ইমাম গাজ্জালী

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২০

মুক্তমত

আজ ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহ

আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগে, ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারিতে ভারতের পাঞ্জাবের জালিনওয়ালাবাগের মতোই এক নির্মম হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায়। সেদিন ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলকারীদের ওপর বিনা উসকানিতে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই চার সহস্রাধিক লোক হতাহত হয়েছিল। সলঙ্গার হাটে সংঘটিত এই পৈশাচিক হত্যাকান্ড ইতিহাসে সলঙ্গা বিদ্রোহ নামে খ্যাত। আজ সেই বিদ্রোহের ৯৮তম বার্ষিকী।

সিরাজগঞ্জের গাড়াদহ নদীর তীরেই বসত সলঙ্গার হাট। সিরাজগঞ্জ তো বটেই, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, টাঙ্গাইল ও বগুড়া থেকে নানা পণ্যবাহী মহাজনী নৌকা এসে ভিড়ত সলঙ্গার হাটে। এত নৌকা আসত যে, নদীর ঘাট প্রায় দেড় মাইল লম্বা হয়ে যেত। সে যুগেই ওই হাটে লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটত।

উপমহাদেশের ইতিহাসে ১৯২০-১৯২২ সাল ছিল মূলত গান্ধী যুগ। কারণ গোটা ভারতবর্ষ তখন মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। খেলাফত আন্দোলনে গান্ধীর সমর্থনে হিন্দু মুসলমানের মিলনের সুর বেজে ওঠে। ভারতজুড়ে যে আন্দোলনের জোয়ার আসে, সেখান থেকে বাদ যায়নি প্রত্যন্ত সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা। যদিও পরবর্তীতে রাজনীতির কূটচালে সেই মিলনে বিচ্ছেদ ঘটে, পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে প্রধান দুই সম্প্রদায়।

১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি, দিনটি ছিল শুক্রবার, বড় হাটবার। বিলেতি পণ্য বর্জনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছিল কংগ্রেস ও খেলাফতের কর্মীরা। সলঙ্গায় সেদিনের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেসময়ের তরুণ কংগ্রেসকর্মী আবদুর রশিদ, যিনি পরবর্তীতে আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ নামেই খ্যাতি পেয়েছিলেন। একপর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এবং গণ-আজাদী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেছিলেন।

আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের সংক্ষেপিত বয়ান, ‘আমি প্রায় তিনশ’ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে সলঙ্গা হাটে কাজ করছি। এমন সময় পাবনার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. আর এন দাস, সিরাজগঞ্জ মহকুমার এসডিও মি. এসকে সিনহা বা সুনীল কুমার সিংহ (তিনি ছিলেন আইসিএস লর্ড বিজয় কুমার সিংহ রায়ের ছেলে) এবং পাবনা জেলার ব্রিটিশ পুলিশ সুপার ৪০ জন আর্মড পুলিশ নিয়ে হাটে উপস্থিত হন। আমি ছিলাম কংগ্রেস অফিসে। বিশাল বপু টাক মাথাওয়ালা এসপি সাহেব আমাকে দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। আগে থেকেই তার খাতায় আমার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ জমা হয়েছিল। তাই আমাকে হাতের কাছে পাওয়ার পর তার আর তর সইল না। তৎক্ষণাৎ আমার ওপর নির্মম দৈহিক নির্যাতন শুরু করেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমার নাক-কান ফেটে দেহের নানা অংশ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সলঙ্গা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা আমার পিতামহ ও পিতার অনেক ভক্ত মুরিদান ছিলেন। তারা তো বটেই, হাটের সাধারণ হাটুরেরাও এ নির্যাতন দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার জ্ঞান ফিরে আসে। আমাকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় ভিড়ের মধ্য থেকে জনৈক ব্যক্তি ‘নড়ি’ (গরু খেদানোর লাঠি) দিয়ে পুলিশ সুপারের মাথায় সজোরে আঘাত হানে। ইংরেজ সাহেবের টাকমাথা ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। পুলিশ সুপার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সবাই যখন পুলিশ সুপারকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন হাটের তিন দিক থেকে লাখো জনতা আমাকে মুক্ত করার জন্য এগিয়ে এলো। ক্ষিপ্ত জনতা নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্মড পুলিশ সারিবদ্ধ হয়ে জনতার দিকে রাইফেল তাক করে হাঁটু গেড়ে বসে।’

ইতোমধ্যে পুলিশ সুপারের সংজ্ঞা ফিরে আসে। পুলিশ সুপার পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে পরামর্শ করে গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ সুপার হুকুম দিলেন ‘ফায়ার’। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল ৩৯টি রাইফেল। অবিরাম গুলিবর্ষণ চলে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর। গুলিবিদ্ধ হয়ে আমার সামনেই সাতজন নিহত হয়। অবিরাম গুলিবর্ষণে কতজন যে নিহত হয়ে হাটের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল, তার কোনো হিসাব ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকেও পাওয়া যায়নি। সরকারি তদন্ত রিপোর্টে হতাহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার বলে হিসাব পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কত শত আহত হয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে পথঘাটে ঝোপে-জঙ্গলে মৃত্যুবরণ করেছে এবং কত শত আজও অজ্ঞাত, তার হিসাব নেই। সরকারি কোপদৃষ্টিতে পড়ে নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে কখনো মৃত্যুর কথা প্রকাশ করেনি স্বজনরা।

অবিরাম গুলিবর্ষণে আর্মড পুলিশের সব গুলি শেষ হয়ে যায়। এ খবর মুহূর্তে সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষিপ্ত, উত্তেজিত, মার খাওয়া জনতা ফালা, লাঠি, সরকি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে চারদিক ঘিরে সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে মুক্ত করে দিয়ে অনুরোধ করেন, ‘আপনি যেমন করেই হোক জনতাকে বুঝিয়ে শান্ত করুন এবং ফিরিয়ে নিন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অনুরোধ আমি গ্রহণ করলাম। কারণ অহিংস আন্দোলনের সৈনিক হিসেবে এটা আমার নৈতিক দায়িত্বও ছিল।

যতদূর মনে পড়ে বলেছিলাম, এখন আপনার যদি নিরস্ত্র না হন, শান্ত না হন, তবে এ সংবাদ পেয়ে আরো পুলিশ আসবে, গোটা সৈন্যও আসবে। তারা এলে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে, নির্বিচারে হত্যা করবে, ধরে নিয়ে যাবে। এ কথা শোনার পর জনগণের ভেতর থেকে একটি বিক্ষুব্ধ কণ্ঠ ভেসে এলো, তাহলে গান্ধী রাজারে খবর দেন, সেও তার সৈন্য পাঠাক। উত্তরে বললাম, গান্ধী রাজার সৈন্য তো আমরাই। অন্য সৈন্য গান্ধী পাবেন কোথায়? তখন ভিড়ের মধ্যে শতকণ্ঠে প্রশ্ন এলো, তাহলে ওই পচা ভেড়ার লেজ ধরেছেন কেন?

এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডের খবর রাতারাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিনই কলকাতা, ঢাকা ও বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির নেতা, কর্মী

বাহিনী, ডাক্তার, ছাত্র, স্বেচ্ছাসেবক সলঙ্গা বাজারের দিকে দলে দলে আসতে থাকে। নায়ক, আনন্দবাজার, অমৃতবাজার প্রভৃতি দৈনিক এই হত্যাকান্ডের উল্লেখ করে সরকারি ও বেসরকারি তদন্তের দাবি উত্থাপন করে। দেশময় সভা-সমিতির মাধ্যমেও তীব্র প্রতিবাদ হতে থাকে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close