মোহাম্মদ আবু নোমান
বিশ্লেষণ
সু চির মিথ্যাচার ও আদেশ প্রত্যাখ্যান
শান্তির মুখোশে নোবেলজয়ী, ভয়ংকর ক্ষমতালোভী, অহিংস নেত্রীখ্যাত, বহুরূপী, ধাপ্পাবাজ, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতীক তকমাধারী অং সান সু চি শতচেষ্টা করেও তার সহিংসতার মুখ ঢাকতে পারেননি। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দাঁড়িয়েও সু চি মিথ্যা বলেছেন। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আইনি সিদ্ধান্তদাতা সংস্থা বা আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে। হত্যা-গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো বীভৎস ঘটনা করেও মিয়ানমার পার পেয়ে গেলে সেটা হতো গোটা বিশ্বের জন্যই লজ্জাকর। আইসিজের রায়ের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের এক বড় নৈতিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। এক অর্থে এ নৈতিক বিজয় বাংলাদেশেরও।
সু চি আইসিজেতে গণহত্যার পক্ষে মিথ্যা সাফাই গেয়েছিলেন। বাস্তবতা হচ্ছে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছেন, এই ছবি স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা হয়েছিল। সুতরাং সু চি যখন আদালতে সেনাবাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী হামলার কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দেশত্যাগ করেছেন বলে অসত্য মন্তব্য করেছিলেন তার ওই যুক্তি ধোপে টেকেনি। আদালতকে তিনি বলেছিলেন, রাখাইনের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের (রোহিঙ্গা শব্দটিও তিনি বলেননি) বিতাড়নের বিষয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধ হলেও গণহত্যা নয়। এটাও মিথ্যা কথা। কেননা, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে ৪৪৪ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়, হত্যা, দলবদ্ধ ধর্ষণ, শারীরিক লাঞ্ছনার ব্যাপক প্রমাণ রয়েছে। এসব কর্মকান্ড মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা-বিষয়ক বিচারের আওতায় পড়ে।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের আচরণ সব সময়ই শুধু শঠতা, অমানবিকতাই নয়, ছিল শতভাগ ন্যায়নীতির বিরোধীও। হত্যা, ধর্ষণ, আগুন জ্বালিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়াসহ তাদের জোর করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার নীতি। হিটলারের নাৎসি সরকার যেমন ইহুদি জনগোষ্ঠীকে গ্যাস চেম্বারে পুরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, সু চির সরকারও হত্যার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সব রকমভাবে সন্ত্রস্ত করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে এসব মানুষের রাজনৈতিক ও আবাসিক অস্তিত্ব অস্বীকার করতে চেয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিপীড়ন করে ভিটেমাটি থেকে মুছে দেওয়ার বিভীষিকা দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখের সামনে ঘটেছে। রাখাইনে তাদের ভিটেমাটি বুলডোজার চালিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তাদের বসতভিটা এখন অচেনা জনপদে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোনো একসময় রোহিঙ্গা জনবসতি ছিলÑ এমনটা অনুমান করাও এখন দুঃসাধ্য। দায়িত্বশীল রাষ্ট্রগুলোর সীমাহীন গাফিলতি ও স্বার্থের হিসাব-নিকাশের কারণে মিয়ানমার এমন দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে।
রোহিঙ্গা মুসলমানরা ফিরে যেতে হলে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা মিয়ানমারের বাসিন্দা ছিল। কিন্তু যেখানে ব্যাপক নিপীড়ন, দলবদ্ধ ধর্ষণ ও গণহত্যার মুখে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সম্পদ, সম্ভ্রম সব হারিয়ে শুধু প্রাণটুকু নিয়ে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বানের পানির মতো বাংলাদেশে ঢুকছে তারা। ১৯৮২ সাল থেকে সামরিক জান্তা মুসলমানদের নাগরিক ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগত অধিকার কেড়ে নেয়। ১৯৯৪ সাল থেকে জন্ম নেওয়া শিশুদের সরকারি জন্মসনদের আবেদনও প্রত্যাখ্যান করা হয়। রোহিঙ্গাদের বাদ রেখেই চালানো হয় ২০১৪ সালের আদমশুমারি। তাহলে এসব রোহিঙ্গা কীভাবে তাদের নাগরিকত্বের পরিচয় দেবে?
বহু দিন ধরে রাখাইনে গণহত্যা, দলবদ্ধ ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিস্তর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সু চি বলেছিলেন, তারা ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছেন। বয়োবৃদ্ধ পুরুষ, মহিলা, শিশুরাও কি সন্ত্রাসী? এর কিছুদিন পর বাকপটুতার সঙ্গে সু চি বলেছেন, ‘তিনি কিছুই শোনেননি, কিছুই জানেন না...। ‘রাখাইন থেকে মুসলিমরা কেন পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে খুঁজে দেখবেন’। সারা পৃথিবী দেখছে কেন রাখাইন থেকে তারা পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে আর সু চি জানেন না? রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এক হওয়ার ডাক দিয়ে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান বলেছিলেন, ‘মুসলমানরা পালাও, নইলে সবাইকে মেরে ফেলব’। আর সু চি বলেন, ‘রাখাইন থেকে মুসলিমরা কেন পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে...’? এভাবে বারবার সত্যের অপলাপ করে আসছেন মিথ্যাশ্রয়ী সু চি।
বিশ্বের বিবেকবান ও শান্তিপ্রিয় মানুষ যখন হতাশ! রোহিঙ্গা গণহত্যার দুই বছর পরও ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিবেচনাতেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অপারগ থেকেছে। সেখানে দ্য হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায় সত্য, সভ্যতা ও মানবতার এক মাইলফলক বিজয়। আমরা বলব, আইজিসে একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। আইসিজের দৃষ্টান্তমূলক ও যুগান্তকারী আদেশে বিশ্বব্যাপী প্রশান্তি বয়ে এনেছে। গণহত্যা বন্ধে যত রকম যা কিছু করা প্রয়োজন, মিয়ানমারকে সব ব্যবস্থাই করতে হবে। আইসিজের আদেশে এমন কোনো দ্ব্যর্থতাবাচক নির্দেশনাও নেই যে, শব্দের ফাঁকফোকর বের করে মিয়ানমার সময়ক্ষেপণের কৌশল নিতে পারে। আদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি দিক হলো প্যানেলের ১৭ জন বিচারকের সবাই-ই অভিন্ন মতে এককাট্টা হয়েছেন। প্যানেলের সবাই অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। তারা এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী চরম অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এই আদেশ দেওয়ার বিষয়ে বিচারকদের সর্বসম্মতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এমনকি এই বেঞ্চে মিয়ানমারের পক্ষ থেকেও যে বিচারককে নিয়োগ করা হয়েছে, তিনিও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন এবং গাম্বিয়া মামলাটি ঠিকমতো উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে যে বিতর্ক তোলা হয়েছিল, তাও সবাই নাকচ করে দিয়েছেন। চীন, ভারত, জাপান ও রাশিয়ার বিচারকরাও আদালতের আদেশে সমর্থন দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক আদালতে প্রাথমিক বিজয় এখন রোহিঙ্গা সংকটের চূড়ান্ত সমাধানের পথে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশেরও। এখন জরুরি নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠীর স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তন। কারণ যেকোনো মূল্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনই আমাদের লক্ষ্য। এই প্রক্রিয়া যত দীর্ঘায়িত হবে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বিপুল খরচের বোঝা ততই ভারী হবে। এর সামাজিক ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিরূপ প্রভাবও গুরুতর। এ-সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাহেও আন্তর্জাতিক মহলকে এগিয়ে আসতে হবে আন্তরিকতার সঙ্গে।
আদালত কেবল রোহিঙ্গাদের হত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়ন বন্ধের কথাই বলেননি, একই সঙ্গে এসব অপরাধে সামরিক বাহিনীর উসকানি বন্ধের নিশ্চয়তা চেয়েছেন। গণহত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত সব আলামত রক্ষার নির্দেশনাও তাৎপর্যপূর্ণ। আইসিজের মাধ্যমে রাতারাতি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটি নয়। তবে এটি অবশ্যই আশাব্যঞ্জক সূচনা। চার মাসের মধ্যে আদেশ অনুযায়ী মিয়ানমার কী করেছে, সেটি আদালতকে জানাতে বলা হয়েছে। আইসিজের আদেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার মধ্যেই গত শনিবার মধ্যরাতে কিন টং গ্রামে কোনো ধরনের সংঘাত বা উসকানি ছাড়াই নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর কামান হামলা চালিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এতে দুই নারী নিহত এবং অন্তত সাতজন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী ছিলেন। এ নিয়ে চলতি বছরে দ্বিতীয়বারের মতো রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হলো। সো তুন নামে এক রোহিঙ্গা জানান, হামলায় দুটি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। তিনি বলেন, সেনারা সব সময় ভারী অস্ত্র দিয়ে গুলি করে এলাকায় যাকে সন্দেহ হয় তাকেই গুলি করে। আমরা আতঙ্কে থাকলেও এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে ছেড়ে যাওয়া একেবারে অসম্ভব।
গণহত্যা থেকে রাখাইনের সংখ্যালঘুদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মুখপাত্র লিজ থ্রোসেল বলেন, আদালতের বিধিবদ্ধ আইন ও সনদের অধীন বাধ্যবাধকতা তাৎক্ষণিক ও নিঃশর্তভাবে রীতিমাফিক পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের মহাসচিব বলে দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীন আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ মেনে চলতে মিয়ানমার বাধ্য। আদেশটি দৃষ্টান্তমূলক ও যুগান্তকারী হলেও প্রয়োগটি যথাযথ হবে, কী হবে না, সন্দেহ রয়েছে। আদেশ পক্ষে গেছে বলে গা ছাড়া দেওয়ার সুযোগ নেই। আইসিজের আদেশের ফলে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সমঝোতা স্মারক আর আগের মতো পথের কাঁটা নয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রয়োজনে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের দ্বারা অব্যাহত কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টিতে বাংলাদেশের সক্রিয় হয়ে ওঠার এটিই মোক্ষম সময়। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে অং সান সু চির আবেদন খারিজ হওয়ার মাধ্যমে গণহত্যার অভিযোগে রাষ্ট্রটি আসামির কাঠগড়ায়। এটি মিয়ানমারকে সমর্থনকারী দেশগুলোর জন্যও শিক্ষা।
আদালতের রায় ব্যাপক আশাবাদ জাগ্রত করলেও বিচার পাওয়ার পথটি যে অনেক লম্বা; সেটি মামলার বাদী গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবু বকর তামবাদুর মন্তব্য থেকে বোঝা যায়। তিনি বলেছেন, ‘আমরা জানি, এই আদেশ এক দিনে রোহিঙ্গাদের জীবন বদলে দেবে না। তবে এটি একটি প্রক্রিয়ার সূচনা, যার মাধ্যমে আমরা আশা করি, এক দিন তারা নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে রাখাইনে ফিরে যেতে পারবেন।’ আমরা গাম্বিয়া, বিশেষ করে দেশটির আইনমন্ত্রী এবং ওআইসির প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট
"