও ভাবতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে উপযুক্ত সরিষার জাত উদ্ভাবন করতে হবে।

কিশোরগঞ্জ জেলা ছাড়াও দেশের আরো পাঁচ জেলার হাওর অঞ্চলেও সবজি চাষের এ সফলতাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। ওইসব হাওর এলাকার কৃষকদের কিশোরগঞ্জের কৃষকের সবজির মাঠ সরেজমিনে পরিদর্শন ও শিক্ষা ভ্রমণের মাধ্যমে দেখাতে হবে। প্রযুক্তি সম্পর্কে হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে হবে। এতে ওইসব এলাকার কৃষক সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন এবং শুরু হবে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের মতো সবজি বিপ্লব। হাওরের কৃষকদের আয় বাড়বে। কমবে বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীলতা ও ঝুঁকি। বাড়বে ফসলের নিবিড়তা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ। ত্বরান্বিত হবে হাওর এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close