ইয়াসমীন রীমা

  ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

বিদ্যালয়ে চাই পরিচ্ছন্ন টয়লেট

ধ্রপদী ইয়াসমীন হৃদি ক্লাস এইটে পড়ে। গত মাসে তার প্রথম পিরিয়ড হয়েছে। রক্ত দেখে সে তো রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিল। এ আবার কেমনতরো অসুখ। প্রথম দিন সে মাকে কিছুই বলেনি। প্যান্টির সঙ্গে টয়লেট টিস্যু ব্যবহার করে সেরে ফেলতে চেয়েছিল। রক্তপড়া যখন বন্ধ হচ্ছিল না তখন মাকে জানায় ব্যাপারটা। হৃদির মা সূবর্ণা সেতারা ইসলাম ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে বলেন। স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করে দেন। হৃদির বড় কোনো বোন নেই। তাই এ ব্যাপারে তার কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা হয়নি। তা ছাড়া ক্লাসের বান্ধবীদের সঙ্গে এ নিয়ে কোনোরূপ আলাপ করার সুযোগও হয়নি তার। মাসের নির্দিষ্ট কোনো তারিখে ব্যাপারটা ঘটে তার কথা মা তাকে জানাননি। কেবল তিনি বললেন, প্রতি মাসে ঘটবে, এটা থাকবে তিন থেকে পাঁচ দিন।

আজ সকালে স্কুলে আসার সময় নিচের পেট সামান্য ব্যথা অনুভব করেছিল সে। কিন্তু বুঝতে পারেনি কেন ব্যথা করেছে। স্কুলে এসে বুঝতে পারল, তার পিরিয়ড শুরু হয়েছে। হৃদি এজন্য যথেষ্ট প্রস্তুত ছিল না। এ পরিস্থিতি কেমন করে সামলে নেবে সে। ন্যাপকিনইবা কোথায় পাবে সে। ঘনিষ্ঠ বান্ধবী রেবতীকে জানালে সে প্রস্তুত ছিল; কারণ তারও পিরিয়ড চলছে। স্কুলব্যাগে আনা ন্যাপকিন দিয়ে তাকে সাহায্য করল ঠিকই। হৃদি কোথায় গিয়ে তার কাজটা সম্পন্ন করবে ভেবে পাচ্ছিল না। স্কুলের বাথরুমগুলোর কী-যে বিশ্রি অবস্থা। বলার অপেক্ষা রাখে না। একটিরও দরজার ছিটকিনি নেই, নেই পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা। নোংরা ও অপরিষ্কার অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে। ছাত্র-ছাত্রীদের হাজারো অভিযোগের কাছে স্কুল কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। কেবলই আশ্বাস প্রদানই সার। একে তো বাথরুমগুলোর কাহিল অবস্থা তারপর আবার কম্বাইন্ড স্কুল। কেসিএস প্রিমিয়ার হাইস্কুল। বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ড এরিয়া, মুরাদনগর, কুমিল্লার এই স্কুলটি লেখাপড়ার দিকে প্রসিদ্ধ হলেও অবকাঠামোগত দিকে বড়ই নাজুক অবস্থা। সরকারি অনুদান পেলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ গাফিলতি ও বিড়ম্বনার কারণে অনেক সুবিধা থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা বঞ্চিত রয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রীদের বাথরুমের অবস্থা সম্পূর্ণরূপে অযোগ্য। কেবল মুরাদনগর স্কুলের নয়, সারা দেশে সুষ্ঠু স্কুলের পায়খানা-প্রস্রাসের ব্যবস্থাগুলো এখনো অনুন্নত রয়ে গেছে। দেশের বিদ্যালয়গুলোতে বাথরুমের সংখ্যা যথেষ্ট নয় বলা যায়। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা মারাত্মক খারাপ। বেশির ভাগ বাথরুমই বন্ধ থাকে। ওপরে নোংরা অপরিষ্কার ব্যবহারে অনুপযোগিতা তো রয়েছে। কোনো কোনো স্কুলবাথরুমে হাতটা ধোয়ার মতো অবস্থাটুকু নেই।

এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, এটা একটি জাতীয় ইস্যু, যা বাস্তবায়নে ‘লো কস্ট ক্যাম্পেইন’ হিসেবে আরম্ভ করা যেতে পারে। তা ছাড়া স্কুল স্যানিটেশন বিষয়ে সুফল পেতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট বেসরকারি খাতগুলোকে সংযুক্ত করতে হবে। শিক্ষক, প্রবীণ পুরুষদের সামনে বাথরুমে যাওয়া নিষেধ একই রকম ভ্রান্ত ধারণা এখনো মেয়েদের মধ্যে বিরাজমান। শিক্ষকদের অনেকেই অষ্টম শ্রেণিতে বয়োসন্ধিকাল ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক পাঠ অন্দর থেকে নিয়ে আসতে হবে। এই জড়তাও কাটিয়ে উঠতে হবে। মাসিকের সময়গুলোতে প্রায় ৮০ ভাগ মেয়েই স্কুলে যাওয়া-আসা করে না। ফলে অনেক মেয়েই উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হয়।

জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে দুই কোটি ছাত্র-ছাত্রী শুধু স্কুলের নোংরা টয়লেটের কারণে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে রয়েছে। স্কুলপর্যায়ের শিক্ষার্থীদের টয়লেট সুবিধা থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক টয়লেট নেই। আবার অনেক স্কুলে পর্যাপ্তসংখ্যক টয়লেট থাকার পরও এর সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না। ছাত্র-ছাত্রীরা প্রয়োজনে এর ব্যবহার করতে পারছে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে এগুলো ব্যবহার উপযোগী থাকে না। নোংরা-অপরিষ্কার টয়লেট রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ারও অন্যতম কারণ। সরকারের একটি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে জানাচ্ছে, স্কুলে প্রতি ৫০ শিক্ষার্থীর জন্য একটি টয়লেট থাকা প্রয়োজন। বাস্তবে রয়েছে প্রতি ১৮৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর জন্য একটি টয়লেট। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো টয়লেটের ব্যবহার উপযোগিতা। প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টয়লেট রয়েছে। জরিপে আরো জানা যায়, মাত্র ২৫ শতাংশ টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তবে অনির্দিষ্ট কারণে পরিষ্কার টয়লেটগুলো শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করতে পারছে না। ৮৪ শতাংশ স্কুলে উন্নত টয়লেট রয়েছে, এগুলোর মাত্র ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য খোলা রাখা হয়। মাত্র ৩৫ শতাংশ স্কুলে হাত ধোয়ার জন্য সাবান ও পানির সুবিধা রয়েছে। তিন ভাগের এক ভাগ স্কুলে উন্নত টয়লেটের অন্তত ৩০ ফিটের মধ্যে পানি ও সাবান পাওয়া গেছে। টয়লেটপ্রাপ্তির ব্যাপারে টয়লেট ব্যবহার নিয়ে গ্রামের ও শহরের স্কুলের মধ্যে তারতম্য রয়েছে। প্রাথমিকের ৪২ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং মাধ্যমিকের ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উন্নত টয়লেট ব্যবহারের অনুমতি পায়।

২০১৫ সালের ২৩ জুন স্যানিটেশন ব্যবহার উন্নয়নে ১১টি নির্দেশনা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিকে টয়লেট ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের নির্দেশনাও দেওয়া হয় পরিপত্রে। পরিপত্রে টয়লেট ঢাকনাযুক্ত প্লাস্টিকের পাত্র রাখা, জেন্ডারবান্ধব স্যানিটেশন নিশ্চিত করা, ছাত্রীদের পিরিয়ডের বিষয়ে একজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নারী হলে সেই বিদ্যালয়ের বাথরুম পরিষ্কার থাকে। বাথরুমের জানালা ছোট থাকার ফলে আলো ঢুকতে পারে না, আবার বিদ্যুৎ-সংযোগ থাকলেও বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে বাল্ব থাকে না। বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা ও অপসারণের ব্যবস্থা, প্রতিটি বিদ্যালয়ে কিচেন রাখা, হাইজেনিক ল্যাট্রিন নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো, নতুন বিদ্যালয় ভবনের নকশা পরিবর্তন আনা, বাথরুম পরিচ্ছন্ন রাখতে আলাদা তহবিল রাখা, স্টুডেন্ট কাউন্সিল জোরদার করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া। আর তা করতে পারলে এবং যে যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখলে স্কুল স্যানিটেশনের মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ে যেতে পারে।

শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ স্কুলে শৌচাগার সুযোগ পায় না। শিশুরা কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা স্কুলে কাটায়। এ সময় তাদের প্রস্রাব-পায়খানা করা স্বাভাবিক প্রকৃতি বিষয়। তবে এই সুবিধা না পাওয়া অমানবিক। যেসব প্রতিষ্ঠানে এ সুযোগ রয়েছে, সেখনে দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের বৈষম্য। কোনো কোনো জায়গায় টয়লেট শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয় না। যে ক্ষেত্রে টয়লেট থাকা না থাকা একই কথা। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উন্নত শৌচাগার থাকলেও অপরিষ্কারের কারণে ব্যবহার করা দুষ্কর। এগুলোতে ছাত্ররা শৌচকর্ম করে ছাত্ররা নানা জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে। পরিবার ও সমাজে এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সারা দেশে সব স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর জন্য নিরাপদ শৌচাগার প্রতিষ্ঠা করা গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close