সাদাৎ রানা

  ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯

পর্যালোচনা

প্রয়োজন বছরব্যাপী ভেজালবিরোধী অভিযান

খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার বিষয়টি আমাদের দেশে সব সময় একটি আলোচিত বিষয়। আলোচিত হওয়ার কারণ বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে নয়, সারা বছরই খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার মতো অপকর্মে লিপ্ত থাকে এক শ্রেণির লোক। আর এমন প্রবণতা দিন দিন শুধু বাড়ছেই। এটাই সবচেয়ে ভয়ের খবর। আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারব না, প্রতিদিন আমরা যা খাচ্ছি তা কতটা নিরাপদ। কারণ ভেজাল খাদ্যে বাজার সয়লাব। নিজের কষ্টের টাকায় আমরা মহানন্দে পরিবারের জন্য বিষ কিনে নিয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন। দুঃখের বিষয় আমরা আসলে নিশ্চিত নই, ভালো কোনো খাবার কিনতে পারছি কি না। কারণ কোনটা যে ভেজালমুক্ত খাদ্য, তা নির্ণয় করাও কঠিন হয়ে পড়ছে সবার জন্য। ভেজাল খাদ্যের বিষয়টি সম্পর্কে সবাই অবগত, কিন্তু উদরপূর্তি তো করতে হবে। তাই জেনেও বিষ খেতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। অথচ খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে আমাদের দেশে রয়েছে আইন।

আমাদের দেশে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ)-এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে এবং ওষুধে ভেজাল মেশালে বা বিক্রি করলে অপরাধী ব্যক্তির মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছর কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। আইনের খাতায় এমন শাস্তির বিধান থাকলেও আমরা কখনো শুনিনি খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার অপরাধে কারো মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে। আমরা মাঝে মাঝে যা দেখি তা হলো, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ভেজালকারীকে আর্থিক দন্ড দেওয়া হয়। জরিমানার অঙ্কটা এতটাই কম হয় যে, অপরাধী তাৎক্ষণিক সেই টাকা পরিশোধ করে কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবারও মহানন্দে বলা যায় প্রায় দ্বিগুণ উৎসাহে ভেজাল খাদ্য বিক্রির মহোৎসবে মেতে ওঠেন। ১৯৭৪ সালে সেই আইন হলেও বর্তমান সময়ে বিশেষ করে দুই যুগ ধরে এ দেশে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মাত্রা বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। দিন দিন তা হয়ে উঠছে সবার জন্য অসহনীয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেন ভেজাল খাদ্য প্রস্তুতকারকদের মধ্যে চলে তুমুুল প্রতিযোগিতা। আইন থাকলেও আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার কারণে নিরুপায় জনগণ, জিম্মি বিষ প্রয়োগকারীদের কাছে।

আমরা প্রতিদিন যেসব ভেজাল খাদ্য খাচ্ছি তার তালিকা নেহায়েত ছোট নয়। সহজ কথায় প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা কোনো না কোনো ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করছি। শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ, মসলা থেকে ফলমূল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যে যেন ভেজালই এখন অনিবার্য। কেউ যদি মনে করেন, এসব ভেজাল খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হলে ওষুধ খেয়ে সুস্থ হবেন, সেখানেও অপেক্ষা করছে ভয়ানক বিপদ। কারণ ভেজালের তালিকায় বাদ নেই জীবনদায়ী ওষুধও; যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য সত্যিই ভয়ংকর খবর। দুঃখজনক হলেও সত্য, শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষজন না জেনে এসব মরণজ্ঞাতি জিনিস কিনে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিকারের আশায়। উল্টো প্রতিকার না হয়ে, ধাবিত হচ্ছে মৃত্যুর কোলে। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এমন করছেন ভেজালকারীরা? বাস্তবতা হলোÑ তারা সচেতনভাবে মূলত ফলমূল, শাকসবজি ও মাছে মেশাচ্ছেন জীবন ধ্বংসকারী বিষ ফরমালিন, ক্যালসিয়াম, কার্বাইড, ইথোফেন, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম পাউডার, ডিডিটিসহ নানা মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান। এ ছাড়া বিস্কুটসহ বেকারি দ্রব্যে রয়েছে বিষ সমতুল্য রং আর মুড়িতে দিচ্ছেন কৃষিকাজে ব্যবহৃত ইউরিয়া সার; যা খেয়ে আমরা ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছি নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। বিশেষ করে শিশুরা এসব খাদ্য গ্রহণ করে প্রতিনিয়ত অসুস্থ হচ্ছে। সাদা চোখে সব দেখছি। কিন্তু এর থেকে মুক্তির উপায় আজ বাস্তবিকই সোনার হরিণ। অসাধু ভেজালকারীরা মূলত একটা লক্ষ্য সামনে রেখে এসব কাজ সবার চোখের সামনে প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে। তা হলো অধিক মুনাফা। এটাই তাদের প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু তাদের অধিক মুনাফা লালসার কারণে অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সব মানুষ। অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে বিচলিত হওয়ার সামান্যতম অবকাশ নেই তাদের। এই লোভে অসাধু এসব ব্যবসায়ী জনসাধারণের হাতে প্রকারান্তরে বিষ তুলে দিচ্ছে; যা আমরা বুঝেও বুঝি না। অথচ তারাও কী বোঝে এই ভেজালের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত নয় তাদের সন্তানরাও!

এটা বলার অপেক্ষা রাখেন, ভেজাল খাদ্যে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি নানাভাবে। আর সে পরিসংখ্যান রীতিমতো পিলে চমকানো। গত দুই দশকে আমাদের চিকিৎসক ও পুষ্টিবিশেষজ্ঞরা বারবার ভেজাল খাদ্য বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে এলেও কর্ণপাত করছেটা কে? যদিও তথ্যটা ভয়ানক হলেও সত্য; বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল পণ্য ও খাদ্যদ্রব্যে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুহার দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে খাদ্যে ভেজালজনিত বেশ কয়েকটি রোগ আমাশয়, অ্যাপেনডিক্স, রক্তচাপ, হৃদরোগ ও কিডনি রোগ আর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এসব রোগে মানুষের মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার পরিসংখ্যান সত্যিই উদ্বেগজনক। সবার জন্যই ভয়ানক। কিন্তু এত সব তথ্যের মধ্যেও খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে বল্গাহীনভাবে। আর তা দিনকে দিন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। আর এই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার মূলত একটাই কারণ। সহজ কথায় আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব। আইন আছে, কিন্তু নেই এর সঠিক প্রয়োগ।

আমাদের দেশে ভেজালের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় রমজান মাস শুরু হলে। এই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে খাদ্যের দাম কমে এলেও আমাদের দেশে হয় উল্টো। প্রতিযোগিতা করে ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দেন মূল্য। এ সময় কিছু কিছু ব্যবসায়ী কেমিক্যাল ব্যবহার করে গোডাউনে অধিক খাদ্য মজুদ করে বাজারে সৃষ্টি করে কৃত্রিম সংকট। যার প্রভাব পড়ে সারা দেশে। দুঃখের বিষয় হলো, রমজানের সময় সবচেয়ে বেশি ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে। কেননা, এ সময়ে বিনিয়োগে লাভের অঙ্কটা অনেক বেশি। এই সুযোগটাই নেয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। মজার বিষয়, সারা বছর নীরব থাকলেও রমজানের সময় সারা দেশেই ভেজালবিরোধী অভিযান চলে চোখে পড়ার মতো। ছোট-বড় অঙ্কের সামান্য কিছু জরিমানাও করা হয় সেখানে। মূলত সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে।

অবাক করা বিষয় হলো, ভেজাল খাদ্যের বিষয়ে সারা বছরই মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি আলোচনা-লেখালেখিও হয়। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতার জন্য সভা-সেমিনারও কম হয় না। সবাই দাবি জানান নিরাপদ খাদ্যের। কিন্তু সেভাবে কাজের কাজ কিছুই হয় না। এর একমাত্র ও প্রধান কারণ ভেজালকারীদের যথাযথ শাস্তির আওতায় না আনা। আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা। সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্ধারিত আইনে মামলা না করা। এসব কারণে ভেজালকারীরা মূলত খাদ্যে ভেজাল মেশাতে সাহস পাচ্ছেন। লঘু শাস্তির কারণে ভেজালবিরোধী অভিযানের ভয়ের কোনো তোয়াক্কা না করে মহানন্দে চলছে খাদ্যে ভেজাল মেশানো। অথচ প্রশাসনের সঠিক আর কার্যকর উদ্যোগ এবং সবার একটু সচেতনতাই পারে আমাদের এসব বিষ থেকে মুক্ত রাখতে। আর পেছনে ফিরে না তাকিয়ে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এখনই। কারণ এর সঙ্গে জড়িত মানুষের জীবন। জড়িত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের, ভবিষ্যৎও। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখন শুধু রমজান মাসের জন্য অপেক্ষা না করে বছরব্যাপী ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তবেই হয়তো আমরা কিছুটা পরিত্রাণ পেতে পারি ভেজাল খাদ্য থেকে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close