জাকির আজাদ

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২০

বিশ্লেষণ

যৌন নিপীড়ন ও কন্যাশিশু

আমাদের বর্তমান সমাজে শিশু-কিশোরীদের প্রতি যৌন নিপীড়ন আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় এবং ঘটনাগুলো ঘটছেও আমাদের নিজেদের অথবা প্রতিবেশী আত্মীয়-পরিজনের পরিবারে। সমাজে সব শ্রেণির শিশুই যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। তবে এই অনুপাতিক হারের সংখ্যায় কন্যাশিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে অধিক মাত্রায়। যেকোনো নিপীড়নকারীর প্রথম শিকার হচ্ছে কন্যাশিশু। আমাদের দেশের মানুষ শিশুদের যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে এত বেশি ওয়াকিবহাল নয়। নারীদের যৌন নিপীড়নের কথা আলোচনায় এলেও শিশু যৌন নিপীড়নের ব্যাপারটি লুকোছাপা থেকেছে বরাবরই।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক শিশু প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। পথে-ঘাটে, অফিস-আদালতে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় এমনকি গৃহকর্মেও। যেসব শিশু যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হয়ে তাদের কোনো শ্রেণি বর্ণ নেই। গৃহপরিচারিকা থেকে শুরু করে দোকানে কর্মরত বালক ও বালিকা কেউই নিপীড়নের হাত থেকে রেহাই পায় না। এটাই আমাদের সমাজের নিত্যদিনের চিত্র। পরবর্তীকালে এসব শিশু আরো কঠিন নির্যাতনের শিকার হয়। নির্যাতিত শিশুরা তার নিয়োগকর্তার পরিবারের সদস্যদের গালাগালি আর মারধরই খায় না বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়। দেখা যায়, নির্যাতনের শিকার এই শিশুদের অভিযোগ কেউ শোনে না। বরং তারা অব্যাহতভাবে নির্যাতনের শিকার হতেই থাকে। এভাবে নির্যাতিত হতে হতে একপর্যায়ে তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কেউ কেউ নিরাপদ ঠিকানা খুঁজে পেলেও বেশির ভাগই পড়ে পাচারকারী আর দালালের চক্রের হাতে। বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতিত শিশুদের কোনো শারীরিক বা মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হয় না। অধিকন্তু তাদের মৌলিক অধিকার পূরণ তো দূরের কথা জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম যে চাহিদা; সেটুকুও পূরণ করা হয় না। ফলে তারা শুধু শারীরিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, বরং মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আবার অনেক সময় শুধু মানসিক নিপীড়নেরও শিকার হতে পারে। যৌন প্রবৃত্তি যৌন পরিতৃপ্তি, ধর্ষকাম বা নির্যাতন স্পৃহা চরিতার্থ করার জন্য শিশুকে আলাপচারিতার মাধ্যমে, স্পর্শের মাধ্যমে বা অন্য কোনো বিকৃত যৌনাচারের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিকভাবে আহত করা অথবা শিশুর বয়স ও পরিবেশের জন্য উপযুক্ত নয় এবং তার স্বাভাবিক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যৌনতা সম্পর্কিত এমন কোনো কথা, আচরণ কাজ ইত্যাদির সংস্পর্শে শিশুকে নিয়ে আসা বা এর সবগুলো শিশু-কিশোর যৌন নির্যাতনের আওতাভুক্ত। কুসংস্কার এবং সমাজের নানা রকম ভয়ভীতির কারণে শিশুরা মুখ না খুললেও আমাদের দেশে শিশুরাও যৌন নিপীড়নের শিকার, তা বলাবাহুল্য।

জরিপে বলা হয়, অভ্যাগত বা বাইরের লোকদের চেয়ে আপনজনের দ্বার শিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয় বেশি এবং নির্যাতনকারীর ৬০ শতাংশ হয় অনাত্মীয় যেমনÑ প্রতিবেশী, শিক্ষক, বন্ধু আর ৩০ শতাংশ হয় আত্মীয়Ñ মামা, চাচা, দাদা এবং ১০ শতাংশ অপরিচিত। বাংলাদেশের গ্রামে-শহরে উভয় জায়গায় শিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয় বেশি। তবে গ্রামের শিশুরা যৌন নিপীড়নে শিকার হয় তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি। তদুপরি গ্রামে সমকামিতাও হয় বেশি। সাধারণত যৌথ পরিবারের শিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয় বেশি। শহরে যৌথ পরিবার নেই বললেই চলে, তবে শহরে আছে অ্যাপাটমেন্ট কালচার। আর এসব অ্যাপাটমেন্ট কালচারেও শিশু যৌন নিপীড়ন হওয়া সুযোগ থাকে।

এই শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক পুনর্বাসনের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ এ দেশে নেই বললেই চলে। পাশাপাশি এ বিষয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদেরও যথেষ্ট অভাব। ১৯৯৭ সাল থেকে ইনসিডিন বাংলাদেশ নামের সংগঠনটি যৌন নির্যাতিত ও শোষিত শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। তারা সমাজ উন্নয়ন কার্যক্রমে শিশু অধিকারের দুটি বিশেষ ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ক্ষেত্র দুটি হলো (ক) শিশুশ্রম (খ) শিশুপাচার ও শিশুদের যৌন নিপীড়ন। এ প্রসঙ্গে ইনসিডিন বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠান ইউএন এসকাপের প্রতিনিধি হিরোকো তানাকা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যৌন নিপীড়িত এবং শোষিত শিশু ও যুবাদের উন্নয়ন বিভাগের বিভিন্ন কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘বাংলাদেশের এই অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক শিশু প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এই শিশুরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাচ্ছে না। তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্বই প্রধান বলে উল্লেখ করেন।’

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, যৌন ব্যবসায় বাধ্য শিশুদের শতকরা ৫৬ ভাগের বয়স ১১ থেকে ১৩ বছর এবং ৩৩ ভাগের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরে মধ্যে। তাছাড়া দেশের শিশুদের সিংহভাগ পাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যৌনদাসী হতে বাধ্য হচ্ছে। এসব কন্যাশিশু সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকেও বঞ্চিত। ইউনিসেফের এক হিসাব মতে, প্রতি বছর কমপক্ষে ১২ লাখ শিশুকে যৌন ব্যবসায় নিয়োজিত করা হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে স্টকহোমে বাণিজ্যিকভাবে শিশুদের প্রতি যৌন নির্যাতন, নিপীড়ন বন্ধের জন্য প্রথম বিশ্ব কংগ্রেস ও জাপানের ইয়োকোমোর দ্বিতীয় কংগ্রেসে বাংলাদেশও অংশ নিয়েছিল। কন্যাশিশুর প্রতি সব ধরনের যৌন নির্যাতন, নিপীড়ন বন্ধে অঙ্গীকারবন্ধ হয়। কিন্তু তার পরও থেমে নেই শিশু যৌন নির্যাতন।

শিশু যৌন নিপীড়নে পৃথক কোনো আইন না থাকলেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ধারা ১০(১) ও (২) , দন্ডবিধি ১৮৮০-এর ধারা ৩৫৪, ৫০৯ এবং ঢাকা মহানগরী পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর ধারা ৭৬-এ সম্পর্কে বলা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো এসব অপরাধ প্রমাণ করা। পরিবারে আপনজন কেউ ১৪ বছরের কিশোরীর বা তার কম বয়সের কোনো শিশুর স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত বুলিয়েছে কি না কিংবা কোনো শিশুকে অশ্লীলভাবে স্পর্শ করেছে কি না, আদালতে তা প্রমাণ করা কঠিন। তবু গত এক বছরে-২০১৮-১৯ইং মোট ১৩৬২টি যৌন নির্যাতনের মধ্যে ৫৭৮টি মামলা হয়েছে। তাতে ২৯৩টি শিশু যৌন হয়রানি। তবে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগে শিশু যৌন হয়রানি সংখ্যা বেশি। মোট শিশু যৌন হয়রানির অধিকাংশ নিম্নবিত্তের কন্যাশিশু, গৃহকর্মীর মেয়ে, দিনমজুরের মেয়ে, গামেন্টকর্মী, আশ্রমের শিশু, এমনকি এতিমখানার শিশুও এই যৌন নিপীড়নের শিকার এবং তারা যৌন নিপীড়িত হয়েছে সাধারণত পরিচিতজনদের দ্বারা।

শিশুপ্রতি যৌন নিপীড়ন এ ব্যাপারে কুমিল্ল মেডিকেল কলেজের বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ডা. এস কে রাউথ বলেন, শিশুপ্রতি যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণ হচ্ছে বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের বিকৃত মানসিকতার পুরুষ নারীকে যৌনপণ্য ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় আইনের মাধ্যমে তাদের শাস্তি প্রদান করা।

শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। শিশুর নিকট এবং অপরিচিত মানুষরূপীরা তাদের বিকৃত যৌন কামনা মেটাতে শিশুদের প্রতি যৌন নির্যাতন করে থাকে। এ ধরনের মানসিকতা রুখতে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন জরুরি। ধর্ষণজনিত বর্বরোচিত অপরাধের যথাযথ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। শিশু ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন বন্ধে অভিভাবক, পরিবার, সমাজ সবাইকে সচেতন হতে হবে। সচেতনতার পাশাপাশি পরিবারে সুশিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ গড়ে তোলা জরুরি। সর্বোপরি শিশুসত্তাকে স্বীকৃতি দিয়ে শিশুদের শিশু হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close