নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৯ জানুয়ারি, ২০২০

পর্যালোচনা

সম্পদের বৈষম্য ও টেকসই উন্নয়ন

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের শতকরা ৯০ ভাগই ছিল কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতী মানুষ। তারা এই অর্থনৈতিক বৈষম্য অবসানের জন্যই জীবনপণ যুদ্ধ করেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর চার যুগ অতিবাহিত হলেও দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য হ্রাস পায়নি। ধনী আরো ধনী হচ্ছে। গরিব হচ্ছে আরো গরিব। যত দিন যাচ্ছে এই বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। কমছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৭০ ডলার, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯০৯ ডলার। কিন্তু তার পরও কি ধনী-গরিব বৈষম্য হ্রাস পাচ্ছে? শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই একই অবস্থা বিরাজ করছে। সম্প্রতি অক্সফাম প্রকাশিত প্রতিবেদনে সে বিষয়টিই উঠে এসেছে। উঠে এসেছে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্র।

বিশ্বে ধনকুবেরের সংখ্যা গত এক দশকে দ্বিগুণ হয়েছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের কাছে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তার চেয়ে বেশি সম্পদ আছে এসব ধনকুবেরের কাছে। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং করপোরেট ব্যাবসায়ীদের নিয়ে সুইজারল্যান্ডে ২১ থেকে ২৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-২০২০। এই সম্মেলন সামনে রেখে অক্সফাম প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ৪৬০ কোটি দরিদ্র মানুষের যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তা থেকে বেশি সম্পদ রয়েছে ২ হাজার ১৫৩ জন ধনকুবেরের কাছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সারা বিশ্বে নারীরা প্রতিদিন কোনো ধরনের মজুরি ছাড়া প্রায় ১ হাজার ২৫০ কোটি ঘণ্টা কাজ করে। এই শ্রমঘণ্টার বার্ষিক মূল্য কমপক্ষে ১০ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। বৈশ্বিক অসমতা নিয়ে এই প্রতিবেদন প্রতি বছর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে তুলে ধরে অক্সফাম। এবারের প্রতিবেদনে কিছু অবিশ্বাস্য তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বের ২২ জন ধনীর সম্পদ পুরো আফ্রিকার নারীদের সম্পদের চেয়ে বেশি। বিশ্বের মোট ধনকুবের মধ্যে ১ শতাংশ ধনকুবের যদি ১০ বছর ধরে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কর বেশি দিতেন, তবে শিশু ও প্রবীণ সুরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ১১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হতো। অক্সফাম ইন্ডিয়ার প্রধান অমিতাভ বিহার বলেন, আমাদের ভঙ্গুর অর্থনীতির সঙ্গে ধনকুবেরদের পকেট জড়িত। এই ধনকুবেরদের বড় ব্যবসার কারণে সাধারণ নারী ও পুরুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অসমতার এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ধনী ও গরিবের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে, তা কমবে না। বিশ্বের ৪২ শতাংশ নারী চাকরি বা অর্থের বিনিময়ে কাজ করতে পারেন না। কারণ তাদের সময় যায় পরিবারের সদস্যদের সেবা-যতেœর কাজে। তবে এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নারীদের এই কাজ অর্থনীতি, ব্যবসা ও সমাজের চাকা সচল রেখেছে। নারীদের এই কাজ বিশ্বের মাত্র ৬ শতাংশ পুরুষ করেন। নারীরা লেখাপড়ার সুযোগও কম পান। একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য যে উপার্জন প্রয়োজন, তা করার সুযোগ তাদের খুব কম। এ ছাড়া বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় তাদের মতামত দেওয়ার সুযোগও তেমন নেই। বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিশ্বাস করে, পুঁজিবাদের বর্তমান অবস্থা উপকারের চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। অ্যাডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটারের বার্ষিক জরিপে এ কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ব্যবসা, সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের বিশ্বাস কতটুকু, তা নিয়ে জরিপ চালিয়ে থাকে অ্যাডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটার। তবে এই প্রথম পুঁজিবাদের মতো বিষয় নিয়ে জরিপ চালাল সংস্থটি। বর্তমান বিশ্বে মানুষ পুঁজিবাদকে কীভাবে দেখে, সেটা জানতে বিশ্বের ২৮ দেশের ৩৪ হাজার মানুষের মধ্যে জরিপ চালিয়েছে অ্যাডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটার। পশ্চিমের উদার গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স থেকে শুরু করে চীন, রাশিয়ার মতো দেশের জনগণও এই জরিপে অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশের কথা, বর্তমান পুঁজিবাদ উপকারের চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ থেকে বহু বছর আগে (১৯৫২ সালে বিশ্বশান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন ভ্রমণ কালেই বিষয়টি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যত দিন দুনিয়ায় থাকবে; তত দিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ২৩৪ পৃষ্ঠা)।

সুইজারল্যান্ডের দাভোসে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতাদের বার্ষিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সম্মেলনের আগে ২০ জানুয়ারি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে অক্সফাম। বিশ্ব অর্থনীতির অসাম্যের মাত্রাকে সামনে আনার জন্য বুচু দেবী নামে ভারতীয় এক নারীর প্রসঙ্গ তুলে ধরেন ইন্ডিযান অক্সফাম প্রধান অমিতাভ বিহার। বুচু দেবী প্রতিদিন ১৬-১৭ ঘণ্টা কাজ করেন। তিনি হেঁটে তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে সেখান থেকে পানি নিয়ে আসেন, তারপর রান্না করা, ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করার পাশাপাশি নিম্ন মজুরির একটি কাজ করেন। অপরদিকে দাভোসে সমবেত হওয়া কোটিপতিরা তাদের ব্যক্তিগত বিমা, ব্যক্তিগত জেট, বিলাসবহুল জীবনধারা নিয়ে আছেন। এই বুচু দেবী শুধু একজনই নন। ভারতে প্রায় প্রতিদিন এ ধরনের নারীর দেখা পাওয়া যায়। আর বিশ্বজুড়েই এ একই গল্প। এটি অবশ্যই পরিবর্তন করা দরকার। নিশ্চিতভাবে এ কোটিপতিদের বাড়বাড়ন্তের অবসান ঘটানোও প্রয়োজন।

বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে এ রকম অসংখ্য বুচু দেবী রয়েছেন, যারা ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার দূর থেকে হেঁটে খাবার পানি জোগাড় করেন। রান্নাবান্না করেন। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোসহ সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম করেন। বাংলাদেশের কৃষি খাতের সাফল্যের পেছনে নারীর বিশাল অবদান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সেই অবদানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই তাদের। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, কৃষিতে নারীরা যে শ্রম দেন তার ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশের ক্ষেত্রে তার কোনো পারিশ্রমিক পান না। আর বাকি ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশের ক্ষেত্রে তারা যে পারিশ্রমিক পান তা শ্রমমূল্যের চেয়ে অনেক কম। বৈষম্যের কারণে প্রতি বছর একজন নারী একজন পুরুষের চেয়ে বছরে প্রায় ২৪ হাজার টাকা কম উপার্জন করেন, যা তাদের আর্থসামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

সারা বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ এমন দেশে বসবাস করেন, যেখানে বৈষম্য বাড়ছে। বিশ্বের ৭১ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখন বৈষম্যের সঙ্গে লড়াই করছেন। তবে আয় ও সম্পদ অর্জনে ধনী মানুষরাই এগিয়ে আছেন। ধনীদের কাছে ক্রমেই সম্পদ ও আয় পুঞ্জীভূত হয়ে পড়ছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে বেশির ভাগ উন্নত দেশ ও কিছু মধ্যম আয়ের দেশে বৈষম্য বাড়ছে। মধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে ভারত ও চীন উল্লেখযোগ্য। জাতিসংঘের সামাজিক প্রতিবেদন ২০২০-এ বৈষম্যের এই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকের বিশ্ব পরিস্থিতি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সামাজিক সূচকের বৈষম্য বেশি এমন দেশে দারিদ্র্য কমানোর কার্যকারিতা কম। গত কয়েক দশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও জীবনযাপনের উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও কয়েকটি দেশে বৈষম্য বাড়ছে। প্রযুক্তি উদ্ভাবন, জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসনÑ এই চারটি বিষয় বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, প্রযুক্তি উদ্ভাবন অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ালেও মজুরি বৈষম্য তৈরি করছে। অনেক দেশে নিজস্ব আয়বৈষম্য কমলেও এক দেশের মানুষের আয়ের সঙ্গে অন্য দেশের আয়ের ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানুষের আয় সাব-সাহারা অঞ্চলের মানুষের আয়ের চেয়ে ১১ গুণ বেশি। আবার সাব-সাহারা অঞ্চলের মানুষের আয়ের চেয়ে উত্তর আমেরিকার মানুষের আয় ১৬ গুণ বেশি। জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ১৬টি দেশের নিজেদের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের আয়ের সঙ্গে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয়ের তুলনা করা হয়। দেশগুলো হলোÑ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, ডেনমার্ক, বুলগেরিয়া, ব্রাজিল, বলিভিয়া, আজর্িেন্টনা, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, ভারত, চীন, বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর ও কঙ্গো। এসব দেশের মধ্যে নিজেদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেমন আয়বৈষম্য আছে, তেমনি অন্য দেশের মানুষের সঙ্গেও আয়বৈষম্য স্পষ্ট। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের ধনী ১০ শতাংশ মানুষের আয় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন ও ডেনমার্কের মতো উন্নত দেশের সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয়ের চেয়ে অনেক কম। অপরদিকে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় ওই তালিকায় উল্লিখিত ১০ দেশের সবচেয়ে গরিব মানুষের আয়ের চেয়ে কম। বাংলাদেশে ডিজিপির প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ পরিবারের আয়ের চেয়ে ১১৯ গুণ বেশি। বাংলাদেশ দুর্বল অর্থনীতি থেকে দ্রুত টেকসই অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, সম্পদের বণ্টন এখানে যথেষ্ট নয়। বৈষম্য এখনো উচ্চমাত্রায়। দশটিতে অবৈধ এবং অনৈতিক উপায় গ্রহণ করে ধনী হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। শ্রমিকশ্রেণির জন্য ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক খাতে ব্যয় এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা এখনো বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্পটি বৈষম্যকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়, যা বিপজ্জনক। যদি বাংলাদেশ সম্পদের বৈষম্য কমাতে ব্যর্থ হয়, তবে কোনো উন্নয়ন টেকসই হবে না। হবে না মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের স্বপ্নপূরণ।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close