ফারহানা নওশীন

  ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯

অনুভূতি

আত্মহননই শেষ কথা নয়

ব্যস্ততম পৃথিবীতে যার যার মতো ব্যস্ত আমরা প্রত্যেকেই। কেউ ক্যারিয়ার নিয়ে, কেউ ক্লাসে প্রথম হওয়ার জন্য, কেউবা একবেলা একমুঠো ভাতের জন্য। দিন, সময় এভাবেই পার হয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে। নিত্যদিনের একটি চাহিদা পূরণ হলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি চাহিদা ঘাড়ে চেপে বসছে। এই ব্যস্ততম শহরে কেউ দিন পার করছেন ক্লান্তি, পরিশ্রম ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তায়, আবার এমনও মানুষ আছেন যারা জীবনকে তুচ্ছ ভেবে জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো অন্ধকারে কাটিয়ে দিচ্ছেন। এখানে তাদের কথাই বলা হচ্ছে, যারা সুন্দর পৃথিবী, ভালোবাসার পরিবারকে ছেড়ে আজীবনের জন্য পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে এক ধাপও পিছপা হচ্ছেন না। সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম একটি আাতঙ্কের নাম ‘আত্মহত্যা’।

বর্তমানে দুই ধরনের বয়সের মানুষকে বেশি অত্মহত্যা করতে দেখা যায়। প্রথমত. কিশোর-কিশোরী, দ্বিতীয়ত. বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের। কিশোর-কিশোরীদের বেশির ভাগ অত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, সাধারণত ঝোঁকগ্রস্ত হয়ে বা সামান্য কোনো অপ্রাপ্তির কারণে তারা এই ভয়ংকর পন্থাটি অবলম্বন করেন। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এরমধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিনজন আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ শিক্ষার্থী। এরমধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সবুজ মিত্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাসেল হোসাইন ও রবিউল আলম। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জারমিন আক্তার জুঁই, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বকুল দাশ ও তাইফুর রহমান প্রতীক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্টক্লাস সেকেন্ড বয় ফিরোজ কবির ও প্রিয়াংকা সাহা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সঞ্জু দেব। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুভ্র জ্যোতি টিকাদার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ছাত্র আবদুল্লাহ আল নোমান। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন রায়হান উদ্দিন সজিব। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে ছাত্র হংস প্রসাদ হিমু, তাসকিয়া নুহাশ ও সাকিব ভূঁইয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজছাত্রী মনিজা আক্তার মিতু ও ইডেন কলেজের সায়মা কালাম মেঘা আত্মহত্যা করেছেন।

২০১৮ সালে পাঁচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৯ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রকুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী আত্মঘাতী হয়েছেন। এর আগে ২০১৭ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় আট লাখ লোক আত্মহত্যা করে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন। ১৫-২৯ বছরের তরুণ-তরুণীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ আত্মহত্যা, ৭৯ শতাংশ আত্মহত্যা ঘটে আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রাপ্তবয়স্ক বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করে নিঃসঙ্গতা ও হতাশার কারণে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতপক্ষে এমন একটি প্ল্যাটফরম, যেখানে আপনার নিজের জায়গা নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়। আর একজন সন্তান যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন বাবা-মা ভেবেই নেন যে তার ছেলে অথবা মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক। নিজেদের জীবন নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ট সুবিবেচক তারা নিজেই। এ ভরসার জায়গা থেকে এজন্য এ সময় বাবা-মা হয়তো ছোটবেলার মতো সব খোঁজখবর নেন না। মাঝবয়সে যখন মা-বাবা আপনার ওপর একটু ভরসা করতে শুরু করেছেন, তখন নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে আত্মহনন করা কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ? নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মতো এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মা-বাবার স্বপ্নগুলোর কথা একটু ভাবা উচিত নয় কি? একজন মা ১০ মাস ১০ দিন গর্ভধারণের পর একটি সন্তান প্রসব করেন। মায়ের এই দীর্ঘ সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি সেকেন্ড কাটে অতিশয় কষ্টে আর প্রসব যন্ত্রণার কষ্টের কথা!

একজন সন্তানের জন্য মা-বাবার ত্যাগ এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। সন্তান প্রসব করার পর থেকে আত্মহত্যা নামক ভয়ংকর এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত বাবা-মার এ লড়াই চলতেই থাকে। যাদের বাবা-মা আছে তারা হয়তো একটু গভীরভাবে ভাবলেই বুঝতে পারবেন যে, বাবা-মায়ের প্রতিটি সকাল শুরু হয় কাকে কেন্দ্র করে? বাবা-মার প্রতিটা সকাল শুরু হয় তাদের সন্তানকে কেন্দ্র করে। বাবা-মার সকাল থেকে শুরু করে সারা দিনের পরিশ্রম শুধু তাদের সন্তানের ভবিষ্যতকেন্দ্রিক। কারণ তারা চান, আমাদের একটু কষ্ট হলেও আমার সন্তানের যেন কোনো কষ্ট না হয়। আমি একবেলা খারাপ খেলেও আমার সন্তান যেন ভালো খেতে পারে। জীবনকে একটু কাছ থেকে দেখলেই বোঝা যায়, জীবন আসলেই অসাধারণ। যে জীবন সৃষ্টিকর্তার মহিমায় আমরা পেয়ছি, সে জীবনকে ধ্বংস করে দেওয়ার অধিকার কারোর নেই। যে দেশে এখনো পাঁচটি মৌলিক অধিকার পূর্ণতা পায়নি, যে দেশে এখনো হাজার হাজার শিশু খোলা আকাশের নিচে অনাহারে দিন পার করছে; সেদেশে কিসের হতাশা! তাই এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার নিজের পরিবার ও নিজের এমন সুন্দর জীবন নিয়ে একবার ভাবা উচিত। এমনও তো হতে পারে আজ দিন খারাপ যাচ্ছে কিন্তু পরবর্তী সকাল আমার-আপনারÑ সবার জন্য বয়ে নিয়ে আসছে ভালো থাকার অবিরাম সম্ভাবনা। নিজেকেও নিজের পরিবার ও কাছের মানুষকে না ঠকিয়ে তাদের নিয়ে সুস্থ-সুন্দর জীবন গড়ার প্রয়াস নিয়ে জীবনযুদ্ধে যুগ যুগ টিকে থাকার স্বপ্নে নিজেকে উজ্জীবিত করার মাঝেই লুকিয়ে আছে মনুষ্যত্বের বিকাশ।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close