ডা. এম এ হাসান

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

মতামত

বুদ্ধিজীবী নিধন ছিল পাকিস্তানের শেষ চাল

জড় ও জীবের মধ্যে ভেদরেখা নির্ধারণ করে তার স্বাধীন সত্তা; স্বাধীন ইচ্ছাই জীবনের প্রাণকথা। এমন ইচ্ছা ও মানব মর্যাদায় অভিষিক্ত করে ঈশ্বর সহস্রধারায় বিভক্ত যে, মনুষ্য প্রজাতি সৃষ্টি করেছেন, তারই একটি ধারা গাঙেয় বাঙালি। আপন আত্মপরিচয়, ভাষা, সংস্কৃতি, আত্মবিশ্বাস ও পথচলাতে সে অনন্য। এমন একটি জাতি বিভ্রান্তির আবর্তে পড়ে ধর্মভিত্তিক ভেদরেখাকে সত্য জেনে ১৯৪৭-এ ভারত বিভক্তি মেনে নেয় এবং পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়।

রাষ্ট্রের জন্মের পরপরই জাতির স্বাধীনসত্তা ও ‘লিবার্টি’ বোধে আঘাত আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে যখন আত্মপরিচয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে; তখনই ভিনদেশের শাসককুলের শাসন ও শোষণ কদর্য হয়ে ওঠে। অথবা কদর্য হওয়ার কারণেই বোধের উদ্ভব ত্বরান্বিত হয়। যে বোধ ও জ্ঞানবুদ্ধিকে শাণিত করে ইতিবাচক কর্ম ও চিন্তায় প্রণোদনা সৃষ্টি করে, তা-ই শাসককুলের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে। তারা তাদের ভাষাকে তাড়া করে উল্টে দিতে চায় তাদের চিন্তা, চেতনা ও সংস্কৃতিকে। এ লক্ষ্যে দেশের বুদ্ধিজীবীদের শত্রু জ্ঞান করে গোড়া থেকেই। মৌলিক তথা স্বাধীন চিন্তার ধারকদের পথ রোধ করে তাদের নানাভাবে দুর্বল ও বিনাশ করতে নানা পদক্ষেপ নেন শাসকরা। এরই ধারাবাহিকতায় শাসক ও শোষকের শৃঙ্খল ভেঙে ’৬৯-এর আন্দোলন যখন সফল হয়ে ওঠে তখনই চূড়ান্ত হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা। সম্ভবত ড. জোহা ওই হত্যাকান্ডের প্রথম শিকার আর নাচোলের রানী ইলামিত্র নৃশংস নির্যাতনের প্রথম শিকার। ইলামিত্র নির্যাতিত হন পঞ্চাশের দশকে।

অনেকের ধারণা, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু বা ওটাই তাদের নষ্ট কাজের চূড়ান্ত প্রকাশ। মূলত বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হয় ’৭১-এর ২৫ মার্চ রাতেই, যখন ৩২ পাঞ্জাবের লে. কর্নেল তাজ খুঁজে খুঁজে ২৫ মার্চের শেষরাতে ড. জি সি দেব ও তার নিকটতম সহযোগী মোহাম্মদ আলীকে হত্যা করে। ওই রাতে নিহত হন ড. মুনিরুজ্জামান, অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যসহ আরো সাতজন শিক্ষক। ওই নষ্ট কর্মের অন্যতম সংঘটক কর্নেল তাজ ও ব্রিগেডিয়ার আসলাম। এর কয়েক দিন পরই রাজশাহীতে হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে। এ ধারাবাহিকতায় হত্যা করা হয় রণদাপ্রসাদ সাহা ও বাঙালি ভাষার অগ্রণী সেনা ধীরেন দত্তকে।

বুদ্ধিজীবী হত্যার খন্ডচিত্র ফুটে উঠেছে অধ্যাপক ফরিদা বানুর বক্তব্যে। শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের বোন অধ্যাপক ফরিদা বানু বলেন, ১৪ ডিসেম্বর ৭১-এ একফোঁটা পানি ছিল না কোয়ার্টারের ট্যাপে। মহসিন হলের হাউস টিউটর ছিলেন শহীদ গিয়াসউদ্দীন। থাকতেনও মহসিন হলের হাউস টিউটর কোয়ার্টারে। পানি না পেয়ে পানির পাম্পের মিস্ত্রি খুঁজতে বাসা থেকে নিচে নেমে গেলেন গিয়াসউদ্দীন সাহেব। আগের দিন ডিএসপি পরিচয়ধারী এক ব্যক্তির আচমকা টেলিফোনের কথাটি তখন তার মাথায়। পুলিশের এক কর্মকর্তা ১৩ ডিসেম্বর তাকে টেলিফোন করে জানিয়েছিলেন ৭১ ও ৭২ নম্বর ফ্ল্যাট দুটো খালি করে দিতে হবে পাকিস্তানি মিলিটারিদের জন্য। এসব কথা ভাবতে ভাবতে লুঙ্গি পরেই তিনি এখানে-ওখানে ছুটছিলেন মিস্ত্রির জন্য। সেসময় ফরিদা বানু তার স্বামীকে নিয়ে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। সকাল ৮টা হবে। ঠিক সেসময় কাদামাখা ইপিআরটিসির মাইক্রোবাস বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। খাকি শার্ট পরা চার-পাঁচজন লোক ওই বাস থেকে নেমে এলো। ওদের দুজনের হাতে রাইফেল। একজনের গায়ে কালো সোয়েটার। সেসময় তারা দেখলেন, তাদের একজন প্রভোস্ট অফিসের সামনে টেলিফোনের লাইন কাটছে। এর চার-পাঁচ মিনিট পর দরজায় ঠকঠকানি। সেসময় তার ভাই গোলাম কিবরিয়া দরজা খুলে দিলে মাইক্রোবাসে আসা দুজন আগন্তুক ঘরে প্রবেশ করল। একজনের হাতে রাইফেল। এসে খোঁজ করল গিয়াসউদ্দীনকে। তিনি বাসায় না থাকায় তারা প্রথমে চলে গিয়ে আট-দশ মিনিট পর আবার ফেরত এলো। ঘরময় গিয়াসউদ্দীনকে তন্নতন্ন করে খুঁজে তাকে না পেয়ে গোলাম কিবরিয়াকে ওরা চেপে ধরল। তারা জিজ্ঞাসা করল, গিয়াসউদ্দীন কোথায়? গিয়াসউদ্দীনকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তারা তখন তাকে ধরে নিয়ে গেল। যেখানটায় পানির পাম্প ছিল সেখানটায়। এরমধ্যে মাইক্রোবাসটি প্রভোস্ট অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল, গিয়াসউদ্দীন ওখানেই ছিলেন। তাকে আটকিয়ে হলের গার্ড আবদুর রহিমের গামছা দিয়ে তার চোখ বেঁধে ফেলল দস্যুরা। এরপর তাকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে গেল।

মূলত বাংলাদেশে গণহত্যার সবচেয়ে বর্বর ও ঘৃণ্য অধ্যায়টি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পক ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। জামায়াতে ইসলামীর দফতর সম্পাদক মাওলানা এ বি এম খালেক মজুমদারকে দেওয়া হয়েছিল ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড সমন্বয়ের দায়িত্ব। বুদ্ধিজীবী হত্যার একটি খসড়া পরিকল্পনা করেন জামায়াতের আব্বাস আলী খান ও গোলাম আযম। এই পরিকল্পনা যথাযথ অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়েছিল রাও ফরমান আলীর কাছে। সেটা করেছিলেন গোলাম আযম নিজেই। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন বদর বাহিনীর সদস্য আলী আহসান মুজাহিদ, নিজামী, কামারুজ্জামান, মাঈনুদ্দীন, আশরাফুজ্জামান, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান এমরান, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. এহসান, বরিশাল মেডিকেল কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা জলিল। ফরমান আলীর পরিকল্পনা ও এদের কাজের মধ্যে সমন্বয় করছিলেন পাকিস্তানের ব্রিগেডিয়ার বশির ও ক্যাপ্টেন তাহির। ইপিসিএফ, ওয়েস্ট পাকিস্তান রেঞ্জার্স, পুলিশ ও রাজাকারের কিছু সদস্য এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিল। অনেক বিহারিও এদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিল। শান্তি কমিটির যেসব শীর্ষ নেতা তাদের ছায়া হয়ে কাজ করছিলেন তারা হলেন সৈয়দ খাজা খয়ের উদ্দীন, এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, গোলাম আযম, মাহমুদ আলী, আবদুল জব্বার খদ্দর, মোহন মিয়া, মাওলানা সাইয়েদ মোহাম্মদ মাসুম, আবদুল মতিন, গোলাম সরওয়ার, এ এস এম সোলায়মান, এ কে রফিকুল হোসেন, নুরুজ্জামান, আতাউল হক খান, তোহা বিন হাবিব, মেজর আফসার উদ্দীন ও হাকিম ইরতেজাউর রহমান।

মুক্তির জন্য বাঙালির প্রাণপণ লড়াইকে যখন কোনোভাবেই আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না, তখনই পাকিস্তান তার শেষ চাল হিসেবে বাংলাদেশকে প্রশাসনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মক্ষেত্রে নিঃস্ব করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। অক্টোবর থেকেই আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রস্তুতি নেয়। নভেম্বরে অনেক বুদ্ধিজীবীর কাছে তারা হুশিয়ারি পত্র পাঠাতে শুরু করে এবং মধ্য নভেম্বরে তাদের কর্মকান্ড শুরু করে। এটি ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার দ্বিতীয় পর্ব। ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় ব্রিগেডিয়ার রাজা, রমনা থানা এলাকায় ব্রিগেডিয়ার আসলাম, তেজগাঁও এলাকায় ব্রিগেডিয়ার শরীফ এবং ধানমন্ডি এলাকায় ব্রিগেডিয়ার শফি ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। আলবদর হাইকমান্ড সদস্য আশরাফুজ্জামান খান এ বাহিনীর প্রধান ঘাতক ছিলেন বলে জানা যায়। ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য বদর বাহিনীর ৫০০ সদস্যকে নিয়োজিত করা হয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭২ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৭১ সালের মে মাসে কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীর কাছে ইয়াহিয়া সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ ফর্ম পাঠানো হয়। মনে করা হয়, তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই এই ফর্ম পাঠানো হয়েছিল। লন্ডন টাইমস বাংলাদেশের শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও সাহিত্যিকদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা ফাঁস করে দেয়। ফলে পরিকল্পনাটি সাময়িকভাবে স্থগিত থাকে।

শিক্ষকদের জাতির মাথা ও মেরুদন্ড ভেবেই পাক বাহিনী তাদের সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাঁটি তৈরির পর পাক বাহিনী পরিসংখ্যান বিভাগের কাজী সালেহ, গণিতশাস্ত্রের প্রভাষক মুজিবর রহমান, ফলিত পদার্থবিজ্ঞানের ড. রফিক এবং বাংলা বিভাগের ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালকে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। পাকিস্তানি তৎকালীন উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন এ তালিকা প্রণয়নের ব্যাপারে পাক বাহিনীকে সাহায্য করে। সংস্কৃত ভাষার সহকারী অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে হত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কাজলার পুকুর পাড়ের একটি গর্তে ফেলে রাখা হয়। ২৫ নভেম্বর মনোবিজ্ঞানের প্রভাষক মীর আবদুল কাইয়ুমকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায় পাক আর্মির অনুগত উপাচার্যের স্টেনো তৈয়ব আলী। ৩০ ডিসেম্বর পদ্মার চরের বাবলা বনে পাওয়া যায় তার লাশ। গণিত বিভাগের অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমানকে ১৫ এপ্রিল ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রিগেডিয়ার আসলাম ও কর্নেল তাজের অতিথি ভবনের ছাদে। পরে আর ফিরে আসেননি তিনি।

৯ জানুয়ারি, ১৯৭২ পূর্বদেশে প্রকাশিত রিপোর্টে একটি ডায়েরির কথা উল্লেখ করা হয়। সে ডায়েরিটি বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আলবদর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খানের বলে উল্লেখ করা হয়। এ আশরাফুজ্জামান মিরপুর গোরস্তানে সাতজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে বলে আগেই সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। যে গাড়িতে করে শিক্ষকদের নিয়ে যাওয়া হয়, তার চালক মফিজ উদ্দীন পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে এ তথ্য জানান। এ ডায়েরিটির দুটো পৃষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ জন বিশিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক গোলাম মুর্তজার নাম ও ঠিকানার উল্লেখ ছিল। এ ২০ জনের মধ্যে ১৪ ডিসেম্বর যে আটজন নিখোঁজ হন, তারা হলেনÑ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী,

অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক রশীদুল হাসান, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, ড. ফয়জুল মহী ও ডা. মুর্তজা।

বুদ্ধিজীবী হত্যার শেষ অধ্যায়টি শুরু হয় স্বাধীনতার মাত্র কদিন আগে ১০ ডিসেম্বর থেকে। এতে প্রথম শিকার হয়েছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন। এর পরপরই নিখোঁজ হতে থাকেন অনেকে। স্বাধীনতার আনন্দ ম্লান হয়ে যায় ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমি আবিষ্কারের পর। এখানে ইটখোলার মধ্যে পাওয়া যায় দেশের অনেক কৃতী সন্তানের লাশ। কারো চোখ-হাত বাঁধা, কারো চোখ তুলে নেওয়া, কারো বুক চিরে উপড়ে নেওয়া হয়েছে হৃৎপিন্ড।

একটি জাতিকে ঝাড়েমূলে মেধাশূন্য করাÑ মেধাভিত্তিক গণহত্যার অন্যতম নিদর্শন।

লেখক : চেয়ারপারসন

ওয়্যার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি

বাংলাদেশ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close