প্রকৌশলী রিপন কুমার দাস

  ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

পর্যালোচনা

পৃথক বস্ত্রশিক্ষা অধিদফতর প্রয়োজন

বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের শতকরা ৮০ ভাগ বস্ত্র ও বস্ত্র সংশ্লিষ্ট খাত থেকে এসে থাকে। কিন্তু দেশে বস্ত্র খাতে দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। দেশের বস্ত্র খাতের তদারকির জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বস্ত্র অধিদফতর নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বস্ত্র অধিদফতর বর্তমানে চার ধরনের কার্য সম্পাদন করে থাকেÑ ১। দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত বায়িং হাউসগুলোর নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ করা, ২। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত পোশাক কারখানাগুলোর নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ করা, ৩। দেশের অভ্যন্তরে বস্ত্র খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ স্পিনিং মিল, উইভিং মিল, ওয়েট প্রসেসিং মিল ও নিটিং মিলগুলোর নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ করা ৪। দেশের চাহিদা অনুযায়ী বস্ত্র খাতের দক্ষ জনবল তৈরির জন্য এসএসসি, ডিপ্লোমা ও স্নাতক পর্যায়ের বস্ত্র প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করা।

বর্তমানে বস্ত্র অধিদফতরের অধীনে দেশে ডিগ্রি পর্যায়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পাবনা, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জোরারগঞ্জ, মিরসরাই, চট্টগ্রাম, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী, শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সিঅ্যান্ডবি রোড, বরিশাল, বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, কালিহাতি, টাঙ্গাইল, শেখ কামাল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, ঝিনাইদহ, ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পীরগঞ্জ, রংপুর এই সাতটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া শেখ রেহানা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গোপালগঞ্জ, শেখ হাসিনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেলান্দহ, জামালপুর, শেখ হাসিনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শিবচর, মাদারীপুর, শেখ রাসেল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সিলেট, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, কিশোরগঞ্জ, কাপাশিয়া টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এই ছয়টি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এছাড়া বস্ত্র অধিদফতরের অধীনে দেশে ডিপ্লোমা পর্যায়ে টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট বাজিতপুর, টাঙ্গাইল, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট রামাইগাছি, নাটোর, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট আলমনগর, রংপুর, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট বায়েজিদ, চট্টগ্রাম, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, দিনাজপুর, শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, গৌরনদী, বরিশাল, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট লবনচরা, খুলনা এই সাতটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া সুনামগঞ্জ টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, ফরিদপুর, সিলেট টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, সিলেট, ভোলা টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, ভোলা, শেখ রাসেল টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, মাদারগঞ্জ, জামালপুর, শহীদ কামরুজ্জামান টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, মান্দা, বেগম আমিনা মুনসুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, কাশীপুর, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, লালমনিরহাট, নারায়ণগঞ্জ টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, কুষ্টিয়া, ফেনী টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, ফেনি, শাহরস্তি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, শাহরস্তি, নেত্রকোনা টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, নেত্রকোনা, যশোর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, যশোর, জয়পুরহাট টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, আক্কেলপুর, জয়পুরহাট, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, কবিরহাট, নোয়াখালী, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, রূপগঞ্জ, শেরপুর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, শেরপুর এই ২০টি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

বস্ত্র অধিদফতরের অধীনে দেশে এসএসসি ভোকেশনাল পর্যায়ে টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট, ২৮৪ চম্পকনগর, কুমিল্লা, আটিয়াতলী, লক্ষ্মীপুর, শেরেবাংলা রোড, গল্লামারি, খুলনা, মালখানগর, সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ, চান্দুরা, গড়পাড়া, মানিকগঞ্জ, মিজমিজি, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গৌরীপুর, ময়মনসিংহ, শ্রীপুর, গাজীপুর, কমলাপুর, বায়তুল আমান, ফরিদপুর, খড়মপুর, আখাউড়া, বি-বাড়িয়া, অরনকোলা, ঈশ্বরদী, পাবনা, আদর্শপাড়া, বাংলাবাজার, গাইবান্ধা, ছদু চৌধুরী রোড, দক্ষিণ কাট্টলী, চট্টগ্রাম, বিরামপুর, দিনাজপুর, করমূলি, মারিয়া, কিশোরগঞ্জ, ২৮ আড়তদার পট্টি, ঝালকাঠি, রামু, কক্সবাজার, চরকলোনী, বরগুনা, গলাচিপা, পটুয়াখালী, আলমনগর, রংপুর, হাজীপাড়া, ঠাকুরগাঁও, বকশীগঞ্জ, জামালপুর, শেখহাটি, বাবলাতলা, যশোর, লালপুর, নাটোর, দশানী, বাগেরহাট, শালবন, খাগড়াছড়ি, সিপাইপাড়া, রাজশাহী, তালগাছি, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ, দক্ষিণ কালিন্দিপুর, রাঙ্গামাটি, কৃষ্ণপুর, মনোহরদী, নরসিংদী, রজাকপুর, নওগাঁ, বনানী, বগুড়া, তাহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজৈর, মাদারীপুর, মাঝবাড়ী, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ, গাবুয়া, নোয়াখালী, থানাপাড়া, কুষ্টিয়া, পারেরহাট রোড, পিরোজপুর, বালুঘাটা, বান্দরবান, কালিহাতি, টাঙ্গাইল, গফুরগাঁও, ময়মনসিংহ, রামাইগাছি, নাটোর এই ২৪টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ও আরো ১৮টি প্রতিষ্ঠান স্থাপন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

কিন্তু বর্তমানে বস্ত্র অধিদফতরের কার্যক্রম ব্যাপক হওয়ার কারণে অনেক সময় কাক্সিক্ষত সেবা প্রদান করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই বস্ত্র অধিদফতরের শিক্ষা সেলকে বস্ত্র অধিদফতর থেকে পৃথক করে বস্ত্র শিক্ষা অধিদফতর নামে পৃথক একটি প্রতিষ্ঠান চালু করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ ভবিষ্যতে প্রতিটি জেলায় টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এছাড়া দেশে কারিগরি শিক্ষার হার বাড়াতে ভবিষ্যতে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট স্থাপন করার প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে বস্ত্র অধিদফতরের মাধ্যমে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই পৃথক বস্ত্র শিক্ষা অধিদফতর স্থাপন করা একান্ত প্রয়োজন। এখানে উল্লেখ্য যে সরকার ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য খাতের স্বাস্থ্য শিক্ষার উন্নয়নের জন্য পৃথক স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর স্থাপন করেছেন।

এছাড়া ভবিষ্যতে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের মতো বেসরকারি বস্ত্রবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বস্ত্র শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা’ প্রণয়ন করে বস্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত করার প্রয়োজন হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রায় ১৫৩টি ডিপ্লোমা পর্যায়ের বস্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যা অন্যান্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো এমপিওভুক্তির দাবি রাখে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিএসসি ইন টেক্সটাইল সায়েন্স, বিএসসি ইন অ্যাপারাল ম্যানুফ্যাকচার টেকনোলজি, বিএসসি ইন নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচার টেকনোলজি, বিএসসি ইন ফ্যাসন অ্যান্ড ডিজাইন টেকনোলজি চালু রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্তির দাবি রাখে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালু রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানও ভবিষ্যতে এমপিওভুক্তির দাবি রাখে। তাই বস্ত্র শিক্ষা অধিদফতর স্থাপন করা একান্ত প্রয়োজন।

বর্তমানে দেশের বস্ত্র প্রতিষ্ঠান থেকে প্রচুর জনবল পাস করে বের হলেও চাকরি ক্ষেত্রে গিয়ে তারা উপযুক্ত সেবা দিতে পারছে না, তার বিপরীতে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ করতে হচ্ছে। দক্ষ জনশক্তির অভাবে আমাদের বস্ত্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক মানের সেবা দিতে পারছে না, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের বস্ত্র শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের দেশে একজন মধ্যম মানের বস্ত্র প্রকৌশলীকে বস্ত্র খাতের সব বিষয়গুলো অধ্যয়ন করতে হয় অর্থাৎ টোটাল টেক্সটাইল, অপর দিকে ভারতসহ অন্যান্য স্থানে বস্ত্র শিল্পের যেকোনো একটি উপখাতকে টেকনোলজি হিসেবে চালু করা হয়ে থাকে। ফলে তারা যে বিষয় পড়াশোনা করে সেই বিষয় তারা অত্যন্ত দক্ষ হয়, অপরদিকে আমরা সব বিষয় অর্থাৎ টোটাল টেক্সটাইল সম্পর্কে অবগত হই বিধায় কোনো উপখাতেই ভালোভাবে দক্ষ হতে পারি না, তাই চাকরির বাজারে আমরা উপযুক্ত সেবা দিতে পারছি না।

তাই মধ্যম মানের বস্ত্র প্রকৌশলদের চাকরির বাজারের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন উপখাতের ভিত্তিতে টেকনোলজি চালু করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কারিকুলাম স্থগিত করে টেক্সটাইলবিষয়ক সব টেকনোলজিগুলোকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কারিকুলামের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, এক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে সব টেকনোলজির পূর্বে টেক্সটাইল শব্দটি বসানো হয় অর্থাৎ সব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের টেকনোলজিগুলো ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক কাঠামোতে রাখলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, টেক্সটাইল বিষয়ে গার্মেন্ট খাতের অ্যাপারাল ম্যানুফ্যাকচারিং টেকনোলজির ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (টেক্সটাইল অ্যাপারাল ম্যানুফ্যাকচারিং টেকনোলজি) লিখতে হবে। টেক্সটাইল বিষয়ের বিভিন্ন উপখাতের ওপরে ভিত্তি করে প্রস্তাবিত টেকনোলজিগুলো সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিকগুলোর চালু করা সম্ভব হবে।

ফলে দেশে দক্ষ মধ্যম মানের বস্ত্র প্রকৌশলীর অভাব পূরণ করতে সক্ষম হবে। এছাড়া বস্ত্র খাতের দক্ষ শ্রমিক তৈরির জন্য এসএসসি ও এইচএসসি ভোকেশনাল পর্যায়ে পেশাওয়ারি এনটিভিকিউএফ-এর আলোকে নতুন নতুন ট্রেড চালু করতে হবে, ট্রেডগুলো হবেÑ ড্রেসমেকিং (টেক্সটাইল গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচার), সার্কুলার নিটিং মেসিন অপারেশন, টেক্সটাইল স্ক্রিন প্রিন্ট, টেক্সটাইল ব্লক ও বাটিক, সুইং মেশিন অপারেশন, টেক্সটাইল অ্যাম্বোয়ডারি, কারচুপি, টেক্সটাইল নিটওয়্যার মেকিং, টেক্সটাইল সোয়েটার মেকিং, টেক্সটাইল প্যাটার্ন মেকিং অ্যান্ড কাটিং, টেক্সটাইল উইভিং, টেক্সটাইল গার্মেন্ট ফিনিশিং, টেক্সটাইল ডাইং, টেক্সটাইল ফেব্রিক ফিনিশিং, টেক্সটাইল গার্মেন্ট ফিনিশিং, টেক্সটাইল অ্যাপারেল মার্চেনডাইজিং, আরো অন্যান্য। ফলে বস্ত্র খাতে দক্ষ জনশক্তির অভাব দূর হবে।

লেখক : ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর

ডোনাভান মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পটুয়াখালী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close