মনসুর হেলাল

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

মুক্তমত

বইমেলায় প্রত্যাশা

শুরু হয়েছে ভাষাশহীদদের প্রাণস্পন্দিত অমর একুশের বইমেলা। পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের যুগপৎ মেলবন্ধন ঘটে এই প্রাণের মেলায়; প্রতি বছর যা একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। ফুল পলাশের গন্ধ ছড়ানো ফেব্রুয়ারির এই বইমেলা আজ বাঙালি চেতনার যুগপৎ মিলনক্ষেত্র।

বইমেলায় আসে বিচিত্র ভাবনার হাজার হাজার বই। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ আরো কত কী। তবে যেকোনো বিষয়-ভাবনার পূর্বশর্ত হচ্ছে সৃজনশীলতা। যেখানে পাঠক তাদের মনস্তত্ত্বের অন্তর্নিহিত ক্ষুধা নিবৃত করতে চায় অপার আনন্দে। কারণ আমরা জানি, একটা সময় পুুস্তক পাঠে অঢেল আনন্দ হতো। সেই আনন্দের রেশ সমাজে, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে এমনকি ব্যক্তিজীবনেও রাখত দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। মনের কোনায় রেখে যেত পুস্তকের অন্তর্নিহিত বার্তা। এখনকার সমাজে পাঠক আছেন, বই প্রকাশিত হয় অজস্র্র, কিন্তু কাক্সিক্ষত সেই বইটি থাকে পাঠকের নাগালের বাইরে। কথাগুলো মনগড়া নয়। এগুলো পাঠকদের বর্তমান অভিব্যক্তি।

পাঠকরা দ্বিধাহীন চিত্তে বলছে, ‘মানসম্মত বইয়ের অভাবে তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে দেশীয় সাহিত্য থেকে।’ তবে মানসম্মত বই যে বাংলাদেশে হচ্ছে না, তা কিন্তু একদম ঠিক নয়। কিন্তু বিপণন এ ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। সম্প্রতি শিল্প সাহিত্যের কাগজ ‘জয়তী’-এর পক্ষ থেকে ‘বাংলাদেশের সাহিত্য বিষয়ে পাঠকের মতামত’ শীর্ষক একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, খুলনার ৬০০ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-প্রকৌশলী-উকিল-সাংবাদিক-এনজিওকর্মী অংশ নেন। জরিপের উদ্দেশ্য ছিল বর্তমান বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ কী ধরনের বই পড়ে, বইগুলো পড়ার জন্য কীভাবে নির্বাচিত করে, বইগুলোর কথা কেন মনে রাখেন, এ সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা লাভ করা। জরিপে ১১টি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল পাঠকদের সামনে। প্রশ্নগুলোর উত্তর যা এসেছে তাতে আতঙ্কিত হওয়ার জোগাড়। পাঠক শুধু সাহিত্যবিমুখই নয়, বইপড়া থেকেই অবস্থান করছেন অনেকদূরে। এমন বাস্তবতায় এ কথা বলা অসংগতি হবে না, পাঠকদের বইমুখী করা এখন জাতীয় দায়িত্ব বলেই আমি মনে করি।

প্রায় ৬০০ জন উত্তরদাতার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে পরিচালিত এ জরিপে দেখা গেছে, ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা বই পড়েন। ১৬ শতাংশ উত্তরদাতা একেকারেই বই পড়েন না। এরমধ্যে উপন্যাস পড়েন ৬৪ শতাংশ, গল্পের বই পড়েন ৪৪ শতাংশ, রহস্য উপন্যাস পড়তে ভালোবাসেন ৩১ শতাংশ, কবিতার বই পড়েন ২৯ শতাংশ, প্রবন্ধ পড়েন ২১ শতাংশ, রম্যরচনা পড়েন ২১ শতাংশ, ভ্রমণ কাহিনি পড়েন ১৮ শতাংশ, নাটক পড়েন ১৭ শতাংশ, শিশুসাহিত্য পড়েন ১২ শতাংশ আর অন্যান্য বই পড়েন ৪ শতাংশ পাঠক। পাঠক কোন কোন বিষয়ের বই পড়তে ভালোবাসেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল জরিপে। ১৫টি ক্যাটাগরিতে পাঠকের মতামত চাওয়া হয়। জরিপে দেখা গেছে, সামাজিক জীবনের বর্ণনামূলক বই পড়েন ৪৫ শতাংশ, যেসব বইয়ের মূলবস্তু থাকে প্রেমÑ এমন বই পড়েন ৩৮ শতাংশ, বৈজ্ঞানিক বই পড়েন ৩০ শতাংশ, ইতিহাসাশ্রয়ী বই পড়েন ২৯ শতাংশ, রাজনৈতিক বই পড়েন ২৯ শতাংশ, দর্শনের বই পড়েন ২৩ শতাংশ, অনুবাদ বই পড়েন ২৩ শতাংশ, রূপকথার বই পড়েন ২৩ শতাংশ, ব্যঙ্গ-কৌতুকের বই পড়েন ২৩ শতাংশ, ধর্মবিষয়ক বই পড়েন ১৯ শতাংশ, অর্থনৈতিক বই পড়েন ১৭ শতাংশ, খেলাধুলার বই পড়েন ১৭ শতাংশ, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে লেখা বই পড়েন ১৬ শতাংশ, গবেষণামূলক বই পড়েন ১১ শতাংশ, আত্মজীবনীমূলক বই পড়েন ৪ শতাংশ পাঠক।

জরিপে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি বই পড়া হয়েছে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বই। ২০ শতাংশ পাঠক এ অভিমত দিয়েছেন। ১ শতাংশ উত্তরদাতা যাদের নাম উল্লেখ করেছেন, তারা হলেনÑ প্রমথ চৌধুরী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, সত্যজিত রায়, সৈয়দ শামসুল হক, আরজ আলী মাতুব্বর, দস্তয়ভস্কি, নিকোলাই অস্ত্রভস্কি, রাকিব হাসান, আর্থার কোনান ডায়েল, ড্যান ব্রাউন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, রফিকুন নবী, আলী ইমাম, মুনির চৌধুরী, হরিশংকর জলদাশ, যতীন সরকার, সত্যেন সেন, মিহির সেনগুপ্ত। আরো আশ্চর্য হলোÑ হিটলারের মাইন ক্যাম্প পড়েছেন ১ শতাংশ, ওমাবার মাই ফাদারস ড্রিম পড়েছেন ১ শতাংশ পাঠক।

জরিপে একটি প্রশ্ন রাখা হয়েছিলÑ পাঠক যে বইগুলো পড়েছে তা কীভাবে তাদের হাতে এসেছে। এর কারণ হচ্ছে পাঠকের চাহিদা আছে কিন্তু জোগানের মাধ্যমটা কী, তা পরীক্ষা করা। প্রশ্নের উত্তরে দেখা যাচ্ছে, পাঠকদের মধ্যে অধিকাংশই নিজের গরজে খুঁজে বের করেছেন বই। জরিপে দেখা যায়, বই কিনে পড়েছেন ৩৫ শতাংশ, উপহার হিসেবে পেয়েছে তাই পড়েছেন ২৫ শতাংশ পাঠক, পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে বই পড়েছেন ৫ শতাংশ, ধার করে পড়েছেন ২০ শতাংশ, অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে কিনেছেন মাত্র ২ শতাংশ পাঠক। এই জরিপ নিয়ে হয়তো দ্বিমত থাকতে পারে। তবে একটা বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক এই মেলা হওয়ার কারণে দূর-দূরান্তের অনেক উৎসাহ পাঠক তার প্রয়োজনীয় বইটি সংগ্রহ করতে পারছেন না। রাজধানীর বাইরে প্রচুর পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না সমসাময়িক সাহিত্যকে। যার ফলে বই বিক্রির হার কমছে দিন দিন। কমে যাচ্ছে পাঠকশ্রেণি। ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে প্রকাশনা জগৎ। ফলে আমাদের সাহিত্যকে বাঁচাতে হলে সারা দেশে বই বিপণনের ব্যবস্থা যেমন করতে হবে; তেমনি প্রকাশনাগুলোকেও সৃজনশীল বইয়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলেই হয়তো আমাদের সাহিত্যের বন্ধ্যত্ব কিছুটা ঘুচবে। তৈরি হবে লেখক-পাঠকদের মেলবন্ধন। যা আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : ছড়াকার, কবি ও প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close