হিমেল আহমেদ

  ২২ জানুয়ারি, ২০২০

ভ্রমণ

তীর্থস্থান হতে পারে বাংলাদেশ

শীতকাল মানেই ভ্রমণ, বনভোজন আর রকমারি পিঠা খাওয়ার উৎসব। বাংলাদেশের মানুষ খুব শৌখিন। গ্রামগঞ্জে কিংবা শহরে প্রায় সবাই শীত উপলক্ষে পিঠা খেতে পছন্দ করেন। তেমনি শীত এলেই স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বনভোজনের আয়োজন করা হয়। বিত্তবানদের মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতা বেশি। বিশেষ করে ডাক্তাররা। এ ছাড়াও বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ যারা ভ্রমণের ক্ষেত্রে দেশের বাহিরেই যান। তারা জানেন না, ছোট্ট এই বাংলাদেশে কত সুন্দর আর কত মনোমুগ্ধকর জায়গা আমাদের আছে, তা নিজে ঘুরে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। তাই আমাদের সবার উচিত, প্রথমত নিজের মাতৃভূমি ভ্রমণ করা। প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন হোক অথবা সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর। বান্দরবানের আফিয়াখুম, নাফাখুম অথবা মেঘের রাজ্য সাজেক! এগুলা বাদেও আরো অগণিত ভ্রমণের মতো প্লেস আমাদের দেশেই আছে। বাংলাদেশে ভ্রমণের শীর্ষে আছে চট্টগ্রাম। কারণ এখানেই আছে আমাদের একমাত্র সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার; যা বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র কিনারা। সমুদ্র প্রাকৃতিক এক অনন্য নিদর্শন। কক্সবাজার থেকেই চলে যেতে পারেন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। ভারতের কেরালা কিংবা ইন্দোনেশিয়ার বালির চেয়েও কম সুন্দর নয় আমাদের সেন্টমার্টিন। নীল স্বচ্ছ পানি ও পাথরের সমাহারে যে কেউ বিমুগ্ধ হতে বাধ্য। কক্সবাজার সমুদ্র ছাড়াও চট্টগ্রাম জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, ফয়’স লেক, ভাটিয়ারি লেক, চন্দ্রনাথ পাহাড়, বাঁশখালী ইকোপার্ক, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, বাঁশখালী চা বাগান, মহামায়া লেক, খৈইয়াছড়া ঝরনা, সুপ্তধারা ও সহস্রধারা ঝরনা, বাটালি হিল, বাঁশবাড়িয়া সমুদ্রসৈকত, গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত, পারকি সমুদ্রসৈকত, সন্দ্বীপ ইত্যাদি। চট্টগ্রামের পর সিলেটের স্থান! ভ্রমণের দিক দিয়ে সারা বছরই সিলেট ভ্রমণ করেন অনেক ট্যুরিস্ট। সিলেটে অগণিত মনোমুগ্ধকর জায়গা রয়েছে, যেগুলো না দেখলে হয়তো আপনার জীবনটাই বৃথা! বিছনাকান্দি, জাফলং, রাতারগুল, লালাখাল, লোভাছড়া, হাম হাম, মাধবকুন্ড, উৎমা ছড়া, তরিং ছড়া, লক্ষণছড়া, ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর, পান্থুমাই, ব্রিটিশ শাসনামলের কিং ব্রিজ, কুলুমছড়া, শ্রীমঙ্গলসহ বিভিন্ন চা বাগান, সুনামগঞ্জের শিমুলবাগান, জাদুকাটা নদী, ডিবির হাওর, হজরত শাহ জালালের মাজারসহ পাহাড় ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চা বাগান দেখে যে কেউ সিলেট জেলার প্রেমে পড়তে যাবেন! তাইতো সিলেটকে বাংলার লন্ডন বলা হয়। ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে যারা পাহাড়, নদী, ঝরনা ভালোবাসেন, তারা যেতে পারেন খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি কিংবা বান্দরবান। রাঙামাটির পাহাড় ও ঝরনা দেখে সেখান থেকে ফিরে আসার ইচ্ছাটাই হারিয়ে যাবে! আয়তনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জেলা রাঙামাটি। এ এলাকার প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্র্য আর অসংখ্য মানবগোষ্ঠীর বসবাসের কারণে রাঙামাটিকে রূপের রানি বলা হয়। এখানে ঘুরে বেড়ানো আর দেখার মতো রয়েছে অসংখ্য জায়গা! তাদের মধ্যে অন্যতম হলো সাজেক ভ্যালি। পাহাড়ের ওপর ঘরবাড়ি ও মেঘের সঙ্গে খেলা করার এক অনন্য অনুভূতি পাবেন সাজেকে। দিন দিন পর্যটকদের তীর্থস্থানে পরিণিত হচ্ছে এই সাজেক ভ্যালি। আর যদি রাঙামাটি কেউ যান, তাহলে ঝুলন্ত ব্রিজ না দেখে কেউ ফেরেন না! এই ঝুলন্ত ব্রিজ এ জেলার একটি পরিচয় বহন করে আসছে! রাঙামাটিতে রয়েছে অসংখ্য বড় বড় ঝরনা! ঘাগরা ঝরনা, গাছকাটা ঝরনা, কমলক ঝরনা, দুপপানি ঝরনা, শুভলং ঝরনা, হাজাঝড়া ঝরনা ইত্যাদি। বান্দরবান বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প থেকে পিছিয়ে আছে শুধু যোগাযোগব্যবস্থার কারণে। পাহাড় ও ঝরনার দিক দিয়ে সেরা এই বান্দরবান। ছোটবেলায় ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখতাম সুন্দর সুন্দর সব ঝরনা আর পাহাড়! এগুলো যে বাংলাদেশের মধ্যে বিশ্বাস হতো না! বান্দরবানের আফিয়াখুম ও নাফাখুম জলপ্রপাত ভ্রমণ করে অনেকের বিদেশ ভ্রমণের ইচ্ছাটা মিটে যেতে পারে! এ ছাড়া বান্দরবানজুড়ে ২০-২৫টি ঝরনা আছে; যা দেখলে প্রাণ জুড়ে যাবে! নীলগিরি ও নীলাচলের মেঘের রাজ্য ও সবুজের সমাহারের গল্প নিজে না গিয়ে দেখলে বিশ্বাস হবে না আমাদের দেশটা আসলে কত সুন্দর! যারা দুর্গম পথ পাড়ি দিতে রাজি নন; তারা সোজা বাস কিংবা লঞ্চে চলে যেতে পারেন সাগরকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্রসৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। তার পাশেই রয়েছে ফাতরার বন, লাল কাঁকড়ার দ্বীপ। আছে সূর্যমুখী ফুলের রাজত্ব! পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানোগ্রভ বন কিন্তু আমাদের দখলে। তাই সুন্দরবন ভ্রমণ করতেই পারেন যে কেউ! প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণীর এক অনন্য মিলনমেলা দেখতে পারবেন এখানে। দেশের একমাত্র চীনামাটির পাহাড় দেখতে চাইলে নেত্রকোনার বিরিশিরিতে আসুন। সোমেশ্বরী নদীর স্বচ্ছ পানি ও পাহাড় আপনাকে স্নিগ্ধ করবে। কম বাজেটের ভ্রমণ চাইলে ময়মনসিংহের গজনি অবকাশ কেন্দ্র ও গারো পাহার উত্তম। ইতিহাসের পাতায় ফিরে যেতে চাইলে বগুড়ার ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, কুমিল্লার ময়নামতি, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, ঢাকার লালবাগ কেল্লা ঘুরে দেখতে পারেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে ৫১৯টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি প্রতœরতœ আছে। সময় নিয়ে এক এক করে সব দেখে ফেলুন! এতে জ্ঞান অর্জনসহ ভ্রমণও হয়ে যাবে। পুরো পরিবার নিয়ে ট্যুর করতে চাইলে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগর দেখতে ভুলবেন না! বাংলাদেশের স্বাধীনতার চিত্র ভাস্কর্যের মাধ্যমে অপরূপ সুন্দরভাবে সাজানো আছে এখানে। এখন শীতকাল। অনেকেই ভ্রমণের জন্য ভারতের দার্জিলিং যাচ্ছেন, সিকিম যাচ্ছেন, কিন্তু আমাদের অনেকের অজানা যে, বাংলাদেশ থেকেই দেখতেই পারবেন হিমালয় পর্বত! পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া ও বাংলাবান্ধা থেকে এই শীতের মৌসুমে হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। তেঁতুলিয়ার হিম শীতল আবহাওয়া, চা বাগান ও কাঞ্চনজঙ্ঘা আপনার মনে প্রশান্তি এনে দেবে। সঙ্গে আছে হিমালয়ের বরফগলা নদী মহানন্দা, কমলার বাগান ও কাজী স্টেটের বিরাট স্বর্গীয় বাগান ও ফার্ম! প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও আমাদের দেশে অনেক ঐতিহাসিক প্রতœ নিদর্শন ও নতুন স্থান রয়েছে। তাই আসুন আগে নিজের দেশকে জানি। দেশের পর্যটনশিল্পকে মজবুত করি। সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করব দেশের পর্যটনশিল্পকে আরো উন্নত করুন। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতকরণ ও পর্যটনকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমেই পর্যটনশিল্পকে সুউচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং তার সঙ্গে আমরা নিজেরাও সচেতন হই। এই দেশ আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি। বাংলাদেশের সব পর্যটন স্পটের পরিচর্যা ও সুন্দর রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।

লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close