শফিকুল ইসলাম খোকন

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

বদলে দিচ্ছে দেশ বদলে যাচ্ছে উপকূল

আমরা কথায় বলে থাকি বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এটি আমরা বিশ্বাস করি। আর সেজন্যই কৃষি উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন। সরকারি-বেসরকারিভাবে কৃষিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ক্রমান¦য়ে কৃষি বদলে দিচ্ছে দেশ, বদলে যাচ্ছে উপকূল। কৃষিক্ষেত্রে বেশির ভাগই ভূমিকা রাখছে উপকূল। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষও কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এ অঞ্চলেই বেশি লবণাক্ততা থাকার কারণে কৃষিও হুমকির মুখে পড়ে।

উপকূলীয় জনজীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। নানা বিপত্তি এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের সঙ্গী। যার মধ্যে রয়েছে লবণাক্ততা। লবণাক্ততা কখনো উপকূলীয় বাসিন্দাদের কাছে পৌষ মাস আবার কখনো সর্বনাশ হয়ে থাকে। সমুদ্র উপকূলে কৃষিকাজেও রয়েছে নানাবিধ বাধা, যার মধ্যে লবণাক্ততা অন্যতম। শুকনো মৌসুমে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততা দেখা দেয়। এ সময়ে সেচের জন্য প্রয়োজনীয় মিষ্টি পানিও থাকে না, নদী এবং যেসব খালে পানি থাকে, তাও প্রায় লবণাক্ত হয়ে যায়। পুকুর ও বিল শুকিয়ে যায় দ্রুত, যেগুলোতে বৃষ্টির পানি জমে থাকত। এমনকি নলকূপের পানির স্তরও অনেক নিচে নেমে যায়, ফলে মিষ্টিপানি খুব দুষ্কর হয়ে যায়। আর এর ফলে কৃষিকাজ তথা সবজি চাষ হয়ে যায় প্রায় অসম্ভব, ফলে বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি থাকে পুরো শুকনো মৌসুমজুড়ে। কৃষিতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষক বা কৃষি অনেক অবদান রাখছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মোট ১৪ জেলা উপকূলের আওতায়। মোট কৃষিজমির ৩০ শতাংশ জমি রয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলে; যার প্রায় ৫৩ শতাংশ লবণাক্ততায় আক্রান্ত এবং লবণাক্ততা প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। এ কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক তাদের জমি অনাবাদি রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে জাতীয় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন ও আয় কমে যাওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে ভুগছে প্রতিটি কৃষক পরিবার। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের এ সমস্যা সমাধানে সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো কো-অপারেশন দ্য সল্ট সলিউশন নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের লবণসহিষ্ণু ফসলের সঙ্গে পরিচয় ঘটানো, প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধি করা এবং গুণগত মানসম্পন্ন ফসল উৎপাদনে কারিগরি সহায়তা প্রদান করা, যার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির মান উন্নত হবে।

আমরা জানি, বিশ্বে খাদ্যশস্যের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগোচ্ছে বাংলাদেশ। খাদ্যশস্যে প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৩৪ টন উৎপাদন করে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় ওঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম, যা নিঃসন্দেহে বিশাল অর্জন। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। জীবন-জীবিকার পাশাপাশি আমাদের সার্বিক উন্নয়নে কৃষি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাই কৃষির উন্নয়ন মানে দেশের সার্বিক উন্নয়ন। টেকসই কৃষি উন্নয়নে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষিক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপ এবং দিকনির্দেশনায় খোরপোষের কৃষিআজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদন, টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর্মসংসস্থান ও রফতানি বাণিজ্যে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে।

দেশের মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বর্তমান সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে কৃষির উন্নয়ন ও কৃষকের কল্যাণকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিয়ে নানামুখী প্রদক্ষেপ নিয়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান দশম। দারিদ্র্য, ঘনবসতি, নগরজীবনের নানা অনিশ্চয়তা আর জলবায়ুর পরিবর্তনের ভেতর বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও টিকে থাকার মূল জায়গাটি হচ্ছে ভূমি ও কৃষক সম্প্রদায়।

বিষয়টি মাথায় রেখে, লবণসহিষ্ণু জাত নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনাÑ এই চারটি জেলার ৮টি উপজেলার ৫ হাজার চাষি পরিবার নিয়ে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের দোরগোড়ায় গিয়ে বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোডেক এবং কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সল্ট ফার্ম টেক্সেল। প্রকল্পটি তিন বছর ধরে এ অঞ্চলে শুকনো অর্থাৎ শীত মৌসুমে লবণাক্ত জমিতে গাজর, রেডবিট (বিটকপি), আলু, ফুলকপি, ওলকপি এবং বাঁধাকপি উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তিসমূহের প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করছে।

১৪ জেলার মধ্যে মোট ৮টি উপজেলার প্রায় ১০০ একর অনাবাদি জমিতে এসব সবজি ফসলের লবণসহিষ্ণু জাতসমূহের আবাদ করা হয়েছে, যা স্থানীয় কৃষকের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। প্রকল্পের আওতায় মোট ৩০ জন প্রশিক্ষিত নার্সারার (সবজি বীজ উৎপাদনকারী) এর মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন সবজি চারা উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যাতে অন্যান্য কৃষক এসব উন্নত মানের সবজি ফসলের চারা সহজেই পেতে পারেন। এ ছাড়াও দেশের স্বনামধন্য বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লালতীর সিড কোম্পানির মাধ্যমেও এসব বিদেশি জাতসমূহের সহজ প্রাপ্যতার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের সহায়তায় বাগেরহাটের রামপালে তৈরি করা হয়েছে গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র; যেখান থেকে খুব সহজেই যেকোনো জাতের লবণসহিষ্ণুতার মাত্রা নিরূপণ করা যাবে।

এসব প্রদর্শনী প্লটে পর্যাপ্ত জৈব সার প্রয়োগ করে বেড নালা পদ্ধতিতে জমি তৈরি করা হয়। এতে নেদারল্যান্ডস থেকে আনা লবণসহিষ্ণু জাতের বীজ রোপণ করা হয়, সঙ্গে থাকে প্রয়োজনীয় পরিমাণে মালচিংয়ের প্রয়োগ। প্রকল্পের কর্মীরা নিয়মিত জমির লবণের মাত্রা, পিএইচ এবং ময়েশ্চার কন্টেন্ট পরীক্ষা করেন এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে লবণাক্ততার ক্ষতিকর প্রভাব কমানো সম্ভব হয়। প্রকল্প থকে বিতরণকৃত লবণসহিষ্ণু জাতের বীজ, উপযুক্ত মাটি ব্যবস্থাপনা, উপযুক্ত সেচ এবং সার প্রয়োগ লবণ সমস্যা সমাধানে অত্র অঞ্চলের কৃষকের সফলতা এনে দিয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে জানা যায়, বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কর্তৃক গৃহীত কৃষি প্রণোদনা/পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ২০০৮-০৯ অর্থবছর হতে এ পর্যন্ত ৯৬০ কোটি ৩৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ৮৬ লাখ ৪০ হাজার ৪৪ জন কৃষক উপকৃত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩৩ কোটি ১৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা কৃষি উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। ফসলের উন্নত ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে অভূতপূর্ণ সাফল্য এসেছে। ২০১৮-১৯ সালে অবমুক্তকৃত উদ্ভাবিত জাত ১২টি, উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ৯৫টি এবং নিবন্ধিত জাত ২৬টি। গম ও ভুট্টার গবেষণা সম্প্রসারণের জন্য সরকার ২০১৮ সালে গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

আমরা জানি, বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। উপকূল নিয়ে কেউই তেমন একটা ভাবছেন না। অথচ উপকূলীয় অঞ্চল কৃষিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। কিন্তু সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে কৃষি থেকে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে ফসল না হওয়ায়। তবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় উন্নত জাত ও লবণসহিষ্ণু জাত এবং কারিগরি পরামর্শে আবারও কৃষির দিকে ঝুঁকছেন চাষিরা। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলে আমি আশা করছি। যেহেতু উপকূলীয় অঞ্চল কৃষিতে ব্যাপক অবদান রাখছে, সে কারণে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায় উপকূলকে গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে উপকূলকে বেশি গুরুত্ব দিলে এবং এধারা অব্যাহত থাকলে যেমন অনাবাদি জমি আবাদি হবে, লবণসহিষ্ণু জাতের কারণে লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদ হবে, তেমনি কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হবে, লাভবান হবে দেশ এবং দেশ শস্য সংকটে পড়বে না।

এদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজন চলছে সারা দেশে। কৃষিকে লাভজনক খাতে রূপান্তরের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে স্থায়ী ভিত্তি দিতে হলে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হোক না একটি আন্দোলন? বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে হোক না কৃষি উন্নয়নের আন্দোলন। আর এটাই হোক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে একটি চমৎকার উপহার।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close