ইয়াসমীন রীমা

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২০

বিশ্লেষণ

শিশু স্বাস্থ্য রক্ষায় টিকার গুরুত্ব

সকাল থেকে মায়মুনা কাঁদছিলেন। কারণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার আজ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, তার তিন বছর বয়সের একমাত্র পুত্রসন্তান রুবেল হাঁটতে পারবে না। তার সরু হয়ে যাওয়া ডান পা-টা পোলিওতে আক্রান্ত। চিকিৎসা চলতে পারে, তবে ভালো হবে কি না ডাক্তার এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। রুবেলের মা তিন তিনটি কন্যাসন্তানের পর পুত্রসন্তান পেয়ে এত উচ্ছ্বসিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, গ্রাম্য কৃসংস্কার ‘দৃষ্টি’ লাগার ভয়ে কাউকে সে ভালো করে তার সন্তানকে দেখতে দেননি। এমনকি অসুখ-বিসুখেও ডাক্তারের কাছে যাননি। ঝাড়ফুঁক চিকিৎসা করেছেন। টিকার কথা তিনি শুনেছেন। তবে তার বিশ্বাস ছিল টিকা প্রদানে সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। কুমিল্লা লালমাই এলাকার লগ্নসার গ্রামের মৎস্যজীবী রুবেলের পিতা অনেক করে বলেছেন মায়মুনাকে রুবেলকে টিকা দেওয়ার জন্য। গত দুই বছর যাবত তাদের স্কুলঘরে টিকা দেওয়ার ক্যাম্পেইন বসেছিল। কিন্তু মায়মুনা শোনেননি সে কথা।

আমাদের দেশে সমস্যা সংকুল পরিবেশে প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করে। এদের মধ্যে পুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে প্রায় ৯ লাখ শিশু। প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার হতভাগ্য শিশু ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবজনিত কারণে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং যারা বেঁচে থাকে তারা সারাজীবন অন্ধত্বের বোঝা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার ও দেশের। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫০ দশমিক ৫৩ ভাগই শিশু। জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থা হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল যৌথ জরিপে দেখা যায়, পাঁচ বছরের কম বয়সি ১ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবজনিত অন্ধত্বের শিকার। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এটি একটি মারাত্মক সমস্যা এবং ভিটামিন-এ এর অভাবজনিত সমস্যার প্রধান ভুক্তভোগী। ১-৬ বছরের শিশু এবং তারা অধিকাংশই নিরক্ষর ও দরিদ্র পরিবারের। শিশুদের অন্ধত্ব দূরীকরণের উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নে বাংলাদেশে এ-কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭৬ সালে জনস্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮০ সাল থেকে একমাত্র সরকারি পুষ্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম সারা দেশে চালিয়ে আসছে। সে হিসেবে বলা যেতে পারে ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কর্মসূচির ধারাবাহিকতা বজায় থেকে স্বাস্থ্য বিভাগের একমাত্র কর্মসূচি ২০০০ সালে সারা দেশে জাতীয় ভিটামিন-এ সপ্তাহের উদ্দেশ্য ছিল মূলত দুটিÑ ১. আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোগ আইন ১৯৮৯-এর আওতায় ১৯৯৪ সালে বিধিমালা প্রণীত হয়। এ আইনে উল্লেখ ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৫ সাল থেকে আয়োডিনযুক্ত লবণ ছাড়া অন্য কোনো লবণ বিক্রয়, বাজারজাত প্রদর্শন ও বিতরণ সর্ম্পূণভাবে নিষিদ্ধ করা ছিল। ২. ভিটামিন-এ খাওয়ানো অর্জিত উচ্চহার বজায় রেখে উপরোক্ত শিশুরোগ ও শিশুমৃত্যু রোধ করা।

কিন্তু ১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো মা ও শিশুস্বাস্থ্য পক্ষ পালন করা হয় এবং প্রথম শিশুদের কেন্দ্রে এনে ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। তাতে দেখা যায়, বিগত সময়ে যা কখনোই ৫০ ভাগের বেশি হয়নি, সেখানে শতকরা ৮২ ভাগ পর্যন্ত সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। এ সফলতা দেখে পরবর্তীতে সরকার সিদ্ধান্ত নেন ভিটামিন-এ ক্যাপসুল বিতরণের পরিবর্তে ভিটামিন-এ খাওয়ানো হবে বিধায় এর নামকরণ করা হয় ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানো কর্মসূচি। এখন থেকে বছরে দুবার একটি জাতীয় টিকা দিবসের মাধ্যমে এবং অন্যটি জাতীয় ভিটামিন-এ সপ্তাহ পালনের মাধ্যমে এই কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।

ইউনিসেফের মাইদা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনেক মা-ই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ পান না। অনেক ক্ষেত্রেই নবাগত শিশুর পিতা সংকোচ কিংবা অন্য কোনো ধারণার বশবর্তী হয়ে শিশুর পরিচর্যাকে শুধু মায়ের প্রতি ছেড়ে দেন। কিন্তু এতে করে তিনি তার শিশু ও শিশুর মার কাছ থেকে দূরে সরে পড়েন। কারণ তার স্ত্রীকে তখন নতুন শিশুকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে অনেক সময় মা শিশুর যতœ নিতে ক্লান্ত ও বিরক্ত বোধও করতে পারেন। অনভিজ্ঞতা এর কারণ হতে পারে। এজন্য এ সময় নবাগত শিশুর মাকে সব ব্যাপারে সাহায্য করা উচিত। আর স্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে শিশুদের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশের অধিক শিশু অপুষ্ট অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। পিতা-মাতার অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, মায়ের ভগ্নস্বাস্থ্য ও পুষ্টিজ্ঞানের অভাবও অন্যতম কারণ। শিশু জন্মের পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়। এ সময় শিশুদের স্বাস্থ্যের প্রতি সঠিক যতœ না নিলে স্বাস্থ্য হানি ঘটে; যা পরবর্তী সময়ে পূরণ করা সম্ভব হয় না। তাই যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হয়। গ্রামের লোকেরা অজ্ঞতা কুসংস্কার ও প্রশিক্ষণহীন দাইয়ের মাধ্যমে প্রসব করানোর জন্য মা ও শিশু স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভূমিষ্ঠ হওয়ায় এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে শিশুদের দেহে রোগজীবাণু প্রবেশ করে। ০-৫ বৎসর বয়স পর্যন্ত শিশুরা ছয়টি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়। অতীতে এসব রোগের সঠিক চিকিৎসার অভাবে অন্যূন ৫ বছর বয়সের শিশুরা মৃত্যুবরণ করত। ষাটের দশকে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ২৫৭ জন। যা আশঙ্কাজনক। বর্তমানে এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাই ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে ওঠে।

শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ও ইপিআই সংগঠক ডা. গোলাম শাহজাহান বলেন, শিশুর ঘাতক ছয়টি মারাত্মক রোগ হচ্ছেÑ হাম, যক্ষ্মা, পোলিও, ধনুষ্টংকার, ডিপথেরিয়া ও হুপিং কাশি। গ্রামাঞ্চলের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের এসব রোগের প্রভাবকে মায়ের পাপের পরিণতি কিংবা ভূতপ্রেতের আছর বলে মনে করত। বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি এবং জনগণের সচেতনতার কারণে এসব রোগের টিকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ১ বছর বয়সের মধ্যে শিশুকে এসব টিকা প্রদান করা হয়। টিকা প্রদানের জন্য বাংলাদেশে বিভিন্ন হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পরিবার পরিকল্পনাকেন্দ্র, বিভিন্ন তারিখে বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ও এনজিও বিশেষভাবে কাজ করে। এসব কেন্দ্রে বিনামূল্যে টিকা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে।

ইপিআই শিশুদের টিকা প্রদানে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শিশুদের ছয়টি প্রতিষেধক টিকা দিয়ে শিশুস্বাস্থ্য রক্ষায় সদা সচেতন। তাছাড়া মাতৃস্বাস্থ্য রক্ষায়ও এ প্রতিষ্ঠানের বিস্তৃত কর্মসূচি রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়স্ক মহিলাদের টিকা প্রদান করে। শিশুদের প্রাণহরণকারী ছয়টি রোগের মধ্যে পোলিও অন্যতম। পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর বহু শিশু প্রাণ হারায়। এমনকি চিরকালের জন্য পঙ্গুত্বের শিকার হয়। পোলিও একটি ভাইরাসবাহিত রোগ। এ ভাইরাসটি টিকা প্রদানের মাধ্যমে দেহ থেকে নিঃসরিত করা হয়। তাই পোলিওয়ের বিষাক্ত ছোবল থেকে রেহাই পেতে জন্য টিকা প্রদানের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশ পোলিও নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত করার জন্য ইপিআই তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পোলিও নির্মূলের এ ভ্যাকসিন নির্দিষ্ট ডোজের অতিরিক্ত; যা দেহে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। পোলিও ভ্যাকসিন (ওপিভি) সংরক্ষণ করা খুব কষ্টকর। এগুলো স্বল্প সময়ের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। তাই তাৎক্ষণিকভাবে প্রদান করতে হয়, যা নিতান্তই জটিল। কারণ হাসপাতাল স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিরাই টিকা প্রদান কাজে নিয়োজিত থাকেন।

বর্তমানে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ছাত্র, স্কাউট ও বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যরা এ ব্যাপারে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন। এসব স্বেচ্ছাসেবী বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৫ বছরের কম বয়স্ক শিশুদের খুঁজে নিয়ে টিকা প্রদান করছেন এবং এই কার্যক্রমে সব রাউন্ড মিলিয়ে ৯২ দশমিক ৪০ ভাগ সফলতা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে। টিকা প্রদানে

সহায়তা করার জন্য প্রায় ৬ লাখ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন। তারা নির্দিষ্ট দিনে প্রতিটি শিশুকে টিকা প্রদান করেন। পোলিও নিমূর্লের এ প্রকল্পের কার্যক্রমে বর্তমানে আমাদের দেশে শিশুমৃত্যুর হার কমে এসেছে। বর্তমানে প্রতি হাজারে মাত্র ৯৬ জন অন্যদিকে ভুটানে তা ১০৭ জন, ভারতে ৭২, নেপালে ৮৬ এবং পাকিস্তানে শিশুমৃত্যুর হার ৭৪ জন।

শিশুদের যথাসময়ে প্রতিষেধক টিকা প্রদান করলে সম্ভাব্য জটিল রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অভিভাবকদের অজ্ঞতা ও অবহেলা সুষ্ঠু টিকাদান প্রক্রিয়ার অন্যতম অন্তরায়। তা না হলে রুবেলের মা মায়মুনার মতো কাঁদতে হবে সারা জীবন।

লেখক : গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close