ইয়াসমীন রীমা

  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

জলবায়ু পরিবর্তনে বিব্রত বাংলাদেশ

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এরই মধ্যে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এখনো কৃষিনির্ভর। দেশের শতকরা ৬০ ভাগের অধিক মানুষের জীবিকা কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবিকায়ন ও খাতনির্ভর হওয়ায় সামগ্রিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতি বছরই দেশটির অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যাহত হয়। জলবায়ুগত দুর্যোগের ঘন ঘন শিকার হয়ে দেশটির ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষতি বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হয়ে আছে।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরজিআই) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে লবণাক্ততায় আক্রান্ত উপকূল-সংলগ্ন কৃষিজমির পরিমাণ সেখানে ছিল ৪৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বর্তমানে উপকূলীয় ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছোট-বড় প্রায় সব নদীর মাধ্যমে লবণপানি উজানের বিস্তীর্ণ কৃষিজমিকে গ্রাস করছে। সমুদ্্ররেখা থেকে ১৪৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ১০০ উপজেলার কৃষিজমি এখন লবণাক্ততার নীরব আগ্রাসনের শিকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং পদ্মার মতো বড় নদীতে পানিপ্রবাহ উদ্বেগজনক হারে হ্রাসের দরুণ লবণপানি উজানের দিকে ধেয়ে আসছে। আবাদি জমিতে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা বেশ কিছুদিন ধরেই কৃষি উৎপাদনে বড় ধরনের প্রতিবন্ধক হয়ে দঁাঁড়িয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় ১৩ জেলায় প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস; যার বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। সিংহভাগ মানুষের পেশা কৃষি। কিন্ত প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব এবং মানবসৃষ্ট দুর্ভোগের কারণে কৃষকের এই পেশাটি আজ হুমকির মুখে।

বাংলাদেশ পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘এখনো কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের লেগেই আছে। একটির ক্ষয়ক্ষতির ধ্বংস সামাল দিতে না দিতেই আগাত হানে নতুন কোনো না কোনো দুর্যোগ। ২০০৭ সালের সিডরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত উপকূলবাসী এখনো তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেনি। সেসব এলাকার গ্রামীণ অর্থনীতি এখনো পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি।’ জলবায়ুগত অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির বিচারেও বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। বারবার দুর্যোগের শিকার হয়ে অর্থনীতি দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকে আছে। নিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রামনির্ভর জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা বারবার নানা দুর্যোগের কবলে নিঃস্ব হয়ে যায়। প্রতিটি দুর্যোগের পর সব হারিয়ে আবার শূন্য হাতে শুরু করতে হয় নতুনভাবে জীবনধারণের সংগ্রাম। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির আশঙ্কা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড যেমন রাস্তাঘাট, কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো খাতেও ব্যয় বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্ব নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়েছে, যা দেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থা, কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদ খাতেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হয়। এসব বিষয় সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জের মাত্রা সৃষ্টি হয়। এসব কারণে দেশের স্বাভাবিক উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যাহত হয়।

এ প্রসঙ্গে কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ র ই শামীম বলেন, ‘জলবায়ুগত অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির বিচারেও বাংলাদেশে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। অতএব বাংলাদেশের অর্থনীতি ভবিষ্যতে আরো নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর এসব তথ্য-উপাত্তই বলে দেয় বাংলাদেশের অর্থনীতি জলবায়ুর ভালো-মন্দ আচরণের ওপর নির্ভরশীল। এজন্য জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবকে যথাযথ মোকাবিলার ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি।

জার্মান ওয়াচ নামক আন্তর্জাতিক সংস্থার ২০১০ সালের গবেষণা প্রতিবেদদের তথ্যে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে বছরে ক্ষতি হয় ২ হাজার ১৮৯ মিলিয়ন ডলার। জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে এর নেতিবাচক প্রভাব শতকরা ১.৮১ ভাগ। ১৯৯০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে হওয়া ক্ষতির প্রায় শতকরা ২০ ভাগই বাংলাদেশে হয়েছ্।ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪ সালের বন্যায় (প্রত্যক্ষ এবং উৎপাদিত পণ্যের পরোক্ষ ক্ষতিসহ) প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল আনুমানিক ১৩৪ বিলিয়ন টাকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে প্রতি বছরের গড় ক্ষতি ৪ বিলিয়ন ডলার।

লেখক : গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close