ইয়াসমীন রীমা

  ২৬ জানুয়ারি, ২০২০

পর্যালোচনা

এক অনন্য নারী নওয়াব ফয়জুন্নেসা

কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার অন্তর্গত পশ্চিমগাঁয়ে ১৮৩৪ সালে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে ফয়জুন্নেসার জন্ম হয়। তার বাবার নাম আহাম্মদ আলী চৌধুরী এবং মা আরফানুন্নেসা চৌধুরানি। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তার অবস্থান ছিল তৃতীয়। বাল্যকাল থেকে লেখাপড়ার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। আর এই আগ্রহ দেখে জমিদার বাবা তার জন্য উপযুক্ত গৃহশিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। জীবনে তিনি কোনো দিন স্কুলে গমন করেননি। কারণ সে সময় সমাজের রক্ষণশীলতা ভঙ্গ করতে চাননি। অত্যন্ত জ্ঞানস্পৃহায় তিনি বাংলা, আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত এই চারটি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা শুধু একটি নাম নয়, একটি জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠানও। ঊনবিংশ শতাব্দীর মানুষকে আলোকিত করার জন্য শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জনহিতকর কর্মযজ্ঞ আমৃত্যু অব্যাহত রেখেছিলেন। সামাজিক সংকট, অসত্য, নির্মমতা তাকে নিদারুণ কষ্ট-যন্ত্রণা দিয়েছে ঠিক, তবে পরক্ষণে তিনি প্রতিরোধে উজ্জীবিত হয়েছেন এবং তার কাজের মধ্য দিয়ে প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা কাজে লাগিয়ে প্রজা ও সাধারণ মানুষকে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।

নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানিই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেছিলেন, পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও শিক্ষা যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। আর এই প্রয়োজনীয়তায় তিনি নারীশিক্ষার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়ে পড়েন। তার চিন্তাধারায় অগ্রগণ্য হয়ে উঠে যুগোপযোগী আধুনিক শিক্ষা ব্যতিরেকে সব নারীর উন্নয়ন সম্ভব নয়। লক্ষণীয়, যে যুগে মুসলিম ছেলেরাই ইংরেজি স্কুলে লেখাপড়া করতেন না, অথচ মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষার জন্য তিনি ১৮৭৩ সালে কুমিল্লা জেলা শহরের উপকণ্ঠে বাদুরতলায় ফয়জুন্নেসা ইংরেজি উচ্চবালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে অসীম সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বর্তমানে ফয়জুন্নেসা সরকারি পাইলট উচ্চবালিকা বিদ্যালয় হিসেবে যুগের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে চলমান।

উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে ঐতিহাসিকরা বেগম রোকেয়াকে সবিশেষ স্থান প্রদান করলেও বেগম রোকেয়ার জন্মের ৪৫ বছর আগে নওয়াব ফয়জুন্নেসার জন্ম হয় এবং নারী জাগরণের উন্মেষ তার দ্বারাই প্রথম ঘটেছিল। নিভৃত পল্লীর অঞ্চলে বসবাস করে সমাজের অহমিকা ও দাম্ভিকতার বিপরীতে থেকে সম্পূর্ণ নিজস্ব মেধা মননকে জাগ্রত করে সেই সময়কার সামাজিক প্রতিকূল অবস্থাকে উপেক্ষা করে নারীদের জ্ঞানকে আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টা করে গেছেন।

ইতিহাসে অমোচনীয় কালিতে লেখা হয়ে গেছে, ভারতবর্ষের নর-নারী জাগরণের অগ্রদূত হচ্ছেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানি। উল্লেখ্য, ফয়জুন্নেসা ইংরেজি উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার দুই বছর অতিবাহিতের পর ১৮৭৫ সালে ভারতের মুসলিম জাগরণের অন্যতম অগ্রনায়ক স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলিম তরুণদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য আলীগড়ে শামীউল্লাহ হাইস্কুলে অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ গড়ে তুলেছিলেন, যা পরে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নামে সুপরিচিতি লাভ করে। তা ছাড়া নওয়াব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী মতো মহান পুরুষরা শিক্ষার কথা ঢালাওভাবে বললেও অন্দরমহলের নেপথ্যচারিণী নারীদের কথা তাদের শিক্ষার কথা বলেনি। তবে সৈয়দ আমীর আলী তৎকালীন অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বক্তৃতা-বিবৃতিতে ছেলেদের শিক্ষার মতো সমভাবে নারীশিক্ষার কথা উল্লেখ করলেও বাস্তবিক কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। সেই শূন্যস্থানে একমাত্র নওয়াব ফয়জুন্নেসা দেশে তথা উপমহাদেশে সর্বপ্রথম পুরুষের পাশাপাশি নারী শিক্ষার তাগিদ অনুভব করেন এবং যথেচ্ছা চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৮৮৯ সালে ইংরেজ শাসনামলেই মহারানি ভিক্টোরিয়া কর্তৃক ভারতবাসীদের জন্য কর্ম-কৃতিত্বে জন্য খেতাব প্রদানের তালিকায় প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে স্থান পেয়েছিলেন বাংলাদেশের অখ্যাত পল্লী অঞ্চলের এক মুসলিম নারী জমিদারের নাম। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানি।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা ছিলেন জনকল্যাণের নিবেদিত প্রাণ। তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস একটি জনহিতকর কর্মে নিয়জিত হয়ে বিশেষভাবে অর্থ সংকটে পতিত হন। সরকারি কোষাগারের অর্থ পেতে বিলম্ব হবে বিধায় তিনি স্থানীয় ধনাঢ্য ও জমিদার ব্যক্তিদের কাছ থেকে সাময়িকভাবে অর্থঋণের প্রস্তাব করলে কেউ তার এই প্রস্তাবে সায় দিলেন না। কিন্তু নওয়াব ফয়জুন্নেসা প্রকল্পটি জনহিতকর জেনে প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করেন এবং ঘোষণা দেন ঋণ নয় দান হিসেবে প্রদান করেছেন। ডিগলাস নওয়াব ফয়জুন্নেসার এরূপ দানে বিস্ময় প্রকাশ করে মহারানি ভিক্টোরিয়াকে অব্যহিত করেন। রানী ফয়জুন্নেসা প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ‘বেগম’ উপাধি দেওয়ার ঘোষণা করেন। রানির ঘোষিত এই উপাধি তিনি বিনয়াবনতভাবে প্রত্যাখ্যান করে জানান, জমিদার কন্যা ও জমিদারপতœী হিসেবে এমনিতে তিনি বেগম নামে সুপরিচিত। নতুন করে আবার পরিচিতির প্রয়োজন নেই। মহারানি ভিক্টোরিয়া জমিদার নন্দিনীর এমন সিদ্ধান্ত আশাহত না হয়ে এই গুরুত্ব উপলব্ধি করে অবশেষে ‘নওয়াব’ উপাধি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮৮৯ সালে মহারানির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুমিল্লার নওয়াব বাড়িতে তৎকালীন ৩৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ফয়জুন্নেসাকে ‘নওয়াব’ উপাধি প্রদান করা হয়। শুভেচ্ছার প্রতীক হিসেবে তাকে মনোহর তারকাকৃতি হীরক খচিত একটি পদকও উপহার প্রদান করা হয় যা তিনি স্ব-হস্তে গ্রহণ করেন। নওয়াব ফয়জুন্নেসার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অংশে থাকলেও সেই সময়ের ঐহিহাসিকরা বেগম রোকেয়াকে নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করে গেছেন। তবে নওয়াব ফয়জুন্নেসা বেগম রোকেয়ার জন্মের ৪৫ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের মহারানি কর্তৃক নওয়াব উপাধিতে ভূষিত হয়েও যুগের পর যুগ উপক্ষিত হয়ে গেলেন ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিবিচারে। নারীশিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে কেউ তাকে স্মরণ করেন না বর্তমান নারীসমাজের প্রভূত কোনো কল্যাণ সাধনের মুহূর্তে। এমনকি স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে অনেক বরেণ্য ব্যক্তিদের জীবনী পাঠ হিসেবে থাকলেও এই মহান জনকল্যাণী ও নারী শিক্ষার উন্মেষকারিনী নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানি অনুপস্থিত।

১৮৮৫ সালে নওয়াব ফয়জুন্নেসার মাতা বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারনে উপযুক্ত বড় দুই ভ্রাতা থাকা সত্ত্বেও তার বুদ্ধিমত্তা ও কর্মদক্ষতার জন্য বিশাল জমিদারি দেখাশোনা তদারকির দায়িত্বে পড়ে ফয়জুন্নেসার ওপর। তিনি জমিদারির মতো গুরুদায়িত্ব অমরণ সিংহচিহ্ন অঙ্কিত জমিদারি চেয়ার পরিত্যাগ করে সামান্য বেতের নির্মিত মোড়ায় উপবিষ্ট হয়ে একজন প্রজাদরদি সুযোগ্য শাসকরূপে ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন। নওয়াব ফয়জুন্নেসা ছিলেন একাধারে শাসক, শিক্ষানুরাগী ও সুসাহিত্যিক। শাসকরূপে তিনি নিজেই ঘোড়া সওয়ার হয়ে বিভিন্ন মৌজায় প্রজাদের সুখ-দুঃখের খবরাখবর নিতেন। প্রজাদের অভাব অভিযোগ লাঘব করার চেষ্টা করতেন। প্রজাদের সুবিধার্থে নির্মাণ করেছেন বিভিন্ন মৌজায় খাল, পুকুর, রাস্তা-ঘাট, স্কুল, পুর মুসাফিরখানা, দাতব্য চিকিৎসালয়, মাদরাসা-মক্তব। তা ছাড়া তার জমিদারির আয়ত্তাধীন ১২টি মৌজায় সম্পূর্ণ নিজস্ব খরচে প্রতিষ্ঠা করছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়। তার দানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লাকসাম দাতব্য চিকিৎসালয়, যা এখনো সগৌরবে মানুষের কাজে আসছে। ১৮৯৩ সালে কুমিল্লা শহরে প্রতিষ্ঠিত ফয়জুন্নেসা জানানা হাসপাতাল পরে ফিমেল ওয়ার্ড হিসেবে জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। মক্কায় হজব্রত পালন করতে গিয়ে সুপেয় পানির অভাব মেটাতে সেখানে বহু অর্থ ব্যয় করে ‘নাহরে জুবাইদা’ পুনঃখনন করেন। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে স্কুল স্থাপন এবং মক্কা শরিফে মাদরাসা-ই-সাওলাতিয়া ও ফুরকানিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে মাসিক ৩০০ টাকা হারে সাহায্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ফয়জুন্নেসার উত্তরাধিকারীরা এই অর্থ পাঠাতেন নিয়মিত। ধর্মীয় শিক্ষার জন্য নিজস্ব বাড়ি পশ্চিমগাঁয়ে ফয়েজিয়া মাদরাসা নির্মাণ করেছিলেন, কালক্রমে ধাপে ধাপে পরিবর্তিত হয়ে নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজে রূপান্তর লাভ করে। নওয়াব ফয়জুন্নেসা সাহিত্যকীর্তি হলো রূপজালাল কাব্যগ্রন্থ। ১৮৭৬ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় রূপক কাহিনি আশ্রয়ে।

উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে দেশোন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনসুবিধাজনক কর্মকান্ডে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানির অবদান এবং ভূমিকা যুগের তুলনায় সত্যি ছিল অনেক প্রাগ্যসর এবং অগ্রগামী। তার এই অবদান যে দেশের সীমান্ত পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও ছড়িয়েছিল এ কথা আমাদের অনেকেরই আজও অজানা। এসব মূল্যবান তথ্যসংবলিত একটি গ্রন্থ আমাদের সুধীসমাজের জন্য, বিশেষ করে আগামী প্রজন্মের জন্য বাস্তবিক অত্যন্ত জরুরি। নওয়াব ফয়জুন্নেসা কর্মবহুল জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর এক বছরব্যাপী অনেক তথ্য, মতামত, আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা করার সাপেক্ষে এক গবেষণাধর্মী গ্রন্থ গ্রন্থিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করছি। যেখানে এ মুহূর্তে দাবি উঠছে স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে নওয়াব ফয়জুন্নেসা কর্মজীবনের ওপর একটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করার, সেখানে প্রসঙ্গত মনে করছি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের মতো জাতীয় পর্যায়ে এই মহীয়সী নারীর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে অনেক কিছু করার রয়েছে। তার জীবনের সব কর্মকান্ড পর্যালোচনার সংক্ষিপ্ত পরিসরে এ সত্যেই উপনীত হওয়া যায়, কাজের মধ্য সংহতি সৃষ্টি করে, বেশ কিছু সার্থক সংকেত রেখে গেছেন, যার ভেতর দিয়ে তিনি নিজের জীবনকে অতিক্রম করে বৃহৎ এক সত্যের ওপর আলো ফেলে গেছেন, যা অমরত্বেরই আলো। এখানেই তিনি অনবদ্য, সার্থক।

এত কিছুর পরও জাতির কাছে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি এ দেশের নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ নওয়াব ফয়জুন্নেসাকে। ২০০৪ সালে অনেকটা দায়সারাভাবে ফয়জুন্নেসাকে যৌথভাবে দেওয়া হয় একুশে পদক। তা ছাড়া বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তি আন্দোলনের কার্যক্ষেত্র ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। আর ফয়জুন্নেসা নারীশিক্ষা প্রসারের কার্যক্ষেত্র ছিল বর্তমান বাংলাদেশে। এই ব্যাপারে অভিজ্ঞ মহল মনে করে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নওয়াব ফয়জুন্নেসা ছিলেন একমাত্র নারী নওয়াব। নারীশিক্ষা ব্যাপ্তিতে তার অসাধারণ ভূমিকা অনস্বীকার্য। সময় অতিবাহিত হয়ে যায়নি, তাই তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা হোক। সৃষ্টি করা যেতে পারে নওয়াব ফয়জুন্নেসা পদক।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট-গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close