গোপাল অধিকারী

  ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯

নিবন্ধ

সত্যের জয় অনিবার্য

বাংলাদেশ নিয়ে রচিত হয়েছে হাজারো গান, হাজারো কবিতা। বাংলাদেশেই রয়েছে হাজারো ছবি। সবুজ-শ্যামল অপরূপে সজ্জিত আমাদের জন্মভূমি। ‘বাংলাদেশ’ আমাদের কাছে এক গর্বের নাম। স্বাধীনভাবে চলা একটি পাললিক ভূমি। ডিসেম্বর মাস। জাতির ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মাস। বিজয়ের মাস। তথা গৌরবের মাস। স্মৃতির পাতায় গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম এক তাৎপর্যপূর্ণ মাস। এই মাসেই অর্জিত হয়েছে কাক্সিক্ষত বিজয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে পেয়েছি সেই বিজয়। পেয়েছি স্বাধীনতা। এই দিনেই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমরা পালন করি বিজয় দিবস হিসেবে। জাতীয় জীবনে আরো অনেক জাতীয় দিবস রয়েছে। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি, ‘মহান শহীদ দিবস’ যা ইউনেসকো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পালন করি ২৬ মার্চ ‘স্বাধীনতা দিবস’। এ ছাড়া নববর্ষ, পৌষ মেলা, নবান্ন উৎসবসহ বিভিন্ন বাঙালি উৎসবও আমরা পালন করে থাকি। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর আমাদের কাছে অতীব প্রেরণার। কারণটা সবাই কমবেশি জানি। আর না জানা থাকলে জানতে হবে।

খাঁচায় বন্দি পাখিকে ছেড়ে দিলে যেমন আনন্দের সীমা থাকে না। উড়ে চলে দিক-দিগন্তে। ঠিক তেমনি ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে পাখির মতো মুক্ত হয়ে চলার একটি দিন। যা পেতে সময় লেগেছে সুদীর্ঘ মুহূর্ত। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে হয়েছে প্রায় ৯ মাস। শহীদ হতে হয়েছে প্রায় ত্রিশ লাখ বাঙালিকে। সম্ভ্রম হারিয়েছে প্রায় তিন লাখ মা-বোন। আমরা যারা জন্ম থেকেই বাংলাদেশকে জানি বা চিনি অথবা বাংলাদেশ নামটি গর্বের সঙ্গে বলি বা গর্ব করি; সেই বাংলাদেশ কিন্তু সংগ্রামেরই ফসল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এমনিতেই আসেনি। সেই ১৭৫৭ সাল। যেদিন স্বাধীন বাংলার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। কিছু আত্মীয় মহলের চক্রান্ত্র ও অসহযোগিতায় নবাব পরাজিত হন এবং তাকে হত্যা করা হয়। সেই থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ চলে যায় ব্রিটিশদের অধীনে। চলে কোম্পানি আর ব্রিটিশদের শাসন। ব্যবসা করার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে এলেও বাংলার জমি সোনার চেয়েও খাঁটি, যা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি ব্রিটিশরা। পাঁয়তারা করে দেশকে শাসন করার। এভাবে চলে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন। তাইতো বলা, প্রায় ২০০ বছর স্বাধীন বাংলার সূর্য অস্তমিত ছিল। হয়তো কারো মনে হচ্ছে, তার অর্থ সূর্য ওঠেনি। ক্ষমা করবেন। এ্টা এই অর্থে বলা হয় না। প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশদের অত্যাচারে ভারতীয় উপমহাদেশ শোষিত হয়েছে, সেই অর্থে বলা সূর্য অস্তমিত ছিল।

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়। তার আগে বঙ্গভঙ্গসহ বিভিন্ন কৌশলে ব্রিটিশরা শাসন মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তৎকালীন সময়ে বর্তমান বাংলাদেশ হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান। তখনো আজকের বাংলাদেশ শোষিত। খেলাটা একই ছিল, শুধু খেলোয়াড় পরিবর্তন হয়েছিল। যার প্রথম প্রমাণ মিলে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু তাও সফল হয়নি। ভাষার জন্য রাজপথে মিছিল করে জীবন দিয়ে বাঙালিরা পৃথিবীতে বুঝিয়ে দিয়েছে তারা আন্দোলন করতে পারে। তারা ভাষার জন্য জীবন দিতে পারে। সেদিন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা শহীদদের রক্ত বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েছিল। সেদিনের সেই ইতিহাস নিজেদের অধিকার আদায়ের প্রেরণ জুগিয়েছিল। সাহস জুগিয়েছিল পরবর্তী সব আন্দোলন-সংগ্রামের। যার প্রতিদানস্বরূপ ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা যার প্রথম দফাই ছিল স্বায়ত্তশাসনের, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে অর্জিত হয় ১৬ ডিসেম্বর। পাওয়া যায় স্বাধীনতা। অর্জিত হয় বিজয়। এই বিজয় যেমন আনন্দের, তেমনই বেদনারও।

৭০-এর নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানিরা শুরু করে ক্ষমতা দেওয়ার নামে টালবাহানা। আলোচনার কথা বলে ২৫ মার্চ রাতে আকস্মিকভাবে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। সেদিন রাতেই চলে অপারেশন সার্চলাইট। হত্যা করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে। কিন্তু কেন? বাঙালি তাদের স্বাধিকার আদায়ের কথা বলে কোনো অপরাধ তো করেনি। তার পরও তারা ক্ষান্ত হয়নি। সর্বশেষ পরাজয় নিশ্চিত জেনে ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী দেশকে মেধাশূন্য করতে বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিকসহ মেধাবীদের ধরে নিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে। যে কারণে ১৪ ডিসেম্বর পালিত হয় ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’। কারণ ছিল তারা কেন কবিতা লেখেন দেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে। অপরাধ ছিল, কেন তারা গান গেয়ে বা কলমশক্তিতে দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেন। সব সত্য জানার পরও পাকিস্তানি বাহিনীরা চেয়েছিল একটি সত্যকে চাপা দিয়ে দেশের স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করতে। কিন্তু তারা জান তো না একটি সত্যকে হাজারো মিথ্যা দিয়ে দাবিয়ে রাখা যায় না। সত্য সব সময় চিরন্তন। অবিনশ্বর। তাদের সেই সব পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে বাঙালিরা ছিনিয়ে আনে বিজয়ের পতাকা। আমরা আজ স্বাধীন, আমরা আজ মুক্ত। তাইতো আবারও দৃঢ়কণ্ঠে বলতে চাই, ‘সত্যের জয় অনিবার্য’।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close