রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

বিশ্লেষণ

বিশ্বকে বার্তা দিল বাংলাদেশের ক্রিকেট

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ধারণাটি আসে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের জেনারেল ম্যানেজার গ্রাহাম হালবিশের মাথা থেকে। ১৯৮৮ সালে গ্রাহামের ধারণার বাস্তবায়ন ঘটে। ভিক্টোরিয়া ও সাউথ অস্ট্রেলিয়াকে ভেন্যু বানিয়ে আটটি দল নিয়ে শুরু হয় যুব বিশ্বকাপের প্রথম আসর। দ্বিতীয় আসর গড়ায় ১৯৯৮ সালে। এরপর থেকে প্রতি দুই বছর অন্তর মাঠে গড়াচ্ছে যুবাদের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট। ১৯৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আয়োজিত যুব বিশ্বকাপের প্রথম আসরে শিরোপা জেতে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট পরিবারের সাতটি দেশ (ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ) ও আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর (বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে, বারমুডা, কানাডা, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস) ক্রিকেটারদের নিয়ে তৈরি করা হয় একটি দল। মোট আটটি দল অংশ নেয় প্রথম আসরে। সিঙ্গেল লিগ পদ্ধতির এ টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তান। অ্যাডিলেড ওভালের ফাইনালে পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জেতে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট উইলিয়ামস ৪৭১ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরার হন। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ১৯টি উইকেট নেন মুশতাক আহমেদ। ১৯৯৮ সালে ১০ বছরের বিরতির পর দক্ষিণ আফ্রিকায় বসে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসর। এতে অংশ নেয় ১৬ দেশ। নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতে ইংল্যান্ড। প্রথমবার অংশ নিয়েই প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এবার কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকে বাংলাদেশ চারবারের রেকর্ড ট্রফিজয়ী ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে অভূতপূর্ব সাফল্যের দিন।

বাংলাদেশের এ জয়ের অভিনন্দন বার্তায় সয়লাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও। বিশ্ব ক্রিকেট তারকারাও বাংলাদেশ ও উদ্যমী ক্রিকেটারদের অভিনন্দন জানাতে ভুল করেননি। অন্যদিকে এ ট্রফি আকবরদের প্রাপ্য বললেন ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে। ভুলে যায়নি ভারত ক্রিকেট বোর্ডও। বিসিসিআই অভিনন্দন জানিয়েছে বাংলাদেশকে। আবার পাকিস্তানের অলরাউন্ডার শোয়েব মালিকও প্রশংসা করেছেন। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বিজয়ী হওয়ার জন্য অনেক অভিনন্দন। আমি টুর্নামেন্টটি খুব কাছ থেকে দেখেছি এবং দেখে মনে হচ্ছে, বিশ্বের অনেক তরুণ প্রতিভা এখান থেকে উঠে আসছে। তাদের অগ্রগতি দেখতে আমি উন্মুখ হয়ে আছি। তবে আপাতত ছেলেরা উদ্যাপন করুক বলে তিনি তার টুইট বার্তায় অভিনন্দন জানিয়েছেন। সঙ্গে যোগ হয়েছেন পাকিস্তানের নারী দলের ক্রিকেটার সানা মীরও। বাংলাদেশের প্রশংসায় অভিনন্দন বার্তায় তুলে ধরেন, বিশ্বকে শক্তিশালী বার্তা দিল বাংলাদেশের ক্রিকেট। বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মানবতার দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না, জাতির পিতার ওই উদ্যমী বক্তব্য শুধু সাত কোটি মানুষকেই মন্ত্রমুগ্ধ করেনি, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে সহায়তা করেছে। শুধু তাই নয়, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পাকিস্তানের বর্বরতা আর শোষণ, নির্যাতন ও শত্রুমুক্ত করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের।

আজ ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ এক বারুদ। কাটারমাস্টার মুস্তাফিজ থেকে অলরাউন্ডার সাকিব- সবই বাংলাদেশ। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বোলিংয়ে ছিল আগুন, ফিল্ডিংয়ে রীতিমতো বারুদ। লক্ষ্যটাও ছিল স্থির। ব্যাটিংয়ের শুরুটাও ছিল দারুণ। খেলার মাঠে নানা নাটকীয়তার মাঝে টাইগারদের একেবারে খাদের কিনারা থেকে যেন আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা। এই লড়াকু মানসিকতার সঙ্গে পেরে ওঠেনি ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দল। তাদের হারিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছে বাংলাদেশ। তাই ৯ ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য সত্যিই স্মরণীয় দিন। এমন দিন কখনো আসেনি বাংলাদেশের ক্রিকেটে। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ, গৌরবান্বিত হওয়ার কৃতিত্ব। ক্রিকেট উন্মাদনার এ রেকর্ড অর্জন আমাদের করতেই হবে, আমরা বাঙালি, আমরাই পারি এ বিষয়গুলো প্রচন্ডভাবে কাজ করেছে। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো এটি আয়োজিত হয় এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কায়। শিরোপাও থেকে যায় এশিয়াতেই। সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠের ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে ৬ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জেতে ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ ৩৪৮ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও পাকিস্তানি বোলার জাহিদ সাইদ ১৫ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন। সিরিজ সেরা হন ভারতের যুবরাজ সিং। ২০০২ সালে চতুর্থ আসর বসে নিউজিল্যান্ডে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জেতে অস্ট্রেলিয়া। অজি যুবারা সাত উইকেটে হারায় প্রোটিয়া যুবাদের। ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আয়োজক হয় বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ষষ্ঠ আসর বসে শ্রীলঙ্কায়। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে ৩৮ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো যুব বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে পাকিস্তান।

২০০৮ সালে মালয়েশিয়াতে বসে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আসর। দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। কিনরারা একাডেমি মাঠে বৃষ্টি-আইনে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১২ রানে হারিয়ে শিরোপা হাতে তোলেন বিরাট কোহলি। নেপালকে সাত উইকেটে হারিয়ে প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০১০ সালে অষ্টম অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ আয়োজক নিউজিল্যান্ড। তৃতীয়বারের মতো শিরোপা জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালে অজিদের কাছে ২৫ রানে হার মানে পাকিস্তান। আয়ারল্যান্ডকে ১৯৫ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এ আসর থেকে উঠে আসেন ইংল্যান্ডের জো রুট, জস বাটলার, বেন স্টোকসরা। দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি কক, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জ্যাসন হোল্ডার, অস্ট্রেলিয়ার মিশেল মার্শ ও নিউজিল্যান্ডের ডগ ব্রেসওয়েল উঠে আসেন। ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় গড়ায় যুব বিশ্বকাপ। তৃতীয়বারের মতো ট্রফি জিতে নেয় ভারত। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে ৬ উইকেটে হারায় তারা। আফগানিস্তানকে সাত উইকেটে হারিয়ে প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশের এনামুল হক বিজয় হন টপ স্কোরার। পুরো টুর্নামেন্টে ৩৬৫ রান করেন এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান। সর্বোচ্চ ১৯ উইকেট নেন ?চার বোলার। এরা হলেনÑ রিসি টপলি, তাসকিন আহমেদ, অ্যাস্টন অ্যাগার ও নজিবুল্লাহ জাদরান। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। চ্যাম্পিয়ন হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। দুবাই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাকিস্তানকে ৬ উইকেটে হার?ায় তারা। আর নিউজিল্যান্ডকে ৭৭ রানে হারিয়ে যুব বিশ্বকাপে চতুর্থবারের মতো প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দশম আসর থেকে উঠে আসেন কাটারমাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার কাগিসো রাবাদা। যুব বিশ্বকাপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নাম লেখান এরা। দুজনই বিশ্ব ক্রিকেটে এখন আলো ছড়াচ্ছেন। বিশ্বকাপ জেতার জন্য বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে অভিনন্দন। ক্রিকেটের জন্য অবশ্যই দুর্দান্ত কিছু করা উচিত বলে মন্তব্য করে ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ইরফান পাঠানও তার অভিনন্দন জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশি ক্রিকেট তারকা থেকে শুরু করে ক্রিকেটভক্তকুল বাঙালির ক্রিকেট এ জয়ের আনন্দ নিয়ে ভাসছে। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, গবেষক ও সব শ্রেণি-পেশার মানুষসহ সেই দূরের গ্রামের ছোট্ট কিশোররাও বাংলাদেশের এ জয়ে নিজেদের উচ্ছ্বাস আটকে রাখতে পারেনি। আমাদের আটকে রাখা সম্ভব নয়। আমরা দুর্দান্ত। আমরা উদ্যমী। আমরা উড়ে যাব দেশ থেকে দেশান্তরে। আমরা জয় করব আমাদের স্বপ্নকে। আমাদের আগের নারী-পুরুষের সর্বস্ব ত্যাগে অর্জিত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব। শেখ মুজিব আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, বাঙালিরা বীরের জাতি। বাঙালিরা একত্র হয়ে সবকিছু জয় করতে পারে। যে বাঙালি তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে সমবেত হয়ে অধিকার অর্জন করতে পারে; যে জাতি সব অন্ধকারের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে পারেÑ এ জাতিকে কে দাবিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে? জয় হয়েছে আমাদের আত্মপ্রত্যয় ও সাহসের। এ প্রাপ্তি বাঙালি জাতিকে দিয়েছে ক্রিকেট বিশ্ব বিজয়ের গৌরব। অভিনন্দন টাইগারস। অভিনন্দন বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close