ডা. এস এ মালেক

  ২১ জানুয়ারি, ২০২০

মতামত

দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সফলতা

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বে এমন কোনো দেশ নেই, যে দেশের নেতারা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ স্বাধীন করার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন। অনেক দেশ আছে যে দেশে বাংলাদেশ পরিচিত না হলেও বঙ্গবন্ধু পরিচিত। বঙ্গবন্ধু শুধু একটা দেশ স্বাধীন করেননি, একটা জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা ও আকাক্সক্ষাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। হাজার বছরের পরাধীন বাংলাকে সর্বাত্মক অর্থে স্বাধীন করে বাঙালিকে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করে গেছেন। জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাতিসত্তায় রূপান্তরিত করে জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। এ ধরনের দায়িত্ব আর ভবিষ্যৎ কারো পক্ষে পালন করার প্রয়োজন পড়বে না। তাই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি মূলত শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যেই দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। যেখানে বাঙালি শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে দ্রুত এগিয়ে যাবে। অভাব থাকবে না, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে। দারিদ্র্য বলে কিছু থাকবে না। অভাব-অনটনে মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাবে না। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর শোষণের অবসান ঘটবে। মানুষ মর্যাদার সঙ্গে মানবাধিকার বলতে যা বোঝায় তা ভোগ করবে। একেই তিনি শোষিতের গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজ বলে দাবি করেছিলেন।

যে ধ্বংসযজ্ঞের পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন, তা পালন করা সহজ ছিল না। দেড় কোটি শরণার্থী আরো প্রায় এক কোটি অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষকে খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করার কাজটি ছিল খুবই কঠিন। প্রতিটি পরিবারকে কম করে হলেও একটা টিনের শেড, প্রতি মাসে আধা মণ থেকে দেড় মণ পর্যন্ত খাদ্য সরবরাহ, চাষাবাদের নানা উপকরণ, ক্যাশ টাকা, সিআই সিড, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্য সরবরাহ করতে হয়েছে। বাচ্চাদের খাবার সংগ্রহ করা ছিল কঠিন কাজ। স্বাস্থ্যসেবা ছিল অত্যন্ত সীমিত। কৃষিকাজ করে খাদ্য উৎপাদন করার কোনো অনুকূল পরিবেশ ছিল না। না ছিল শস্যবীজ, গরু, লাঙল, সার, পানি সেচের ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ কোনো কিছুই ছিল না। খেতের ফসলকে ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। স্কুল, কলেজ সব ধ্বংস করে দিয়েছে। গ্রামের বাজারগুলো পর্যন্ত পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। গুদামে জমাকৃত পাটও পুড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ সহায়-সম্বল বলতে কৃষকের কিছুই ছিল না। এ শূন্য অবস্থা থেকে বঙ্গবন্ধুর যাত্রা। আমদানি-রফতানি, এলসি খোলার মতো টাকা নেই ব্যাংকে। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। দেশে তখন মহাসংকটাপন্ন অবস্থা। আর এ অবস্থায় বাংলাদেশের একমাত্র পুঁজি মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। যার আবেদনে সারা দিয়ে বিশ্বের অসংখ্য রাষ্ট্র বাংলাদেশের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসে।

ব্রিজ, কালভার্ট সবকিছুই পাকিস্তানি হানাদাররা ধ্বংস করে দিয়েছে। মাত্র ৩ বছরের ভেতর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সামগ্রিক চেহারা পরিবর্তন করে দিলেন। শুধু কর্মযজ্ঞে যে যেখানে আছেন কাজ করেছেন। একখন্ড জমিও পরিত্যক্ত নেই। অফিসের পাশে খোলা জায়গাতেও খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে। বর্তমানে পার্লামেন্ট ভবনের জমিতে ১২০০ মণ ইরি ধান উৎপন্ন হয়েছে। গ্রামেও একই অবস্থা, কোনো জায়গা খালি ছিল না। আজকে ঢাকা শহরে যত বড় বড় গাছ দেখা যায় সবই সেই সময়ের লাগানো। অল্প দিনের মধ্যেই বাংলার দেশপ্রেমিক দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুললেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ ও সবার জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলো। শিল্প-কারখানার শ্রমিকের মালিকানা নিশ্চিত করা হলো। আইনশৃঙ্খলা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে এনে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা হলো। দেশে তখন সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান, সবাই নিজ নিজ অধিকার ভোগ করছেন। কিন্তু সেই অধিকার ভোগের মাত্রাটা স্বাধীনতাবিরোধীরা এমন পর্যায়ে পৌঁছে দিলেন, যা দেশ ও জাতির সম্পূর্ণ পরিপন্থি হয়ে দাঁড়াল। পাঁচজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হলো। এরূপ বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়নি। তাই তিনি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন এবং স্বাধীনতার শত্রুরা আন্তর্জাতিক মুরব্বির সহযোগিতায় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে স্বগৃহে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। তারপর ২১ বছর দেশ চলল উল্টোপথে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে পরপর দুজন সামরিক শাসক প্রায় ১৫ বছর দেশ শাসন করলেন। তাদের রাজত্বকালে মনে হলো মুক্তিযুদ্ধ একটা অতীতের ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধসমূহ একে একে ধ্বংস করা হলো। বাংলাদেশ তখন প্রায় দুই নম্বর পাকিস্তানে রূপান্তর হয়েছে।

আর সামরিক শাসকরা দাবি করেছেন, তারা নাকি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দেশকে স্ফীত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন। ভোটের অধিকার নেই, নির্বাচন নেই, বিরোধী দল নেই অথচ তথাকথিত সংসদ, সরকার সবকিছুই আছে। সে এক মহাতামাশা। ঠিক এ রূপ একটা মহারাজনৈতিক দুর্যোগকালে বাংলাদেশে আবির্ভাব ঘটল বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার। যদিও দলীয় প্রধান হিসেবে পিতার অবস্থানে ফিরে আসা তার পক্ষে খুব সহজ ছিল না। কিন্তু বাংলার জনগণের দাবির মুখে সব ষড়যন্ত্র বিফল হয়েছে। এসেই বললেন ভোটের অধিকার দিতে হবে, যার ভোট সে দেবে, স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে হবে, চলল সংগ্রাম। ২১ বছর পর জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিলেন। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে কৌশলগত কারণে কিছু আদর্শবিরোধী শক্তি সঙ্গে নিয়ে তিনি স্বৈরশাসকের অবসান ঘটিয়ে ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে আনলেন। ৯৬ থেকে যাত্রা, মাঝে সাত বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে ২০০৮ সালে আবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি তার পিতার ইস্পিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে জীবনপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। সততার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করে তিনি প্রমাণ করলেন যে, যোগ্য শাসকের অপেক্ষায় আগের পাঁচ বছর ও বর্তমানের একটানা ১২ বছরের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে এমন অবস্থা সৃষ্টি করলেন; যা তলাবিহীন ঝুড়ির বদনাম ঘুচিয়ে, বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। আজ আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছেছি। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে রূপান্তরিত হবে। গ্রামবাংলায় আজ আর ফকির খুঁজে পাওয়া যায় না। কেউ হাত বাড়িয়ে সাহায্য চায় না। গ্রামের একজন সাধারণ কৃষকও প্রতিদিন অনেক টাকা উপার্জন করেন। গ্রামে যে ফসল উৎপন্ন হচ্ছে, তা বিক্রি করে মানুষ সুখে আছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে শতভাগ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছবে, উৎপাদিত শস্য বিদেশে রফতানি করছে। জিডিপি ৮.২, মুদ্রাস্ফীতি ৫.৫, স্থানে বছরের প্রথম সপ্তাহে আমরা ৩৫ কোটি বই বিনামূল্যে বিতরণ করি। পদ্মা সেতুসহ মেগা প্রজেক্টসমূহ যেভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, যেভাবে উন্নয়ন তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে, এটাই শেখ হাসিনার সফলতা। এজন্যই মানুষ তাকে দেশরতœ বলে অভিহিত করেছেন। একটা ডুবে যাওয়া তরীকে তিনি শুধু ভাসিয়ে তোলেননি সজোরে চলার শক্তি জুগিয়েছেন। তাই এ কথা বলতেই হবে, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছেন কিন্তু ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রতি বিপ্লব ব্যর্থ করে দিয়ে, তারই কন্যা দেশকে পুনরুদ্ধার করে, দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাই বলতে হয়, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছেন আর চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছেন তারই সুযোগ্য কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু আর তার কন্যা হচ্ছেন ত্রাণকর্তা। পিতা সৃষ্টি করলেন স্বাধীন বাংলা আর তা রক্ষা করছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।

লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close