শতদল বড়ুয়া

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

কৃষক জানেন না নবান্ন উৎসব কী

অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে ধান কাটা চলছে। নবান্ন উৎসবে মাতোয়ারা রয়েছে দেশের নানা অঞ্চল। যাদের পরিশ্রমে সোনালি ধান মাঠে ঢেউ খেলছে, তারা কিন্তু নবান্ন উৎসব কী তা জানেন না। চন্দনাইশের উত্তর হাশিমপুর এলাকায় গিয়েছিলাম একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। পথের দূরত্ব কমাতে হাঁটছিলাম বিল কোনাকুনি। পাকা ধানের ম-ম ঘ্রাণে হাঁটতেও বেশ ভালো লাগছিল। রাস্তার ধারে ছোট চার দোকান। গরম গরম পেঁয়াজু বানাতে দেখে সে দোকানে বসে গেলাম। দোকান লোকে ঠাসা। অধিকাংশ লোক দিনমজুর। তারা পাশের জমিতে ধান কাটছিলেন। আমার সহপাঠী বলল, এখন তো নবান্ন উৎসবের দিন। দেশ-বাড়িতে এই উৎসব বেশ মজা করে পালন করা হয়। একজন চাষি বলল, নবান্ন উৎসব মানে কী? আমি বললাম, নবান্ন উৎসব মানে দুধ, গুড়, নারকেল, কলা প্রভৃতির সঙ্গে নতুন আতপ চাল খাওয়ার উৎসব বিশেষ। এককথায় কারো কোনো অনুভূতি নেই বুঝতে পেরে কথা বাড়ালাম না।

নবান্ন উৎসব সামাজিক ঐতিহ্যেরই একটা অংশ। গ্রাম অঞ্চলে এ ঐতিহ্য তেমন একটা চোখে না পড়লেও শহরে বিভিন্ন সংগঠন নবান্ন উৎসব পালন করে নানাভাবে। যাদের কেন্দ্র করে এ ধরনের উৎসবের সৃষ্টি, তারা কিন্তু এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। গ্রামীণ পর্যায়ে নানা উৎসব কিন্তু আগের মতো অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায় না। উদ্যোক্তা বা আয়োজকের অভাবে আমরা অনেক কিছু হারাতে বসেছি।

আবার যাত্রা করলাম। সাথী হলো এক জাত চাষি। দিগন্ত জোড়া সোনালি ফসল দেখে বললাম, ফসল ভালো হয়েছে। চাষিটি বললেন, মাঠের বুকে রাশি রাশি ধানের থোকা দেখে আমাদের মনও খুশির জোয়ারে ভাসছে। সেই খুশি আবার মিইয়ে যায় নানা প্রতিকূলতার কথা মনে এলে। এবার দিনমজুরের সংকট বেশি। বৈরী আবহাওয়া, বিলম্ব বৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টির ছোবল থেকে বাঁচিয়ে সোনালি ফসলকে মাড়িয়ে গোলায় তুলতে পারি না জমির মালিকের হিস্যা ও মহাজনের দাদনের টাকার বিনিময়ে ধান দেওয়ার কারণে।

বীজ, সার, দিনমজুরের বেতন জোগাতে ধান রোপণের শুরুতে মহাজনের কাছ থেকে যে টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তার জন্য অনেক কষ্টের ফসল নিজের ভাঙা গোলায় তোলার আগেই সমন জারি হয়ে যায় মহাজনের টাকা পৌঁছে দিতে। তপ্ত রোদের আগুনে পুড়ে শরীরের সব নোনাজল জমির মাটিতে ঢেলে দিয়ে যেই ফসল বাড়ির উঠানে এলো, তা দেখে কৃষকের পরিবার খুশিতে মাতোয়ারা।

শর্তমতো সব খাতে ভাগবাটোয়ারা করে দেখা গেল, কৃষাণের ভাঙা গোলা খালিই থেকে গেল। তার মনের কোনো আশা পূর্ণ হলো না। কৃষাণির একটা নতুন শাড়ি কেনার ইচ্ছাটি আর কৃষাণকে সাহস করে বলা হলো না। কৃষাণের মেয়ের আবদার ছিল বাপের কাছে এক জোড়া কানের দুল। মেয়েও আর সে কথা বাবাকে মনে করিয়ে দিতে পারছে না বাবার অবস্থা দেখে। বাবা কথা দিয়েছিল আদরের ছেলেকে ধান উঠলে নতুন শার্ট-প্যান্ট কিনে দেওয়ার। আজ বাবা বাকরুদ্ধ। ছেলেমেয়ে দুজনই বাবার কাছে গিয়ে বসে বলে, বাবা, এত চিন্তা করছো কেন? আমাদের যা আছে তা দিয়ে এ বছর পার করতে পারব। এই সামান্য কটা টাকা নাও, বাজারে গিয়ে একটা বড় দেখে মুরগি কিনে নিয়ে এসো। মাংস খাইনি অনেক দিন হয়েছে।

কৃষাণী বললেন, ধরো, এ টাকাগুলো দিয়ে তোমার জন্য একটা লুঙ্গি আনবে বাজার থেকে। কৃষাণ আহত সুরে বলেন, আমি তো কোনো টাকা তোমাকে দিতে পারিনি। তুমি কোথায় টাকা পেলে! কৃষাণী সহজ-সরল ভাষায় বললেন, এই সামান্য কথাটি ভুলে গেলে। আজ বয়স্ক-ভাতা পেয়েছি না! কৃষাণ এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি সহজে হারব না, আবারও মাঠে নামব। মমতাময়ী মায়ের মতো মাটিতে আবার নতুন ধানের চারা রোপণ করব।

উল্লিখিত কথাগুলো এক কৃষক পরিবারের মনের আকৃতি। আবার তারা আশায় বুক বাধে। সামনের ফলনে অবশ্যই সেই আশা পূরণ হবে। এভাবেই আমাদের দেশের কৃষকের সোনালি ধানের মাঝে লুকায়িত স্বপ্নগুলো বারবার মাথা দুলিয়ে চাষাবাদের প্রেরণা জোগায়। বৃষ্টি চুয়ে পড়া ভাঙা চালে নতুন শনের ছাউনি দেওয়ার কথাটি মনে পড়তেই কৃষাণ আর ঠিক থাকতে পারেন না, ছুটে চলে টাকার সন্ধানে। এভাবেই চলছে কৃষকের দিনকাল। সুখ নামক সোনার হরিণ তাদের অধরাই থেকে যায়।

শরতের শেষে হিমের ঘন ঘোমটাতে মুখ ঢেকে হেমন্ত আসে। শরৎ সৃষ্টির সুখে মাতোয়ারা থাকে কিন্তু ত্যাগের আদর্শ তার নেই। অথচ সৃষ্টি করে স্রষ্টা তা নিয়ে বসে থাকে না। বিলিয়ে দিতে পারলেই সার্থকতা খুঁজে পায়। সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে হেমন্তকে। কারণ তার আদর্শ ত্যাগের বর্ষ। শস্য উৎপাদনে সেই আয়োজন শুরু, শরৎ তা সম্পন্ন করে আর হেমন্ত তা মানুষের হাতে তুলে দিয়ে রিক্ততাকে বরণ করে নেয়।

হেমন্তে ধানখেত সোনালি আবরণে ছেয়ে য়ায়। মনে হয় মাঠে কেউ যেন মুঠো মুঠো সোনা ছড়িয়ে দিয়েছে। সোনালি ধানের শিষে ঝরে পড়ে সোনা রোদ্দুর। ধানের খেত যখন পাকা ধানে ভরপুর হয়, তখন সবার মনে আশার সঞ্চার হয়। কৃষক ধান কাটতে শুরু করেন। ধানখেত থেকে ভেসে আসে কৃষকের পরিতৃপ্তির সুর। সোনালি ধানের স্তূপ চাষিদের উঠানকে অপরূপে শোভিত করে। কাঁচা ধানের গন্ধে চাষির মন উৎফুল্ল হয়, বৌ-ঝিরা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ধানের এ সমারোহ হেমন্তের মমতাময়ী অবদান। নতুন ধানের চালের পিঠাপুলি তৈরির ধুম পড়ে যায় বাংলার ঘরে ঘরে। আত্মীয়-পরিজনবেষ্টিত হয়ে চাষিরা এ সময় আনন্দে মাতোয়ারা থাকেন। শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই উৎসবে মেতে বলে হেমন্তকে কৃষকের কাছে পরম কাক্সিক্ষত ঋতু। বাংলার হেমন্তটা যেন ফসলের গানে ভরা। গাছের শাখায় শাখায় হেমন্তের প্রভাত সূর্যের আলো কাঁচা সোনার মতো ছড়িয়ে দিগন্ত জোড়া মাঠ-প্রান্তরে। হেমন্তের মেঘবিহীন আকাশ থেকে রাতে চাঁদ রজত ধারা বর্ষণ করে ধরাতলে। তখন মনে হয়, নীরব নিশিতে কোনো ঘুম পাড়ানি গানের সুর বিলিয়ে বাংলার প্রকৃতিকে নিদ্রা নেওয়াতে চায়। মধুর করতে চায় নিবিড় মমতায়।

যারা মাঠে কাজ করে সোনালী ফসল ফলায় তাদের মনে শুধু একটাই আকুতি, কষ্টের ফসল ঘরে তুলতে পারলেই বাঁচি। প্রকৃতির কথা বলা যায় না, নিমিষেই সব স্বপ্ন চুরমার করে দেবে। তখন কৃষক দিশা হারিয়ে কূলের দিশা পাবেন না। গ্রামীণ আবহে তারা যেই উৎসবে মেতে ওঠে তা ক্ষণিকের জন্য। এক অজানা শঙ্কায় তারা সারাক্ষণ তটস্থ থাকেন। জমিদার লোক পাঠিয়ে ঋণ পরিশোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। জমির মালিকের হিস্যা নিয়ে কৃষক থাকে দুশ্চিন্তায়। পাকা ধানের লুকোচুরি খেলা দেখে সেই কৃষক মনে মনে রঙিন স্বপের জাল বোনে, সেই কৃষক চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে আহত পাখির মতো ছটফট করতে থাকে। আগের মতো কৃষকের বাড়িতে নেই ধানের গোলা, গোয়ালে নেই গরু। বর্তমানে এমনও কৃষক আছেন, তাদের গোয়ালঘর পর্যন্ত নেই। পুকুর ভারা মাছের কথা বাদই দিলাম। কারণ কৃষকের কাছে নেই পুকুরও। সবকিছুতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। কিন্তু কৃষকের অবস্থার হয় না কোনো পরিবর্তন। তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাঠে ফসল উৎপাদন করে বছরের ছয় মাস কোনো প্রকারে চললেও বাকি ছয় মাস বাজার থেকে চাল কিনে সংসার চালান।

কৃষক সরকার দেওয়া সুযোগ-সুবিধা সরাসরি পান না। এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় দেখা যায়, প্রকৃত কৃষক সরকারি সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে অকৃষক তা পেয়ে গেলেন। প্রতিবাদ করার সাহস কৃষকের নেই। ক্ষমতাবানরা তাদের টুঁটি চেপে ধরতে চান। এভাবে কোনো দিন কৃষকের দুর্দিন কাটবে না। দায়িত্বপ্রাপ্তরা সচেতন না হলে, জবাবদিহি না থাকলে এভাবেই চলতে থাকবে কৃষকের দিনকাল। তবে আশার কথা হলো, কৃষকও ঘরে বসে নেই। তারাও ছুটছেন সরকারি অনুদানের খোঁজখবর নিতে জেলা-উপজেলা এবং শহরের নির্দিষ্ট স্থানে। চট্টগ্রাম আদালত ভবনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে দেখা পেলাম পরিচিত এক কৃষকের। তিনি বললেন, আপনারা অনেক সুখে আছেন। এসেছিলাম আদালতে। কিন্তু কাজ শেষ। এখন যাচ্ছি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে। সেও শহরে এসেছেন। যোগাযোগ না রাখলে তো কোনো সহায়তা পাব না। তার কথা শুনে ভাবলাম, এভাবে অধিকার আদায়ে সোচ্চার না হলে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close